এডভোকেট সাবিকুন্নাহার মুন্নী

মুসলিম সমাজে ঈদ পালিত হয়ে আসছে নানা সাজে, নানা উৎসব-আয়োজনে। ঈদের এমন ঐতিহ্য প্রিয় নবী রাসূল (সা.)-এর যুগ থেকেই চলে আসছে। পূর্ববর্তী নবীদের যুগে রোজার বিধান থাকলেও রোজা শেষে এমন ঈদ পালিত হতো না। রাসূল (সা.)-এর সময় থেকে আল্লাহর নির্দেশে দুটো ঈদ পালনের রীতি শুরু হয়। মদিনায় দ্বিতীয় হিজরিতে মুসলমানরা প্রথমবারের মতো ঈদ পালন করেন। আর মক্কায় প্রথম ঈদ পালন করা হয় অষ্টম হিজরিতে মক্কা বিজয়ের ঠিক ১১ দিন পর।

সময়ের পরিবর্তনে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে দিগ থেকে দিগন্তে। মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া থেকে মুসলিম সুফি, দরবেশ ও সাধকেরা ইসলাম ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে উত্তর ভারত হয়ে পূর্ব বাংলায় আসেন। এ ছাড়া আরবীয় এবং অন্যান্য মুসলিম দেশের বণিকেরা চট্টগ্রাম নৌবন্দরের মাধ্যমেও বাংলার সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। তাঁদের হাত ধরেই এ দেশে ইসলাম ধর্মের আগমন ঘটে। সে সূত্রে, ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গদেশ মুসলিম অধিকারে এলেও নামাজ, রোজা ও ঈদ উদযাপনের প্রচলন হয় তারও বেশ আগে থেকেই।

ঘটা করে ঈদ পালনের রীতি শুরু হয় স্বাধীন সুলতানি আমলে। ধারণা করা হয়, সে আমলেই প্রথম ঢাকা শহরে উৎসবমুখর পরিবেশে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা পালন শুরু হয়। তখন কৃষিনির্ভর গ্রামবাংলায় বসবাসকারী মুসলমানরা যার যার সাধ্য অনুযায়ী ঈদের আনন্দে মেতে উঠত। ইবাদত, খাওয়া-দাওয়া ও আনন্দ-উৎসব- সবই ছিল তাতে। তাদের এ আয়োজনে বিভিন্ন ধর্মের লোকজনও শামিল হতো। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতো।

ঐতিহাসিকদের মতে, পরবর্তী সময়ে বঙ্গদেশে ঈদ উদযাপনকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে মোগলরা। মোগলরা ঢাকায় এসেছিল ১৬১০ সালে। তখন ঈদের সময় মোগল সৈন্যদের ছাউনি থেকে ঈদের আনন্দবার্তা ঘোষণা করা হতো। ঈদের দিন মুসলমান নারী-পুরুষ ও শিশু-কিশোররা সুন্দর পোশাক পরত। সেজেগুজে দল বেঁধে ঈদগাহে যেত। একসঙ্গে নামাজ আদায় করত। নামাজের পরে কোথাও কোথাও ঈদের মিছিল হতো। আর্থিকভাবে সচ্ছল ব্যক্তিরা ঈদগাহে আসা-যাওয়ার সময় দুঃস্থদের মাঝে মুক্তহস্তে অর্থ দান করতো ও উপহারাদি বিনিময় করতো। খাবারের আয়োজনেও থাকত নানা বৈচিত্র্য।

বিগত স্বৈরাচারের আমলে সাধারণ মানুষ প্রকৃত ঈদ আনন্দ থেকে বঞ্চিত ছিল। মামলা হামলা ও ধরপাকড়ের ভয়ে অধিকাংশ মানুষ নিজ বাড়ীতে অবস্থান করতে পারতো না, স্বাধীনভাবে ঈদ উদযাপন করতে পারতো না। বিরোধী দল করার অপরাধে ঈদের নামাজ থেকেও অনেক নিরীহ মানুষকে এ্যারেস্ট করা হয়েছে।

ঈদ বিনোদনের নামে সাংস্কৃতিক অঙ্গনকেও কলুষিত করা হয়েছিল। অপসংস্কৃতি ও অশ্লীলতার জোয়ারে ভাসছিল গোটা দেশ। ঢাকা নগরীকে মসজিদের নগরীর পরিবর্তে মূর্তির নগরীতে পরিণত করা হয়েছিল। পরিকল্পিতভাবে পহেলা বৈশাখ, ভাষা দিবসসহ জাতীয় দিবসগুলোর আনুষ্ঠানিকতাকে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি ও শির্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছিল। ইসলামী সংস্কৃতিকে মুছে ফেলার সকল আয়োজন সম্পন্ন করেছিল।

