‘গণতন্ত্র’ আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও অধিকতর গ্রহণযোগ্য শাসন পদ্ধতি হলেও এর পথচলা খুব একটা মসৃণ নয় বরং নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়েই চলতে হচ্ছে। ফলে আগামী বিশ্বের রাষ্ট্রচিন্তকদের মধ্যে নতুন করে ভাবান্তর সৃষ্টি হয়েছে। মাত্র কয়েক দিন আগেই মালয়েশিয়ার রূপকার ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী মহাথির মোহাম্মদ অনেকটা খেদোক্তি করেই বলেছেন, ‘গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে’। তবে নানা বিতর্কের মধ্যেও গণতন্ত্র যে এখনো প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

বস্তুত, গণতন্ত্র বলতে কোনও জাতিরাষ্ট্রের বা কোনও সংগঠনের এমন একটি শাসনব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে নীতিনির্ধারণ বা সরকারি প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রত্যেক নাগরিক বা সদস্যের সমান ভোটাধিকার থাকে। গণতন্ত্রে আইন প্রস্তাবনা, প্রণয়ন ও তৈরির ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের অংশগ্রহণের সমান সুযোগ রয়েছে, যা সরাসরি বা নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে হয়ে থাকে। ‘গণতন্ত্র’ পরিভাষাটি সাধারণভাবে একটি রাজনৈতিক রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা হলেও অন্যান্য সংস্থা বা সংগঠনের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য হতে পারে, যেমন বিশ্ববিদ্যালয়, শ্রমিক ইউনিয়ন, রাষ্ট্র-মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি।

মূলত, ‘গণতন্ত্র’ ইংরেজি Democracy থেকে এসেছে। এর উৎপত্তি গ্রিক শব্দ ‘দেমোক্রাতিয়া’ থেকে। অর্থ ‘জনগণের শাসন’। খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকে অ্যাথেন্স সহ অন্যান্য গ্রিক নগররাষ্ট্রে বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বোঝাতে শব্দটির প্রথম প্রয়োগ। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ক্লিসথেনিস থিউরীতে নতুন ধরনের সরকার চালু হয় এবং সে সঙ্গে বিশ্বের প্রথম গণতন্ত্র চালু হয় গ্রিসের ছোট একটি শহর-রাষ্ট্র এথেন্সে। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন উপজাতির মধ্য থেকে নেতাদের বেছে নেয়ার যে প্রচলিত রীতি চালু ছিলো, ক্লিসথেনিস তার অবসান ঘটান এবং তিনি মানুষের নতুন নতুন জোট তৈরি করে প্রতিটি ইউনিটকে ডিময় (Demo) অথবা প্যারিশ (Parish)-এ বিভক্ত করেন। মুক্ত নাগরিকদের রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে শহর-রাষ্ট্রের সরকার পরিচালনায় সরাসরি অংশগ্রহণের অধিকার দেয়া হয়। বস্তুত এ ঘটনাই গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার প্রারম্ভিক উন্মেষরূপে গণ্য করা হয়। নামকরণ করা হয় ডেমোক্রেশিয়া (Democratia) যার অর্থ হচ্ছে জনগণের (demos) শক্তি (Kratos)। অর্থ- জনগণের শাসন।

একথা সত্য যে, বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন উপায়ে এবং নানাবিধ পদ্ধতিতে গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ৪২২ সালে ক্লিয়ান ডেমোক্রেসিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে-‘That shall be the democratic which shall be the people, for the people. আরও বেশ পরে আব্রাহাম লিঙ্কন তার এক ভাষণে গণতন্ত্রের প্রায় অভিন্ন একটি সংজ্ঞা প্রদান করেন। যা বিশ্বের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে বেশ জনপ্রিয়। আব্রাহাম লিংকন (Abraham Lincoln) November ১৯, ১৮৬৩ তারিখে তার দেয়া Pennsylvania state এর গেটিসবার্গ বক্তৃতাতে (Gettysburg Address) গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দিয়ে বলেছিলেন, ‘Government of the the people, by the people, for the people.’ যার অর্থ দাঁড়ায়, গণতান্ত্রিক সরকার জনগণের, জনগণের দ্বারা ও জনগণের জন্য। কিন্তু দীর্ঘকালের পরিক্রমায় ও গণতন্ত্রের উত্থান-পতনে এর মৌলিকত্বের ক্ষেত্রে অনেকটাই ব্যত্যয় ঘটেছে। আর এটিকেই গণতন্ত্রের সঙ্কট হিসেবে আখ্যা দেয়া যায়।

