অবশেষে তথাকথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে খালাস পেয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সর্বসম্মত রায়ে গত ২৭ মে তার বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ থেকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। একই সাথে তিনি ২৮ মে রাজধানীর শাহবাগস্থ পিজি হাসপাতালের প্রিজন ওয়ার্ড থেকে মুক্তিলাভ করে আমাদের মাঝে ফিরে এসেছেন-আলহামদুলিল্লাহ!
তিনিই একমাত্র জামায়াত নেতা যিনি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় থেকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে বেকসুর খালাস পেলেন। উল্লেখ্য, কথিত মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের সাবেক আমীর শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল শহীদ মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা এবং সাবেক কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য শহীদ মীর কাসেম আলীকে বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ বিচারের মাধ্যমে প্রাণদণ্ড কার্যকর করা হয়। যা দেশে বিদেশে বিচারিক হত্যাকাণ্ড হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে। এছাড়াও জামায়াতের সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম, নায়েবে আমীর মাওলানা আবুল কালাম মোহাম্মদ ইউসুফ, আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও মাওলানা আব্দুস সুবহান কারা নির্যাতনের শিকার হয়ে কারাগারেই মৃত্যুবরণ করেন।
প্রসঙ্গত, মুক্তিযুদ্ধের সময় তথাকথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দলীয় প্রসিকিউশন, সাজানো সাক্ষী ও ফরমায়েশি বাদীর মাধ্যমে মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগের মামলায় ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এটিএম আজহারকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় দেন। দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি আপিল করা হয়। এ আপিলের শুনানি শেষে ২০১৯ সালের ৩০ অক্টোবর মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে আপিল বিভাগ রায় দেন। ২০২০ সালের ১৫ মার্চ আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর তা পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে ২০২০ সালের ১৯ জুলাই আপিল বিভাগে আবেদন করেন আজহারুল। এ পুনর্বিবেচনার আবেদনের শুনানি শেষে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি লিভ মঞ্জুর করে আদেশ দেন আপিল বিভাগ। উল্লেখ্য, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ২০১২ সালের ২২ আগস্ট মগবাজারের বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। মুক্তির আগ পর্যন্ত তিনি মৃত্যুদণ্ডাদেশ মাথায় নিয়ে কারাগারেই ছিলেন।
খালাস প্রাপ্তির পর এক প্রতিক্রিয়ায় এটিএম আজহারের আইনজীবী শিশির মনির বলেন, ‘আজকে রায়ের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এ টি এম আজহারুল ইসলামকে সকল অভিযোগ থেকে বেকসুর খালাস দিয়েছে। এখন থেকে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলাম একজন নির্দোষ ব্যক্তি। এ রায়ের মাধ্যমে আমরা মনে করি সত্য জয়ী হয়েছে, মিথ্যা পরাজিত হয়েছে। ইতোপূর্বে জামায়াতের এবং বিএনপির ছয়জন শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। দুনিয়ার ইতিহাসে এটা নজিরবিহীন নির্যাতনের শামিল’।
তিনি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘আজকের রায়ে আদালত চারটি পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। প্রথমটি হলো-বাংলাদেশেসহ এ ভারতীয় উপমহাদেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা বদলে দেওয়া হয়েছিল। এটা ছিল সবচেয়ে বড় ভুল। দ্বিতীয়টি হলো, আদালতের সামনে উপস্থাপিত সাক্ষ্যপ্রমাণ কোন অ্যাসেসম্যান্ট ছাড়াই এ টি এম আজহারুল ইসলামকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে এটি ছিল বিচারের নামে অবিচার।
যে সমস্ত তথ্য প্রমাণ আদালতের সামনে হাজির করা হয়েছিল, অতীতের আপিল বিভাগ এটা সঠিকভাবে বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলশ্রুতিতে আজকে এ টি এম আজহারুল ইসলামকে বেকসুর খালাস প্রদান করা হয়েছে। শুধু বাংলাদেশে নয় পৃথিবীর ইতিহাসে এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা হয়ে থাকবে।
