গত ১৯ এপ্রিল সরকার গঠিত নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন সর্বস্তরে নারীর প্রতি বৈষম্য দূরীকরণ এবং নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতা আনয়নের লক্ষ্যে তাদের সুপারিশ সংবলিত ১৯৫ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নিকট পেশ করেছেন। বলাবাহুল্য এর আগে সরকার নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরীন পারভীন হককে প্রধান ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভার্নেন্স-এর ফেলো মাহীন সুলতান, নারীপক্ষের পরিচালক ও আইনজীবী কামরুন্নাহর, ফাউন্ডেশন ফর ল’ এন্ড ডেভেলপমেন্ট-এর সভাপতি এডভোকেট ফৌজিয়া করিম ফিরোজ, গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার, নারী ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হালিদা হানুম আক্তার, বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরুপা দেওয়ান, জেন্ডার ও সামাজিক উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ফেরদৌসি সুলতানা বেগম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিশ্চিতা জামান নিহাকে সদস্য করে এ কমিশন গঠন করেন। কমিশনের দীর্ঘ সংস্কার প্রস্তাবে যেসব সুপারিশ সন্নিবেশিত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে উত্তরাধিকার আইনে নারী-পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা, কৃষি ও মৎস্য খাতে নারীদের স্বীকৃতি প্রদান এবং যথাযথ পারিশ্রমিকের ব্যবস্থাকরণ, বিবাহ, তালাক ও উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে মুসলিম আইনের পরবর্তী ইউনিফর্ম সিভিল কোডের প্রবর্তন, যৌনকর্মী তথা গণিকাবৃত্তিতে নিয়োজিত মেয়েদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি, ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অনুমতি প্রদান প্রভৃতি। ইতোমধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও আলেম সমাজের তরফ থেকে সংস্কার প্রস্তাবগুলোকে ইসলামবিরোধী আখ্যায়িত করে কঠোর প্রতিবাদ করা হয়েছে।
নারী বিষয়ক সংস্কার প্রস্তাবগুলো বিস্তারিতভাবে পড়ার এবং এ সংক্রান্ত আলোচনাগুলো দেখার আমার সুযোগ হয়েছে। এসব আলোচনাসমূহের যে দিকটি আমার কাছে পীড়াদায়ক মনে হয়েছে সেটি হচ্ছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিজেদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অনুপস্থিতি এবং নারী-পুরুষ উভয়কে পরস্পর পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উপস্থাপন। পরিবার হচ্ছে সমাজের ভিত্তি। স্বামী নিয়ে পরিবার গঠিত হয় এবং ধর্মীয় অনুশাসন মেনে। আমরা তা করি। আন্তঃধর্ম বিয়ে আমাদের দেশে নেই বললেই চলে। এজন্য বৃটিশরা সিভিল ম্যারেজের পদ্ধতি চালু করেছে যাতে ধর্মের বালাই নেই। যে পরিবারে ধর্মীয় অনুশাসনের বালাই নেই, নারী-পুরুষের মধ্যে ধর্ম প্রদত্ত মর্যাদা ও অধিকার এবং সামাজিক কুপ্রথা ও কুসংস্কার বিদ্যমান, সে পরিবার বঞ্চনার শিকার। এক্ষেত্রে ইউনিফরম সিভিল কোড বা জেন্ডার ইকুইটির কোনো ধারণা কার্যকর ও ফলপ্রসূ হতে পারে না। এখন বাস্তব কিছু আলোচনায় ফিরে আসি।