বস্তুত বিগত এক দশকের অধিককাল ধরে বিশ্বজুড়ে বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোতে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ একেবারে প্রান্তসীমায় নেমে এসেছে। বিশেষ করে আমাদের দেশের গণতন্ত্র চর্চার প্রেক্ষাপটে তা আরও জটিল রূপ ধারণ করেছিলো। যা তাবৎ গণতন্ত্রপ্রিয় ও শান্তিকামী মানুষের কপালে রীতিমত ভাঁজ ফেলে দিয়েছে। কারণ, গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও জনগণের শাসন বলতে যা বোঝায় তা আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রায়ই উপেক্ষিত হয়ে আসছে। যদিও আধুনিক বিশ্বে প্রচলিত বিভিন্ন পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থার মধ্যে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাই অধিক জনপ্রিয় এবং বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রেই এই পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। একথাও ঠিক যে, এ পদ্ধতির শাসন পুরোপুরি ত্রুটিমুক্ত নয়। কিন্তু গণতন্ত্রের কুফলের চেয়ে সুফলই অধিক বলে মনে করা হয়। কিন্তু গণতন্ত্র সম্পর্কে মানুষের যথাযথ জ্ঞান, গণতন্ত্র মনস্কতার অভাব ও আত্মকেন্দ্রীকতা বিশেষত আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে মারাত্মক সঙ্কটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এ সঙ্কটটা আরও প্রবল।

সাম্প্রতিক বছরগুলো বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে যেভাবে গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে তাতে গণতন্ত্র কোন নির্দিষ্ট কেন্দ্রে কেন্দ্রীভূত থাকেনি বরং ক্ষেত্র বিশেষে তার রকমফেরও বেশ লক্ষণীয়। সঙ্গত কারণেই গণতন্ত্রের কোনো সর্বজনীন সংজ্ঞাও এখন খুঁজে পাওয়া বেশ দুস্কর হয়ে পড়েছে। কারণ, স্থান, কাল ও পাত্রভেদে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পার্থক্যের বিষয় জোরালোভাবেই দৃৃশ্যমান হচ্ছে। গণতন্ত্রের নামে স্থান করে নিয়েছে স্বেচ্ছাচারিতা, গণবিরোধীতা আত্মপুজা ইত্যাগি নানাবিধ গণতন্ত্র বিরোধী অনুষঙ্গ। সহজ ভাষায়, বিশ্বের তাবৎ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে বিস্তর ফারাকের বিষয়টি এখন রীতিমত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শুধু তাই নয় অনেক ক্ষেত্রে এর বিচ্যুতিটাও রীতিমত চোখে পড়ার মত। তাই গণতন্ত্রের সংজ্ঞার প্রশ্নটি এখন রাষ্ট্রবিজ্ঞানেও বহুল আলোচিত, সমালোচিত ও বিতর্কিত বিষয় হয়ে দেখা দিয়েছে। বিগত কয়েক দশক ধরে গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রায়ণ-বিষয়ক গবেষণা, আলোচনা, পর্যালোচনা ও পর্যবেক্ষণে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা ও গণতন্ত্রের প্রকৃতি নিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু ফলাফল আমাদেরকে কোন সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা দিতে পারেনি। ফলে গণতন্ত্রের ব্যাপ্তি, পরিসর ও অবয়ব একেবারে খোলাসা করা সম্ভব হয়নি বরং বিষয়টি নিয়ে কিছুটা হলেও ধোঁয়াশা রয়েছে।

