মো. মাঈন উদ্দীন
অর্থনীতির একটি প্রধান ভিত্তি টেক্সটাইল ও পোশাক শিল্প। বাংলাদেশের মোট রফতানি আয়ের প্রায় ৮৪ শতাংশ আসে এ শিল্প থেকে। দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে এ শিল্প। প্রায় ৪০ লাখের মতো মানুষ এ খাতে নিযুক্ত, যাদের অধিকাংশই নারী। ফলে নারীদের আর্থিক স্বাধীনতা বৃদ্ধি পায় এবং সামাজিক অবস্থানের উন্নতি ঘটে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্প দীর্ঘকাল ধরে সস্তা শ্রমের সঙ্গে হলেও শিল্পটি এখন সস্তা শ্রম থেকে নজর সরিয়ে উদ্ভাবন, টেকসই ও গুণমানের দিকে মনোনিবেশ করছে। কিন্তু এ শিল্প নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এখাতের বড় চ্যালেঞ্জ বিদ্যুৎ ও গ্যাস-সংকট। সে সঙ্গে অবকাঠামো, পশ্চাৎসংযোগ শিল্পের দুর্বলতা, নীতি সমন্বয়ে ঘাটতি, উৎপাদনশীলতায় দুর্বলতা ও উচ্চ উৎপাদন ব্যয় এ খাতের সক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে হলে আমাদেরকে পণ্য বৈচিত্র্য, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও নতুন বাজার সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে হবে। উৎপাদন কমায় মধ্যম ও ছোট অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বিজিএমইএর প্রায় ৭ হাজার ১০০ সদস্যের মধ্যে বর্তমানে ৩ হাজারেরও কম সদস্য রপ্তানিতে সক্রিয় রয়েছেন। বর্তমান বৈশ্বিক বাণিজ্য প্রেক্ষাপট পরিবর্তন আমাদের অর্থনীতির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বৃদ্ধি কিছু দেশের তুলনায় ভালো অবস্থানে থকলেও এতে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১ থেকে ২ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, পোশাক খাতে নিম্নমূল্য থেকে উচ্চমূল্যের পণ্যের দিকে যেতে হবে। এলডিসি থেকে উত্তরণ ও যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বৃদ্ধির কথা মাথায় রেখে এই খাতের উৎপাদনশীলতা ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বাংলাদেশি তৈরি পোশাক রপ্তানিতে একক বড় বাজার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এ বাজারে শীর্ষ ১০ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হচ্ছে ভিয়েতনাম, চীন, বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো, হন্ডুরাস, কম্বোডিয়া, পাকিস্তান ও কোরিয়া। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ৩১ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভিয়েতনামের মতো বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানিতে পাল্টা শুল্ক সংশোধন করে ২০ শতাংশ করেন। তার বিপরীতে চীনা পণ্যে এখন শুল্ক ৩০ শতাংশ। তবে ভারতের পণ্যে শুল্কের হার ২৫ শতাংশ, যা প্রতিযোগী দেশের চেয়ে তুলনামূলক বেশি। শুধু তা-ই নয়, রাশিয়ার জ্বালানি কেনার ‘অপরাধে’ ভারতের পণ্যে আরও ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন ট্রাম্প। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশী পোশাকের রপ্তানি বৃদ্ধি কিছুটা অনুকূল অবস্থানে থাকলেও উৎপাদন বৃদ্ধি ও প্রয়োজনীয় কাঁচামাল প্রাপ্তিতে সহজীকরণ প্রয়োজন। রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাতের কয়েকজন উদ্যোক্তার ভাষ্যমতে গত দুই সপ্তাহে মার্কিন ক্রেতাদের কাছ থেকে বাড়তি ক্রয়াদেশের অনুসন্ধান আসছে। আগের স্থগিত হওয়া ক্রয়াদেশও ফিরতে শুরু করেছে। তবে যারা দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন ক্রেতাদের কাজ করছে, তাদের কাছেই এখন বেশি অনুসন্ধান আসছে। এটা একটা ভাল লক্ষণ। ক্রেতাদের চাওয়া ও তাদের চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে সম্পর্ক উন্নয়ন ও সময়মত পণ্য সরবরাহ করতে হবে। উৎপাদক দেশের পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আরোপ বাজারে অবশ্যই একটি বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। এ শুল্ক ভোক্তারা কতটুকু গ্রহণ করে, সেটি দেখার বিষয়।
ভোক্তারা যদি শুল্কের বিষয়টি ভালোভাবে মানিয়ে নিতে পারে, তাহলে আশা করি ক্রয়াদেশ বাড়বে। সূত্র থেকে দেখা যায়, প্রকাশিত খবরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের ৮৬ শতাংশের বেশি তৈরি পোশাক। এ দেশে গত অর্থবছর রপ্তানি হয়েছে ৭৫৪ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক। চ্যালেঞ্জর মধ্যে আশার দিক দেখা যাচ্ছে। পত্রিকায় জানা যায়, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ৩৪টি চীনা বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে বিনিয়োগ প্রস্তাব পেয়েছে বেপজা। গত জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত আটটি চীনা প্রতিষ্ঠান শিল্প স্থাপনের লক্ষ্যে বেপজার সঙ্গে চুক্তি করেছে। তাদের প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ ১৫ কোটি ডলার। এসব কোম্পানি তৈরি পোশাকের পাশাপাশি ব্যাগ, হালকা প্রকৌশল পণ্য ইত্যাদি উৎপাদন করবে।দেশে বিদেশী বিনিয়োগ কারিদের আগ্রহ বিশেষ করে চীনা বিনিয়োগ আসা খুবই ইতিবাচক। কারণ, তারা বিনিয়োগ করার পাশাপাশি ক্রেতাও নিয়ে আসবে। এতে আমাদের রপ্তানি বাড়বে।