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে মহিলাদের ভূমিকা নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে বিতর্ক চলছে। বিশেষ করে আমাদের দেশে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে মহিলাদের সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে বিভিন্ন মহল থেকে জোর দাবি উঠছে। নারী অধিকার পুনরুদ্ধারের নামে পরিচালিত বিভিন্ন সংগঠনের তরফ থেকে মেয়েদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের অবসান এবং পুরুষদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জাতীয় উন্নয়ন ও সকল পর্যায়ে মেয়েদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার ব্যাপারে বহু দাবি উত্থাপিত হচ্ছে। পুরুষদের মোকাবিলায় মেয়েদের সমান অধিকার এবং কাজকর্মের সমান সুযোগ-সুবিধার দাবি উত্থাপিত হচ্ছে। বলা হচ্ছে, আমাদের সমাজের যেখানে অর্ধেকই নারী সেখানে তাদের বাদ দিয়ে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন কোনোটাই সম্ভব নয়। দেশকে যদি সত্যিকার অর্থে অগ্রগতির পথে নিয়ে যেতে হয় তাহলে ছেলেমেয়েদের বৈষম্য অবশ্যই দূর করতে হবে এবং উন্নত দেশগুলোর অনুকরণে সমাজব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে।
মহিলাদের নিয়ে এ ভাবনা দীর্ঘদিনের হলেও সাম্প্রতিককালে তা একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ করেছে। বিংশ শতাব্দীর বর্তমান দশকে Gender issue in development নামে পাশ্চাত্যের দেশগুলো তাদের চিন্তাচেতনাকে বিশ্বের উন্নয়নকামী দেশগুলোতে ছড়িয়ে দিয়েছে। এ ঢেউ আমাদের দেশেও এসে লেগেছে। ডোনারদের পয়সায় স্থানীয় বুদ্ধিজীবী, আমলা ও কিছু কিছু জিও, এনজিও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে মহিলাদের অংশগ্রহণের সমস্যা এবং সেগুলো সমাধানের পন্থা নির্ধারণের উদ্দেশে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও কর্মশিবিরের আয়োজন করছে। এসব সভা, সেমিনারের আলোচ্য বিষয়গুলো পর্যালোচনা করলে মনে হয় যেন আমাদের দেশের মেয়েরা কোনো কাজই করে না এবং উন্নয়নে তাদের কোনো ভূমিকাই নেই। উন্নয়নে তাদের পুরুষদের অংশীদার করতে হলে অফিস-আদালত, কল-কারখানা, কৃষি, শিল্প সর্বত্র তাদের অবাধ নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনবোধে পাশ্চাত্যের ধাঁচে পরিবার ও বিবাহ ব্যবস্থারও উচ্ছেদ সাধন করতে হবে। আমাদের যে পরিবার ব্যবস্থা ও বিবাহ প্রথা, তাকে উদ্যোক্তা বুদ্ধিজীবী ও সংস্থার তরফ থেকে অনেকেই উন্নয়নের প্রতিবন্ধক হিসেবে চিহ্নিত করে মেয়েদের স্বার্থবিরোধী বলে আখ্যায়িত করছেন।
আমার সামনে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব লোকাল গভর্নমেন্ট নামক একটি সরকারি সংস্থার গবেষণা বিভাগের পরিচালক জনৈকা সাঈয়েদা রওশন কাদিরের লেখা ‘Role and Functiong of Women members of Union parishad: Problems and Potentials’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ রয়েছে। উন্নয়নে মহিলাদের ভূমিকা ও তার পথে বিরাজিত সমস্যাবলীর আলোচনা করতে গিয়ে তিনি এক জায়গায় লিখেছেন- “The Patrichial Social system and institution of purdah, marriage and religious bindings place them in unequal and disadvantaged positions. The negative attitude of the society towards women by the society along with other socio- cultural factors lead them to cyclical dependence and subjugation”
অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছেন যে, পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পর্দা, বিয়ে প্রথা এবং ধর্মীয় বিধি-বিধান মেয়েদের একটি অসম ও অসুবিধাজনক অবস্থানে নিক্ষেপ করে। মেয়েদের প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি অপরাপর সামাজিক সাংস্কৃতিক সমস্যার সাথে একত্রিত হয়ে মেয়েদের চক্রাকারে পরনির্ভর ও বশীভূত করে রাখে। শুধু রওশন কাদিরের ন্যায় একজন দায়িত্বশীলা ও সরকারি কর্মকর্তা নয়, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন, বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানসমূহের অনেক কর্মকর্তাকে সাম্প্রতিককালে আমি পর্দা ও বিবাহ প্রথা এবং ধর্মীয় অনুশাসনকে মহিলাদের উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত করতে দেখেছি। তথাকথিত নারী আন্দোলনের প্রবক্তাদের কথা নাইবা উল্লেখ করলাম। তাদের এমন প্রবণতা দেখে মনে হয়, পরিবার ও বিবাহ প্রথার উচ্ছেদ সাধন করলেই যেন নারী স্বাধীনতা এবং উন্নয়নে নারীদের অংশগ্রহণসহ তাদের মর্যাদা ‘পুনঃপ্রতিষ্ঠিত’ হবে।
অনেকেই লক্ষ্য করে থাকবেন, আমাদের দেশে সাম্প্রতিককালে দুটি ইস্যু সর্বত্র আলোচনায় অগ্রাধিকার পাচ্ছে। এর একটি হচ্ছে Gender issue আর একটি হচ্ছে পরিবেশ। রিও সম্মেলনের পর এ দেশে পরিবেশ উন্নয়নের নামে বহু সংগঠন রাতারাতি গড়ে উঠে এবং সভা-সেমিনার ও প্রকাশনাসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের নামে প্রকল্প তৈরি করে তাদের অনেকেই টু পাইস রোজগারে সমর্থ হচ্ছে। আবার Gender issue টিও আন্তর্জাতিক বাজারে হট কেকের মতো বিক্রি হচ্ছে। ইস্যুটির উপর বিদেশী ডোনার এজেন্সীগুলো প্রচুর টাকা কড়ি ঢালছেন।
উন্নয়নে মহিলাদের অংশগ্রহণের বিষয়টি যখনই আসে তখনই স্বাভাবিকভাবে একটি আবেগ এসে পড়ে। আবার এর তাত্ত্বিক আলোচনায় Value judgement-এর বিষয়টিকেও বাদ দেয়া যায় না। শহরে আমরা যারা মহিলাদের কাজ নিয়ে মাথা ঘামাই এবং উন্নয়নে তাদের অংশীদার করতে চাই তারা একটা বিষয় স্বীকার করতে চাই না যে, মহিলারাও আসলে কাজ করছেন। গ্রামে গিয়ে দেখুন। রান্নাবান্না, সন্তান পালন, সময়মতো তাদের বিদ্যালয়ে প্রেরণের ব্যবস্থা করা, ঘর-সংসার গোছানো, গোয়াল ঘর পরিষ্কার, হাঁস-মুরগি পালন, গরু-ছাগল পোষা, ফসল মাড়াই ও পরিষ্কার করা এবং ঘরে তোলা, ধান সিদ্ধ করা ও শুকানো, বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ি, ভাই বোন ও স্বামীর খেদমত, ছেলেমেয়ে ও রোগীর পরিচর্যা, আত্মীয়-স্বজন ও অভ্যাগতদের মেহমানদারী-কাকডাকা ভোর থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত এমন কোন কাজ নেই যা তারা করছেন না। শুধু গ্রাম কেন? শহরের মেয়েরা কি কাজ করছেন না? আমরা কি তাদের এসব কাজের স্বীকৃতি দেই? তাদের কাজগুলো যদি উৎপাদনমূলক কাজ হয়ে থাকে তাহলে দেশের জিডিপিতে কি তার প্রতিফলন ঘটে? আমি জানি এবং পাঠক পাঠিকারাও নিশ্চয়ই জানেন তা ঘটে না।
Emotion এবং value judgement-এর কথা আগেই উল্লেখ করেছি। উন্নয়নে মহিলাদের ভূমিকা সংক্রান্ত বিষয়টি এদেশে নতুন নয়। যদিও অনেকের হাবভাব দেখে মনে হয়, পৃথিবীতে এবারই প্রথম আমরা মহিলাদের নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছি। আমাদের দেশে ও সমাজে ইতিপূর্বে আরও অনেক মহীয়সী মহিলা ছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কি তাদের ধারা বজায় রেখে কথা বলছি? কোন ইস্যুর যদি কেউ সুষ্ঠু সমাধান চান তাহলে বিষয়টি অভ্যন্তরীণ ক্রিয়াকলাপ থেকে অবশ্যই উৎসারিত হওয়া বাধ্যতামূলক, বাইরে থেকে হলেও তাকে আত্মস্থ করতে হয়।