চুলচেরা বিশ্লেষণে গণতন্ত্র বলতে জনগণের দ্বারা জনগণের শাসন বা স্বশাসনকেই বোঝায়। এর মাধ্যমে জনগণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিজেদেরকে শাসন করে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও একবিংশ শতাব্দীর সূচনার মধ্য দিয়ে বিশ্বে গণতন্ত্রের গ্রহণযোগ্যতা স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমান সময়ে গণতন্ত্র সবচেয়ে জনপ্রিয় শাসনব্যবস্থা এতেও কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্রের সংকট দেখা দিতে শুরু করছে এবং তা ক্রমবর্ধমানই বলতে হবে। গণতন্ত্রের বহু ত্রুটি-বিচ্যুতি বর্তমান সময়ে গণতন্ত্রমনা মানুষকে বেশ ভাবিয়ে তুলছে। গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগটি হলো এর মাধ্যমে জনরঞ্জনবাদী ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের চিন্তাধারাকে নানাভাবে প্রভাবিত করে নির্বাচনে জয়লাভ করে। বিষয়টি আমাদের দেশের জন্য বেশ যুৎসই বলতে হবে।

আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় গণতন্ত্র বলতে কেবল নির্বাচনকে ও জনগণের ভোটাধিকারকেই মনে করা হয়। কারণ, একটি নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্যসহ যে সকল বিশেষণে বিশেষায়িত করা যায়, তা কেবল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমেই নিশ্চিত করা সম্ভব। মূলত, গণতন্ত্রের সাফল্যের প্রথম এবং প্রধান শর্তটির নাম নাগরিকদের সুশিক্ষিত হিসেবে গড়ে তোলা; মানুষকে গণতন্ত্রমনা, চিন্তাশীল ও আত্মসচেতন হতে উদ্বুদ্ধ করা। গণতন্ত্রকে সফল ও সার্থক করতে আরো কয়েকটি শর্ত যেমন, রাজনৈতিক সচেতনতা, মানুষের অধিকার সচেতনতা, স্বাধীনতা, সাম্য, আইনের শাসন প্রয়োজন হলেও শিক্ষার সম্প্রসারণ ব্যতীত তা অর্জন সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে আমাদের দুর্বলতা বেশ প্রকট। এ বিষয়ে একজন মধ্যযুগীয় শাসকের অভিব্যক্তির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি জিজ্ঞাসিত হয়েছিলেন যে, তিনি তার রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার জন্য কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন ? তার সাদামাটা জবাব ছিল, তিনি তার দেশের প্রতিরক্ষার জন্য প্রভূত সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন। পাল্টা প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তার রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার জন্য কী কাজে আসবে ? তার ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ জবাব ছিলো, ‘জাতি শিক্ষিত হলেই তারা আত্মসচেতন হয়ে উঠবে। আর আত্মসচেতন মানুষই হলো রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষার সবচেয়ে শক্তিশালী অনুষঙ্গ’।

মূলত, শিক্ষাই একজন নাগরিককে পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাগুলো নিজ বিচার-বুদ্ধি দিয়ে অনুধাবন করার মাধ্যমে ত্যাগ, সহানুভূতি, স্বার্থহীনভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের সেবা, নিয়মানুবর্তীতা, কর্তব্য পরায়ণতা ও ভ্রাতৃত্ববোধে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। আর শিক্ষার মাধ্যমেই নাগরিকের মানসিক, নৈতিক ও মূল্যবোধের স্ফূরণ ঘটে। তাই গণতন্ত্রের জন্যও নাগরিকদের প্রস্তুত করতে শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি অনস্বীকার্য। বর্তমান সময়ের গণতন্ত্রের সাফল্যে বাধাসৃষ্টিকারী নানা সমস্যাসংক্রান্ত আলোচনায় শিক্ষার প্রসঙ্গটি অব্যক্ত ও অমূল্যায়িত থেকে যাচ্ছে। আসলে আমরা এখনও সমস্যার কেন্দ্রেই পৌঁছতে পারিনি। মূলত গণতন্ত্রের সঙ্কটটা সেখানেই।

প্রাচীন গ্রিসে প্লেটো ও এরিস্টটল গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ছিলেন। কারণ, ‘তৎকালীন গ্রিসে কেবল যোদ্ধা ও ভূমির মালিকদের নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হতো। এরা ছিল মোট জনসংখ্যার অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ। অন্যদের অধিকাংশই ছিল অশিক্ষিত। প্লেটো তার ‘Republic’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘প্রশাসন হলো এমন একটি কলা যা সাধারণ মানুষের দ্বারা অনুধাবন করা সম্ভব নয়। শুধু বুদ্ধিমান ও যোগ্য মানুষের পক্ষেই প্রশাসন অনুধাবন করা সম্ভব।’ বস্তুত একজন মানুষকে অসাধারণ, বুদ্ধিমান ও যোগ্য করে তুলতে শিক্ষার আলো সম্প্রসারণের কোন বিকল্প নেই। আর কোন সমাজ-রাষ্ট্রের মানুষকে শিক্ষা ও জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করা গেলেই কেবল সে সমাজ-রাষ্ট্রে গণতন্ত্র সহ সকল ইতিবাচক প্রচেষ্টাই সফল ও সার্থক হয়ে উঠবে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের প্রবক্তা জন স্টুয়ার্ট মিল গণতন্ত্রের প্রধান দু’টি শর্ত হিসেবে শিক্ষা ও উত্তম নৈতিক চরিত্রের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। মিল তার ‘Considerations on Representative Govement’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘জনগণের জন্য সার্বজনীন ভোটাধিকার নিশ্চিত করার পূর্বে সার্বজনীন শিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি।’

মূলত গণতন্ত্র বলতে কোনও জাতিরাষ্ট্রের এমন একটি শাসনব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে নীতিনির্ধারণ বা সরকারি প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রত্যেক নাগরিক বা সদস্যের সমান ভোটাধিকার থাকে। গণতন্ত্রে আইন প্রস্তাবনা, প্রণয়ন ও তৈরির ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের অংশগ্রহণের সমান সুযোগ রয়েছে। কিন্তু তা প্রত্যক্ষ নয় বরং পরোক্ষ। মূলত একটি সফল ও সার্থক গণতান্ত্রিক সমাজ স্বপ্নবাস্তবায়ন করতে হলে সুশিক্ষিত, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী এবং সমঝদার জনগোষ্ঠী আবশ্যকতার বিষয়টি উপেক্ষা করা যায় না।

আমরা গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সাম্য, আইনের শাসন ও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্যই এক সর্বাত্মক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার শর্তগুলো অপূরণীয় থাকায় স্বাধীনতার অন্যতম চেতনা ‘অবাধ গণতন্ত্র’ আজও আমাদের কাছে অধরাই রয়ে গেছে। অবৈধ ক্ষমতালিপ্সা ও নেতিবাচক রাজনীতিই এর অন্যতম কারণ। উল্লেখ করা দরকার যে, আমাদের দেশের প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থা গ্রহণযোগ্য ও সর্বজনীন করা সম্ভব হয়নি। দুর করা সম্ভব হয়নি নির্বাচনী ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলোও। এমনকি স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দীর পর কোন সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচন পদ্ধতিও আমরা তৈরি করতে পারিনি। রাজনৈতিক শক্তিগুলোও এ ক্ষেত্রে বড় ধরনের ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। কারণ, কোন রাজনৈতিক সরকারই জাতিকে কোন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে পারেনি। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ যতবারই ক্ষমতায় এসেছে ততবারই তারা দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তারাই দেশের সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দেশে একদলীয় বাকশালী শাসন কায়েম করেছিলো। এটিকে নির্বিঘœ ও স্থায়ীত্ব দেওয়ার জন্যই মাত্র ৪টি রাষ্ট্রায়ত্ত পত্রিকা বাদে সকল সংবাদপত্রকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিলো। মূলত, আওয়ামী লীগ দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ হত্যা করে দেশকে একটি অকার্যকর মাফিয়াতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলো। তারা ২০০৮ সালে সাজানো ও পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে অবাধ গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিল করে দেশকে নতুন করে সংকটে ফেলে দেয়। ফলে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিশেষ করে দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়নি বরং কথিত নির্বাচনের নামে যা হয়েছে তা বৈশি^ক গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকেই কলঙ্কিতই করেছে। ভোটারবিহীন এসব নির্বাচনে চলেছে ভোট ডাকাতির নিলর্জ্জ মহড়া। নির্বাচনগুলো একতরফা, নৈশকালীন ও ডামী নির্বাচন হিসাবেও আখ্যা পেয়েছে। কিন্তু তাদের শেষ রক্ষা হয়নি বরং ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মুখে আওয়ামী বাকশালীদের লজ্জাজনক পতন হয়েছে। তাদের শীর্ষনেতা সহ সকল নেতাই এখন স্বেচ্ছা নির্বাসনে। এটিকে ইতিহাসের নির্মম প্রতিশোধ বললে অত্যুক্তি হবার কথা নয়।