প্রসঙ্গত, গত ২৭ মে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ এ সর্বসম্মত রায় ঘোষণা করেন। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আজহারকে ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রংপুর অঞ্চলে ১২৫৬ ব্যক্তিকে গণহত্যা-হত্যা, ১৭ জনকে অপহরণ, একজনকে ধর্ষণ, ১৩ জনকে আটক, নির্যাতন ও গুরুতর জখম এবং শতশত বাড়িঘরে লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের মতো নয় ধরনের ছয়টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয় এটিএম আজহারের বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগের মধ্যে ১ নম্বর বাদে বাকি পাঁচটি অভিযোগে তাকে ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ড দেন। যদিও এটি প্রহসনের রায় বলে আখ্যায়িত করে আসছে জামায়াতে ইসলামী।
আপিল বিভাগের সর্বসম্মত রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, ক্রিমিনাল আপিল নং ১২/২০১৫ এ আপিল বিভাগের ৩১.১০.২০১৯ তারিখের পূর্ববর্তী রায় ও আদেশ পর্যালোচনা করে বাতিল করা হলো। এর পরিপ্রেক্ষিতে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ৩০.১২.২০১৪ তারিখে প্রদত্ত দণ্ডাদেশ ও রায় (আইসিটি-বিডি কেস নং ৫/২০১৩) বাতিল করা হলো। রায় ঘোষণায় আরো বলা হয়, উপস্থাপিত প্রমাণাদি ও আইনি উপস্থাপনার পূর্ণাঙ্গ পুনর্মূল্যায়নের পর আপিল বিভাগ মনে করে, আপিলকারীর দণ্ডাদেশ ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার মৌলিক নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘনের মাধ্যমে হয়েছে, যার কারণে গুরুতর বিচারিক বিভ্রাট ঘটেছে।
এছাড়াও, আদালত স্বীকার করে যে-পূর্ববর্তী রায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ যথাযথভাবে বিবেচনা করা হয়নি এবং এ গুরুতর বিচ্যুতি বিচার ব্যবস্থায় এক চরম বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। এতে আরো বলা হয়, এ বিভাগ গভীর দায়িত্ববোধ থেকে আরো স্বীকার করে, পূর্ববর্তী রায়ে মামলার প্রমাণের দুর্বলতা ও প্রেক্ষাপটকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হয়নি, যা বিচারিক নিরপেক্ষতা ও সততার মানদণ্ড থেকে পিছিয়ে ছিল। এ কারণে, ন্যায়বিচারের স্বার্থে আপিলকারীর দণ্ড ও রায় বহাল রাখা যায় না। আপিল বেঞ্চ উল্লেখ করেন, এ আদালত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন-১৯৭৩ অনুযায়ী আন্তর্জাতিক আইনের প্রাসঙ্গিক দিকগুলোকে যথাযথভাবে গুরুত্ব দেয়নি, যা বিচার বিভাগের একটি গুরুতর কর্তব্য ছিল। এ ব্যর্থতা বিচার বিভাগের দায়িত্বে একপ্রকার অবহেলার পরিচয় বহন করে।
তথাকথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নামে পতিত স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদী সরকার যে বিচারের নামে প্রহসন করে জামায়াত-বিএনপির নেতাদের ওপর বিচারিক হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে তা আপিল বিভাগের রায়ে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। আপিল বিভাগের রায়ে জামায়াত নেতা এটিএম আজহার বেকসুর খালাসের মাধ্যমে একথা আবারো প্রমাণিত হলো যে, তিনি পুরোপুরি নির্দোষ ছিলেন। তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে মূল্যবান ১৪টি বছর জীবন থেকে হারিয়ে ফেলেছেন। শুধু তাই নয় বরং শীর্ষ ৫ জন নেতাকে সাজানো পাতানো বিচারের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। আরো ৫ জন কারা নির্যাতনেই মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু এটিএম আজহারুল ইসলামই একমাত্র সৌভাগ্যবান ব্যক্তি যিনি সকল ষড়যন্ত্র ও দুর্ভেদ্য প্রাচীর ছিন্ন করে মুক্ত বাতাসে ফিরে এসেছেন। যা তার বীরোচিত প্রত্যাবর্তন।
তাই দেশের উচ্চ আদালতের রায়ের সূত্র ধরেই কথিত মানবতাবিরোধী অপরাধ আদালতের সকল রায়ই নতুন করে রিভিউ হওয়া উচিত এবং এ বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ বিচার প্রক্রিয়ার সাথে যারা জড়িত ছিলেন তাদের প্রত্যেককেই আইনের আওতায় আনা দরকার। দেশের বিচার বিভাগের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এর কোন বিকল্প নেই।