মোঃ শামীম মিয়া

বাংলাদেশ নামটি এসেছে ভাষার সংগ্রাম থেকে, আর সে সংগ্রামের মূল প্রেরণা ছিল মানুষের নিজের ভাষায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নজির নেই যে কোনো জাতি তাদের মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে, সংগ্রাম করেছে এবং রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূল দর্শনকে ভাষার মর্যাদার ওপর দাঁড় করিয়েছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে যে তরুণেরা রক্তাক্ত হয়েছিলেন, তাদের বুকে ছিল বাংলা ভাষার প্রতি অসীম ভালোবাসা, আর সে ভালোবাসাই পরবর্তীতে স্বাধীনতার পথকে প্রজ্বলিত করেছিল। কিন্তু আজ স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও আমাদের রাষ্ট্রচর্চার একটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানÑআদালতের রায়Ñমাতৃভাষায় লেখা নেই। উচ্চ আদালত, আপিল বিভাগ, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালসহ সব গুরুত্বপূর্ণ রায় এখনো ইংরেজি ভাষার বাঁধনে আবদ্ধ। প্রশ্ন উঠতে বাধ্যÑএ দেশে বাংলা ভাষার সম্মান কোথায়? মানুষের ভাষা কি কেবল আনুষ্ঠানিক স্লোগানে সীমাবদ্ধ থাকবে? নাকি রাষ্ট্রের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ নথি বাংলায় হওয়া উচিতÑযাতে জনগণ বুঝতে পারে, বিচার-প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারে, এবং রায়ের তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারে? জুলাই অভ্যুত্থানের পর মানবতাবিরোধী অপরাধে শেখ হাসিনা ও তার ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে হওয়া ঐতিহাসিক রায় সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ইংরেজিতে। রায়ের দিন আদালত কক্ষ ভরা, বাইরে প্রচুর মানুষ অপেক্ষায়। সবাই শুনবে বলে এসেছে, বুঝবে বলে এসেছে, জানবে বলে এসেছেÑকিন্তু যখন বিচারক ধারাবাহিকভাবে ইংরেজিতে রায় পড়তে থাকলেন, তখন বাইরে অপেক্ষারত লাখো মানুষের মধ্যে নেমে এলো হতাশা ও বিভ্রান্তি।

কেউ জানল না কী রায় হলো, কেন হলো, কী যুক্তি ছিল, অপরাধ কীভাবে প্রমাণিত হলো। যারা বাকস্বাধীনতা, অধিকার ও ন্যায়বিচারের স্বপ্ন দেখেন, তারা রায়ের পৃষ্ঠা ধরে ধরে পাঠ করেননিÑকারণ ভাষাটাই তাদের কাছে অপরিচিত। এটি কি ভাষাকে ছোট করা নয়? এটি কি নাগরিকের অধিকারহরণের সামিল নয়? একজন মানুষ যদি নিজের দেশের রায় বুঝতেই না পারে, তাহলে সে দেশে ন্যায়বিচার কীভাবে প্রতিষ্ঠা পাবে? বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার একটি অদ্ভুত বৈপরীত্য হলোÑসংবিধান বাংলায়, জাতীয় শপথ বাংলায়, আইন প্রণয়ন বাংলায়, সরকারি দপ্তর বাংলায়, কিন্তু উচ্চ আদালতে ঢুকলেই সব ইংরেজি। যেন এটি আরেকটি পৃথক পৃথিবীÑএকটি ইংরেজি প্রশাসন, যেখানে বাংলা ভাষা যেন পরপুরুষ। বিচারক, আইনজীবী, নথি, রেফারেন্সÑসবই ইংরেজি। আদালতের ভেতরে দাঁড়ালে মনে হয় যেন এখনো ব্রিটিশ শাসন চলছে। অথচ ১৯৭২ সালের সংবিধানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে রাষ্ট্রের সব কাজ, সিদ্ধান্ত, নথিপত্র বাংলায় হবে। ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন পাস করে সংসদ, যেখানে বলা আছেÑবাংলাদেশের সব আদালতে, সব দপ্তরে এবং সব রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে বাংলা ভাষা বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাস্তবতা হলোÑউচ্চ আদালত এখনো ইংরেজির ওপর নির্ভর করে আছে, উচ্চ আদালতের রায় বাংলায় লেখা হয় না, মামলা-মোকদ্দমার মূল নথি ও আদেশ ইংরেজিতে লেখা হয়, এবং বাংলা ভাষা কেবল নিম্ন আদালতে সীমাবদ্ধ।