আগস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদীদের পতনের পর জাতীয় জীবনে এক নতুন আশাবাদের সৃষ্টি হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য উপয্ক্তু পরিবেশ সৃষ্টির প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ জন্য নতুন সরকার রাষ্ট্রের কাক্সিক্ষত ও প্রয়োজনীয় সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক অনৈক্যের কারণে তা মোটেই সহজসাধ্য হচ্ছে না। কোন কোন রাজনৈতিক শক্তি যেনতেনভাবে একটা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে চাইছে। কিন্তু একথা সকলের মনে রাখা উচিত, শুধুমাত্র একটা নির্বাচনের জন্য হাজার হাজার ছাত্র-জনতা রাজপথে প্রাণ বিসর্জন দেয়নি। তাদের স্লোগানই ছিলে ‘We want justice’.

তাই দেশে হারানো গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, আইনের শাসন, সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কার ও জুলাই গণহত্যাকারীদের দৃশ্যমান হওয়ার পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে নতুন করে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা শুরু করা দরকার। যেনতেনভাবে বা দায়সারা গোছের নির্বাচন জাতীয় সংকট নিরসনে মোটেই সহায়ক হবে না। তাই দেশের কক্ষচ্যুত গণতন্ত্রকে কক্ষপথে ফেরাতে এবং দেশে ন্যায়-ইনসাফের সমাজ প্রতিষ্ঠায় বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের কোন বিকল্প নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি হলে পতিতরা সে সুযোগ গ্রহণ করবে এবং একই সাথে জুলাই বিপ্লবের অর্জনও হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। যা কোনভাবেই কাম্য নয়।

আসলে আমরা গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকার নিয়ে অনেক লম্বা-চওড়া কথা বললেও নিজেরা যেমন গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠিনি, ঠিক তেমনিভাবে আমরা গণতন্ত্রমনাও নই। আর অন্তরে কদর্যতা নিয়ে শুধু গণতন্ত্র নয় বরং সুন্দর ও সুকুমারবৃত্তির চর্চা হয় না। একটি গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের জন্য আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য যে ধরনের হওয়া দরকার আমরা তার ধারের কাছেও নেই। মূলত শিক্ষা ক্ষেত্রে পশ্চাদপদতা, আত্মসচেতনা বিমূখতা, মূল্যবোধের সঙ্কট সর্বোপরি অবক্ষয়ের জয়জয়কারটাই আমাদের দেশের গণতন্ত্রকে মারাত্মক সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে। এজন্য বিশেষ গোষ্ঠীকে দায়ি করা যেমন সঙ্গত, ঠিক তেমনিভাবে জাতি হিসেবেও আমরা এ দায় এড়াতে পারি না। তাই দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই এ শুভ বৃত্ত থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা উচিত।