উন্নয়নে মহিলাদের ভূমিকাকে যে আঙ্গিকে উত্থাপন করা হচ্ছে তার শতকরা একশত ভাগ আমদানিকৃত। আলোচনা সেমিনার কর্মশালা ইত্যাদির প্রাধান্য বা একচেটিয়াত্বের কারণে তাকে আমরা আত্মস্থ করতে পারছি না। একটি আন্তর্জাতিক ঢেউ এসেছে গতানুগতিকভাবে তাতে আমরা গা ভাসিয়ে দিচ্ছি বলে মনে হয়। অবশ্য গত কয়েক দশকে এ ধরনের বহু ঢেউ আমরা দেখেছি।
মেয়েদের প্রশ্ন যখনই আসছে তখনই উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে। উন্নয়ন অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে অনেকে অবশ্যই জানেন অর্থনীতি হচ্ছে একটি সামাজিক বিজ্ঞান। এর সম্পর্ক হচ্ছে মানুষের সাথে এবং সে তার অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের ন্যায় বস্তুগত চাহিদা, শিক্ষা, জ্ঞানার্জন এবং আত্মিক উন্নয়নের ন্যায় বস্তু-বহির্ভূত চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে যে জীবন ব্যবস্থার ভিত্তিতে নিজের কাজ-কর্মকে সংগঠিত করে তার সাথে। জড় বিজ্ঞানের ন্যায় অর্থনীতির মত একটি সামাজিক বিজ্ঞানের বেলায় বৈজ্ঞানিক সূত্র এবং স্বতঃসিদ্ধ বলে কিছু নেই। অর্থনীতিতে ঝোঁক প্রবণতা থাকতে পারে। তাও স্থান, কাল ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ভেদে বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে। অবশ্য বদ্ধ ধারণাভিত্তিক তথাকথিত বহু সাধারণ অর্থনৈতিক মডেল রয়েছে যেগুলোর সাথে উন্নয়নশীল অর্থনীতির বাস্তবতার সাথে হয় আদৌ কোন সম্পর্ক নেই অথবা যে সম্পর্ক আছে তা অত্যন্ত নিম্নস্তরের। নৈতিক কিংবা আদর্শিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোনটা কাম্য এবং কোনটা কাম্য নয় তা বিবেচনা করাই হচ্ছে সাধারণভাবে অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা এবং বিশেষভাবে উন্নয়ন অর্থনীতির মূল বৈশিষ্ট্য।
মাইকেল পি টডারো তাঁর 'Economic Development in the Third world পুস্তকে একাধিকবার এ কথারই প্রতিধ্বনি করেছেন এবং বলেছেন, “মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ এবং জীবনাদর্শকে বাদ দিয়ে উন্নয়নের কোন মডেলই সত্যিকার অর্থে কোন জাতিকে অগ্রগতির দিকে নিয়ে যেতে পারে না, এটা বাস্তবসম্মত নয়।”
আজকাল সর্বত্র একটা কথা শুনা যায়, সেটা হচ্ছে : articipatory development অর্থাৎ জনগণের অংশগ্রহণভিত্তিক উন্নয়ন। একে অনেকে Community approach ভিত্তিক উন্নয়নও বলে থাকেন। বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যে মূল্যবোধে বিশ্বাস করে যে জীবনাদর্শকে সামনে রেখে বাঁচে এবং মরে তাকে বাদ দিয়ে উন্নয়ন হয় না। এই মূল্যবোধ ভেঙে দিয়েও উন্নয়নের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন সম্ভবপর নয়। এ প্রসঙ্গে ১৯৭৩ সালের ২৩শে এপ্রিল থেকে ২৫শে এপ্রিল পর্যন্ত সান্টিয়াগোতে অনুষ্ঠিত তৃতীয় বিশ্বের সমাজ বিজ্ঞানীদের সম্মেলনে গৃহীত ১৫ দফা ঘোষণার তৃতীয় ও চতুর্থ দফার প্রতি আমি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। এতে বলা হয়েছে :
- In the field of ideas, the Third world has frequently lived with concepts of development, with performance criteria and with economic strategies. which were often externally conceived and largely inappropriate.
- It is time that the intellectuals of the Third world
reexamine the established development strategies more relevant to their own needs :- Which extend beyond material progress to integrate the cultural and social value of
their societies. - Which reflect a creative interaction between indigenous thinking and
external experience and which are based on appropriate technology and financed largely by indigenous resources.'
সংক্ষেপে এর অর্থ হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে প্রায়শ: উন্নয়নের ধ্যান-ধারণা, সাফল্যের মাপকাঠি এবং এমন সব আর্থিক কলাকৌশল গ্রহণ করতে হয়েছে যেগুলো বাইরের তৈরি এবং সংশ্লিষ্ট দেশে বাস্তবায়নের অযোগ্য। নিজ দেশের চাহিদাকে ভিত্তি করে উন্নয়ন কৌশল পরীক্ষা-নিরীক্ষান্তে তৃতীয় বিশ্বের বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে একটি উপযুক্ত পন্থা উদ্ভাবনের সময় এসেছে। এ পন্থা বৈষয়িক অগ্রগতিকে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের সাথে একত্রিত করবে, দেশজ চিন্তা এবং বিদেশী অভিজ্ঞতার সৃজনশীল মিলন ঘটাবে। এর ভিত্তি হবে লাগসই প্রযুক্তি এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে তার অর্থ চাহিদার বৃহদাংশ পূরণ করা হবে।
উন্নয়ন অর্থনীতির মৌলিক চাহিদা এবং উপরোল্লিখিত সান্টিয়াগো ঘোষণাটি সামনে রেখেই যারা মহিলাদের সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করছেন তাদের উদ্দেশ্যে কয়েকটি কথা বলতে চাই। যেকোনো নতুন সামাজিক প্রকল্পের ক্ষেত্রে Social Compatibility প্রারম্ভিক বিষয়। যে সমাজের জন্য এ প্রকল্প তার সাথে তা কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ ও কতটুকু সহনশীল করা যাবে তা ভেবে দেখা অবশ্যই প্রয়োজন। প্রত্যেক সমাজের একটা নিজস্ব মূল্যবোধ আছে। আপনি আপনার নিজস্ব Value Judgement করে অন্যদের অসভ্য বলে অভিহিত করে সভ্য বানাতে যাওয়া ঠিক হবে না। তাদের মূল্যবোধকে আহত করবেন না। মানবতা-স্বীকৃত পন্থা এটি নয়। পাশ্চাত্য সভ্যতা বিয়ার, হুইস্কি, স্যাম্পেইন, লিভ টুগেদার প্রভৃতি না হলে চলে না। কিন্তু আমরা কি আমাদের সমাজে এগুলোকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারব? আমরা যদি কাউকে Social totality থেকে আলাদা করে ফেলতে চাই তাহলে সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে কি না তা ভেবে দেখতে হবে। না হলে বিচার-বিবেচনা করে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে এগুতে হবে। নতুবা ভালো করতে গিয়ে সমাজকে ধ্বংসের দিকেই নিয়ে যাব।
নদী বিশেষজ্ঞদের একটি হুঁশিয়ারি আছে এবং তা হচ্ছে, নদী নিয়ে খেলবেন না, আপনি জানেন না, একস্থানে বাঁধ দিয়ে এক হাজার একর উদ্ধার করলে অন্য স্থানে সে পাঁচ হাজার একর নিয়ে যেতে পারে।
নদী থেকে শত সহস্র গুণ জটিল সমাজ এবং সামাজিক প্রক্রিয়া। সমাজ নিয়ে খেলার বিপদ অনেক বেশি। উন্নয়নে মহিলাদের ভূমিকা সম্পর্কে আমরা এমন একটি ভাব নিয়ে আলোচনা করি যেন এদেশের মহিলারা নির্বোধ, তাদের অবদান নেই। প্রত্যেক সমাজে তাদের ভূমিকা আছে, স্বীকৃতি আছে। এখানে নতুন করে মহিলাদের ভূমিকা শেখানো হচ্ছে।
আমাদের দেশের মা-বোনেরা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সবচেয়ে বেশি জড়িত আছেন, নতুন করে শেখানোর আগে আমাদের বর্তমানকে আমরা ভাষা দেই না কেন। তারা যা করছেন তাকে অর্থনৈতিক ভাষায় রূপান্তরিত করলে জি.ডি.পি এ পর্যায়ে থাকে না। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, কোনো কাজই মূল্যহীন নয়। তা সন্তান পালন, রান্নাবানা ও গৃহস্থালির কাজ, শ্বশুর-শাশুড়ি ও স্বামী সেবা কিংবা ফসল তোলা যাই হোক না কেন।
আমাদের দেশে বর্তমানে মহিলা উন্নয়নের যে ধারা চলছে তা আদৌ উন্নয়নের সহায়ক কিনা তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। এ সম্পর্কে আমাদের যাবতীয় আলোচনা সমাজ ও পরিবার বিচ্ছিন্ন বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়। পরিবার সমাজের ভিত্তি। পুরুষ, মহিলা মিলিয়ে পরিবার, Gender issue-এর নামে আমরা পুরুষদের পেছনে মেয়েদের এবং মেয়েদের পেছনে পুরুষদের লেলিয়ে দিচ্ছি এবং পরস্পর পরস্পরকে শত্রু ভাবাপন্ন করে তুলছি। এর পরিণতি কি আমরা কখনো ভেবে দেখেছি?
পরিবারকে বিসর্জন দিয়ে পাশ্চাত্য সমাজ বর্তমানে কান্নাকাটি করছে। তারা এমনও বলছে, পরিবারকে অখণ্ড রাখতে হলে দু’জনে চাকরি করলে চলবে না। একজনকে চাকরি সেক্রিফাইস করতে হবে। আসলে একজনকে দুর্গ পাহারা দিতে হবে। তারা যেখানে ফিরে আসতে চাচ্ছে আমরা তো সেখানে যুগ যুগ ধরে আছি। আমাদের সমাজ মূল্যবোধ ও পারিবারিক শৃঙ্খলার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এমন ধরণের ধ্যান-ধারণা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে মহিলাদের ক্রস ফায়ারিং-এর মধ্যে আনার যারা চিন্তা-ভাবনা করেন তারা মহিলাদের অন্য কিছু হতে পারেন কিন্তু বন্ধু নিশ্চয়ই নন।
আমরা যে জীবনব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অধিকারী তাতে মহিলাদের স্থান এবং অধিকার সম্পর্কে দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা রয়েছে। বারান্তে সেগুলো সম্পর্কে আলোচনার প্রত্যাশা নিয়ে আজকের আলোচনার সমাপ্তি পর্বে আমি এটুকুই বলব যে, যারা অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বলেন এবং মহিলাদের তাতে সম্পৃক্ত করতে চান, সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক থিওরি ও তার বৈশিষ্ট্যের পথ ধরেই তাদের অগ্রসর হওয়া উচিত। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও মনে করি, জনসংখ্যার অর্ধেককে বাদ দিয়ে উন্নয়ন চিন্তা অবান্তর। তবে অনেকের ন্যায় আমি একথা বিশ্বাস করি না যে, বর্তমানে মহিলা কিছুই করছেন না। আমি মনে করি মহিলাদের ভূমিকা মহিলা হিসেবেই সার্থক হতে পারে। তাদের পুরুষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে নয়। পুরুষের প্রতিযোগী বানিয়েও তাদের মর্যাদা ও অধিকার পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টা সফল হতে পারে না।