কেন এমন বৈষম্য? কেন এ অদ্ভুত দ্বৈততা? এর উত্তর খুঁজলে আমরা পাইÑএটি ইচ্ছাকৃত ভাষা-বিদ্বেষ নয়, বরং একটি পুরাতন কাঠামোর ছায়া। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সময়ে বিচারব্যবস্থায় ইংরেজি ছিল একচ্ছত্র। স্বাধীনতার পরও আমরা সে কাঠামোকে ভাঙতে পারিনি। বিচারকেরা ইংরেজিতে প্রশিক্ষণ নেন, আইনজীবীরা রেফারেন্স বই হিসেবে ইংরেজি ব্যবহার করেন, আইন সচিবালয় ইংরেজিতে কাজ করে, এবং আদালতের বিচারিক ভাষাও ইংরেজিতে রয়ে গেছে। বাংলা আইনি পরিভাষা তৈরি হয়নি, আইন বইগুলো বাংলায় লেখা হয়নি, এবং বিচারকদের প্রশিক্ষণে বাংলা রায় লেখার বাধ্যবাধকতাও নেই। ফলে একটি পুরো ব্যবস্থা এখনো ইংরেজির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আদালত তো মানুষের জন্য। আইন, বিচার, রাষ্ট্রÑএসবের উদ্দেশ্যই সাধারণ মানুষের সেবা করা। একজন মানুষ যদি রায়ই বুঝতে না পারে, তাহলে সে বিচার মানুষের কাছে কোনো মূল্য বহন করে না। মামলার রায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঠক কিন্তু বিচারক নন, আইনজীবীও ননÑসবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঠক হলেন জনগণ। জনগণই বিচারপ্রার্থীর আত্মীয়, প্রতিবেশী, সমাজ, রাষ্ট্র। তারা যদি বুঝতেই না পারে তাদের দেশের রায়ে কী বলা হয়েছে, তাহলে বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা কীভাবে জন্মাবে? মানুষকে বাদ দিয়ে বিচারব্যবস্থা চলতে পারে না।

বিচার মানুষের হাতে পৌঁছায় তখনই যখন ভাষা তার কাছে পৌঁছায়। ভাষা শুধু শব্দ নয়Ñভাষা মানুষের জ্ঞান, চেতনা, বুঝতে পারার ক্ষমতা। ভাষা বাদ পড়ে গেলে মানুষ বাদ পড়ে। আর মানুষ বাদ পড়লে বিচার থাকে নাÑথাকে কেবল ফরমালিটি, কেবল কাঠামো, কেবল প্রতিষ্ঠানগত ক্ষমতা। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় ইংরেজিতে লেখা হলো কেন? অনেকে বলেনÑএটি আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার জন্য। সত্য কথা হলো, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা যেন সহজে পড়তে পারেÑএটা একটি যুক্তি। কিন্তু সে রায়ের বাংলা অনুবাদ তো সঙ্গে সঙ্গেই প্রকাশ করা যেত! ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কাÑসব দেশই দ্বিভাষিক রায় প্রদান করে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের শত শত রায় হিন্দি, তামিল, বাংলা, মালয়ালমসহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়। নেপালের সুপ্রিম কোর্ট প্রত্যেকটি রায় নেপালি ভাষায় লিখে। শ্রীলঙ্কা আদালতের রায় সিংহলি ও তামিল উভয় ভাষায় প্রকাশ করে। সেখানে বাংলাদেশ কেন ব্যতিক্রম? আমরা কি এমন একটি রাষ্ট্র চাই, যেখানে জনগণের ওপর বিচার লুকিয়ে রাখা হবে? যেখানে মানুষকে তার নিজের ভাষায় রায় বুঝতে হলে অন্যের সাহায্য নিতে হবে? যেখানে রাষ্ট্রভাষা শুধু কাগজে থাকবে, বাস্তবে থাকবে না? ভাষা আন্দোলনের শহীদেরা কি এ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেনÑযেখানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নথি ভাষান্তর হয়ে থাকবে মানুষের কাছে?

বাংলা ভাষাকে ছোট করা হচ্ছে বলে জনগণের যে ক্ষোভ, সেটি একেবারেই যৌক্তিক। রাষ্ট্রভাষা কোনো আবেগের বিষয় নয়Ñএটি জাতীয় পরিচয়ের সবচেয়ে বড় শক্তি। একটি রাষ্ট্রের আত্মপরিচয় তার ভাষার মধ্যেই নিহিত। আর বিচারব্যবস্থা রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। এ দুটি স্তম্ভ যদি আলাদা পথে হাঁটেÑরাষ্ট্রভাষা একদিকে, আদালতের ভাষা অন্যদিকেÑতাহলে রাষ্ট্রের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। ন্যায়বিচারের প্রতি মানুষের আস্থা ভেঙে যায়। মানুষ মনে করেÑবিচারব্যবস্থা তাদের নয়, অন্য কারও জন্য। নিজেকে বাদ পড়া মনে হলে মানুষ রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক হারায়। আর রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বিপদ তখনই আসেÑযখন মানুষ বিশ্বাস হারায়।

বাংলাদেশে এখন প্রয়োজন একটি সুস্পষ্ট, দৃঢ়, আইনগত ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তÑউচ্চ আদালতের রায় বাংলায় লেখা বাধ্যতামূলক করতে হবে। শুধুই বাধ্যতামূলক নয়Ñএটি হতে হবে বাস্তবায়নযোগ্য। অর্থাৎ আদালতকে আধুনিক করতে হবে, বাংলা আইনি পরিভাষা প্রণয়ন করতে হবে, বিচারকদের প্রশিক্ষণে বাংলা রায় লেখার পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, আইন মন্ত্রণালয়কে অনুবাদ কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে, এবং প্রতিটি রায়ের পাশাপাশি দ্রুত বাংলা কপি প্রকাশ নিশ্চিত করতে হবে। ইংরেজি কপি থাকুকÑএতে সমস্যা নেই। কিন্তু মূল রায় বাংলায় হতে হবেÑকারণ এটি মানুষের রায়। এ রাষ্ট্রকে মানুষের রাষ্ট্র হতে হলে তার ভাষা হতে হবে মানুষের ভাষা। আইন মানুষের ভাষায় হতে হবে, বিচার মানুষের ভাষায় হতে হবে, আদালত মানুষের ভাষায় কথা বলবেÑএটাই ন্যায়, এটাই অধিকার, এটাই স্বাধিকার।

যেসব দেশে রাষ্ট্রভাষা সম্মানিত হয়নি, সেসব দেশে জনগণের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক দুর্বল হয়েছে। আর বাংলাদেশ তো এমন একটি রাষ্ট্র, যেখানে ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া হয়েছে। সে রাষ্ট্রে ভাষাকে আদালতের চার দেয়ালের মধ্যে আটকে রাখা যায় না। বাংলা ভাষা কেবল আবেগ নয়Ñএটি আমাদের অস্তিত্ব, পরিচয়, ইতিহাস, অধিকার এবং ভবিষ্যৎ। এ অস্তিত্বকে আদালতের অজুহাত, কাঠামো, রেফারেন্স বই কিংবা ইংরেজি অভ্যাসের কাছে বন্দী রাখা যায় না। রায় বাংলায় লেখা হলে বিচার মানুষের কাছে পৌঁছাবে, মানুষের আস্থা ফিরবে, রাষ্ট্র হবে আরও স্বচ্ছ, আরও জবাবদিহিমূলক, আরও মানবিক। রাষ্ট্র হবে মানুষের বাংলাদেশÑমানুষের ভাষায়। সুতরাং সময় এসেছে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়ার। বাংলায় রায় হোক। বাংলাকে সম্মান করা হোক। এই রাষ্ট্র সত্যিই হয়ে উঠুক মানুষের বাংলাদেশ, মানুষের ভাষায়।

লেখক : শিক্ষার্থী, ফুলছড়ি সরকারি কলেজ।