২৪-এ ছাত্র জনতার এতবড় একটা অভ্যুত্থান ও রক্তাক্ত বিপ্লবের পর, জনগণ নতুন বাংলাদেশে রাম বাম রাহুমুক্ত, জাতীয় কৃষ্টি কালচারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি সুস্থ সুন্দর সাংস্কৃতিক আবহ প্রত্যাশা করছিল! কিন্তু আমরা পবিত্র ঈদুল ফিতরে কী দেখতে পেলাম! ঈদের আনন্দ মিছিলের নামে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিরূপ জাতির সামনে এ কোন সংস্কৃতি তুলে ধরা হলো? দীর্ঘ ১ মাস সিয়াম সাধনার পর এ আনন্দ মিছিলে মুসলিম কৃষ্টি কালচার তথা পবিত্র সিয়ামের শিক্ষার ন্যূনতম ছিটেফাঁটাও প্রত্যক্ষ করলাম না। মনে রাখতে হবে ঈদ শুধুমাত্র একটা আনন্দানুষ্ঠানের নাম নয়, ইবাদতও বটে।

ঈদের অন্যতম অনুসঙ্গ চাঁদ, তারা, মসজিদ, মিনার, আল কুরআন নাযিলের মাস হিসেবে আল-কুরআন, মুসলিম ভাই হিসেবে ফিলিস্তিনীদের ব্যাপারে একাত্মতার কোন সিম্বল ছিল না সে আনন্দ মিছিলে। যা আমাদের দারুণভাবে হতাশ করছে, ব্যথিত করেছে। স্বৈরাচারের চাপিয়ে দেয়া, ধার করা সংস্কৃতির সাথে এর তেমন কোন পার্থক্য আছে বলে মনে হয় না!

মোল্লা নাসিরুদ্দীন বানিয়ে দাড়ি মুখে গাধার পিঠে উল্টো মুখে বসা মূর্তি, গরু মহিষের গাড়ী, হাতি ঘোড়াসহ বিভিন্ন পশু পাখির মূর্তি এগুলো দিয়ে জাতির সাথে কী ধরনের তামাশা করা হয়েছে? বহু বিতর্কিত সাংস্কৃতিক উপদেষ্টার বিতর্কিত উপস্থাপনই প্রমাণ করে, উপদেষ্টা হিসেবে তার নিয়োগের পর সমগ্র দেশজুড়ে কেন এতটা বিতর্কের ঝড় উঠেছিল!

ঢাকাইয়া ঈদের সুলতানি-মুঘল উৎসবের নামে এ কোন সংস্কৃতি তুলে ধরা হলো, জাতি জানতে চায়? কোন সাহসে এমন উদ্ভট বিতর্কিত উৎসব আমাদের মুসলিম কৃষ্টি কালচারের নামে চালিয়ে দেয়া হলো! তাও আবার পবিত্র ঈদুল ফিতরকে ঘিরে?

আনন্দ মিছিলের নামে জাতির সামনে এমন তামাশাপূর্ণ উপস্থাপন জাতীয় কৃষ্টি-কালচারের সাথে প্রতারণার শামিল! ছাত্র-জনতার ম্যান্ডেট নিয়ে যে সরকারকে দেশ পরিচালনায় বসানো হয়েছে তারা কতটুকু জনগণের আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পেরেছে? এধরনের তামাশা গভীর কোন ষড়যন্ত্রের অংশ বলে মনে হচ্ছে। জাতিকে গৌরবময় ইতিহাস থেকে সরিয়ে শেকড় কাটার পাঁয়তারা চলছে!

আমার দৃষ্টিতে, জনগণের সাধারণ প্রত্যাশার সাথে এহেন মশকরা, বেঈমানীপূর্ণ ও গর্হিতকর আয়োজনের যথাযথ তদন্ত ও আয়োজকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া প্রয়োজন! এ ব্যাপারে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, আশা করি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মীয় উপদেষ্টা এর ব্যাখ্যা প্রদান করবেন জাতির সামনে।

সে সাথে আগামীতে জনআকাক্সক্ষার বিপরীতে গিয়ে ও জাতীয় ঐতিহ্য এবং কৃষ্টি-কালচারের বাইরে এসে এ ধরনের উপস্থাপনা থেকে বিরত থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করছি। তা না হলে বিগত স্বৈরাচারের মত জনমতের বাইরে গেলে তাদেরকেও জনরোষে পতিত হয়ে করুণ পরিণতি বহন করতে হবে।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, মাসুক (মানবাধিকার ও আইনী সুরক্ষা কেন্দ্র)।