আমি আগেই বলেছি, নারী অধিকারের কথা বলতে বলতে পাশ্চাত্য জগৎ এখন নারীদের মাতৃত্ব ও সম্ভ্রম উভয়টাই হারিয়েছে। আমরাও এখন কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছি তার একটা উদাহারণ দিয়ে আজকের আলোচনা শেষ করতে চাই। গত দু’সপ্তাহ আগে আমি আমার হোয়াটসঅ্যাপে দুটি ম্যাসেজ পাই। একটি পাঠিয়েছেন একটি অনলাইন ডেটিং কোম্পানি থেকে জনৈকা সুক্সিতি। ম্যাসেজটা হচ্ছেÑ ‘আপনি কি হাই প্রোফাইল ম্যাডামদের সাথে ঘোরাফেরা, বন্ধুত্ব করা, ভিডিও ও অডিও কলে কথা বলা এবং শারীরিক সম্পর্ক তৈরি করতে ইচ্ছুক আছেন? যদি থাকেন তাহলে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করছি।’ আরেকটি ম্যাসেজ হচ্ছে-একটি ভিডিও ম্যাসেজ। এটাও সত্যি তারার তিমির নামক একটি অনলাইন ডেটিং কোম্পানি থেকে প্রেরিত রাইসা নামক এক মহিলার। এতে বলা হয়েছে তারা শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে সেবা দানের জন্য একটি কোম্পানি গঠন করেছে। এতে তারা চাহিদা অনুযায়ী বিবাহিতা (স্বামী প্রবাসী) অথবা স্বামী পরিত্যক্তা, বিধবা ও ডিভোর্স এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অবিবাহিতা মেয়েদের প্রতি সপ্তাহে সংশ্লিষ্ট মহিলার বাড়িতে অথবা উপযুক্ত স্থানে দু’বার সরবরাহ করেন। শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য প্রথমোক্ত মহিলারা তার পুরুষ সঙ্গীকে ২-৩ ঘণ্টার জন্য ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা সম্মানি দেন। অবিবাহিতরা কোনো পারিশ্রমিক দেন না। তবে শর্ত হচ্ছে সংশ্লিষ্ট ইচ্ছুক ব্যক্তিকে ৬ মাস মেয়াদের জন্য ১০৩০/- টাকা পরিশোধ করে কোম্পানির সদস্যপদ নিতে হবে। কৌশলগত কারণে হোয়াটসআপ নংগুলো উল্লেখ করলাম না।
চিন্তা করে দেখুন, বাংলাদেশের মতো একটি মুসলিম দেশের অবনতি কোথায় গিয়ে ঠেকেছে? এখানে প্রকাশ্যে কোম্পানি খুলে পতিতাবৃত্তির ব্যবসা শুরু হয়ে গেছে। শিশু, কিশোর, যুবক, পৌঢ়, বৃদ্ধ এমন গযব থেকে কতজন রক্ষা পাবে? দুনিয়ার অনেক দেশে ফেসবুক ও সোস্যাল মিডিয়ার অনেকগুলো এ্যাপ ব্যবহার করা হয় না, হলেও নৈতিক মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে নয়। দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে চীন, ইরান, উত্তর কোরিয়া, তুর্কমেনিস্তান, মিশর, সৌদি আরব, তুরস্ক, ব্রাজিল, কিউবা, ইরিত্রিয়া, রাশিয়া, আরব আমিরাত প্রভৃতি। আমরা কি নারী উন্নয়নের নামে পাশ্চাত্যের বিষাক্ত বড়ি না গিলে আমাদের ধর্ম-কৃষ্টির আলোকে নারীদের মর্যাদা প্রদান ও তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধ করা ও প্রাপ্য অধিকার ফিরিয়ে দিতে পারি না? (চলবে)।