প্রতিযোগী দেশ ভারতের তুলনায় শুল্ক কম হওয়ায় আমরা সুবিধাজনক অবস্থান রয়েছি। তবে বাড়তি ক্রয়াদেশ নিতে হলে ব্যাংকের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ ও কাস্টমসের সহযোগিতা লাগবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে আগামীতে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ও বাণিজ্যনীতির পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে গত পৌণে দু’বছর ধরে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি কমছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি হয়েছিল ২০৭ কোটি ডলারের, অক্টোবর ডিসেম্বর প্রান্তিকে তা কমে রপ্তানি দাঁড়ায় ১৯৭ কোটি ডলার, জানুয়ারি মার্চ প্রান্তিকে আবার সামান্য বেড়ে দাঁড়ায় ২১৬ কোটি ডলার, এপিল জুন প্রান্তিকে আবার কমে দাঁড়ায় ১৭৩ কোটি ডলারে। গত অর্থবছরের জুলাই সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ১৮৫ কোটি ডলার, অক্টোবর ডিসেম্বর প্রান্তিকে ১৯৯ কোটি ডলার, জানুয়ারি মার্চ প্রান্তিকে ১৯০ কোটি ডলার ও এপ্রিল জুন প্রান্তিকে ১৮১ কোটি ডলার পণ্য দেশটিতে রপ্তানি হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, গড় হিসাবে গত পৌণে দু’বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানি কমছে। এ পরিস্থিতিতে মোটা দাগে কিছু চ্যালেঞ্জ ও এর উত্তরনের কথা না বলে পারছিনা।
১. চ্যালেঞ্জসমূহ যেমন :
ক. বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতা : ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, মায়ানমার, ইথিওপিয়ার মতো দেশগুলো কম খরচে এবং উন্নত প্রযুক্তি দিয়ে উৎপাদন করছে। ক্রেতারা (buyers) কম দামে ও দ্রুত ডেলিভারি চাচ্ছে।
খ. শ্রমিক কল্যাণ ও মজুরি : শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, কর্মপরিবেশ ও সুরক্ষা নিয়ে বিরোধ রয়েছে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা “compliance” না থাকলে অর্ডার বাতিল করে।
গ. জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকট : গ্যাস-বিদ্যুতের ঘাটতি উৎপাদন ব্যাহত করছে। আমাদের দেশে
বিকল্প শক্তি ব্যবহারের সুযোগ সীমিত।
ঘ. কাঁচামাল নির্ভরতা : তুলা, কাপড়, রং-রাসায়নিকের জন্য আমদানির উপর আমরা অতিরিক্ত নির্ভরশীল। বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে আমদানি ব্যাহত হচ্ছে।
ঙ. পরিবেশগত চাপ : ডাইং-প্রিন্টিং কারখানার বর্জ্য পানিদূষণ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। টেকসই (sustainable) উৎপাদনের দাবি ক্রমশ বাড়ছে। অথচ এক্ষেত্রে প্রস্তুতি কম।
চ. মুদ্রা বিনিময় হার ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ঝুঁকি ডলারের ওঠানামা, বৈশ্বিক মন্দা ও যুদ্ধের প্রভাব। পোশাক খাতের বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ সমূহ উত্তরনের পথ বের করতে হবে। এতে সরকার ও রপ্তানিকারকদের দায়িত্ব রয়েছে। যেমন :
ক. পণ্যের বৈচিত্র্য ও মূল্য সংযোজন : শুধু টি-শার্ট, জিন্স নয়-উচ্চমূল্যের ফ্যাশন পোশাক, স্পোর্টসওয়্যার, টেকনিক্যাল টেক্সটাইল উৎপাদন নয় বরং নিজস্ব ব্র্যান্ড ও অনলাইন রপ্তানি বাজার (e-commerce, B2C) গড়ে তোলতে হবে
খ. প্রযুক্তি ও দক্ষতা উন্নয়ন : অটোমেশন, ডিজিটাল ডিজাইন, 3D স্যাম্পলিং, AI-ভিত্তিক প্রোডাকশন পরিকল্পনা গ্রহণ পাশাপাশি শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন বৃদ্ধি করতে হবে।
গ. পরিবেশবান্ধব উৎপাদন : গ্রীন ফ্যাক্টরি, পানি পুনঃব্যবহার, LEED সার্টিফিকেশন অর্জন করে আন্তর্জাতিক বাজারে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
ঘ. শ্রমিক কল্যাণ ও সামাজিক দায়বদ্ধতা : ন্যায্য মজুরি, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
কর্মক্ষেত্রে নারী কর্মীদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা।
ঙ. কাঁচামালের দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি : স্পিনিং, উইভিং, ডাইং সেক্টরে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
তুলা চাষ, সিনথেটিক ফাইবার উৎপাদনে নজর দিতে হবে।
চ. বাজার সম্প্রসারণ : ইউরোপ-আমেরিকার পাশাপাশি জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, লাতিন আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে প্রবেশ করতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে।
আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তি (FTA, PTA) কাজে লাগানো যেতে পারে।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে প্রযুক্তি, টেকসই উৎপাদন, দক্ষ শ্রমশক্তি ও বাজার বৈচিত্র্যের উপর। সঠিক নীতি, বিনিয়োগ এবং শ্রমিক-মালিক-সরকারের সমন্বিত প্রচেষ্টায় এই শিল্পকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করা সম্ভব।
লেখক : ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক।