কলাম
রমযানে মূল্যস্ফীতি
বরাবরই রমযান মাস এলে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম হু হু করে বেড়ে যায়। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর। আশঙ্কাটা এখন রীতিতে পরিণত হয়েছে। এবার অসাধু ব্যবসায়ীদের রোজার কারবারের নমুনা বেশি ভয়ঙ্কর।
Printed Edition
এম এ কবীর
বরাবরই রমযান মাস এলে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম হু হু করে বেড়ে যায়। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর। আশঙ্কাটা এখন রীতিতে পরিণত হয়েছে। এবার অসাধু ব্যবসায়ীদের রোজার কারবারের নমুনা বেশি ভয়ঙ্কর। এ সময়ে যেসব পণ্যের দাম কমে কিছুটা স্থিতিশীল অবস্থায় এসেছে, সেগুলোর দামও ফের বাড়ানো হয়েছে। ছোলা, খেজুর থেকে শুরু করে মাংস, ডিম, এমনকি চিড়া-মুড়িও এ সময়ে মুনাফার একেকটা বিশাল আইটেম। শুধু আমদানিকৃত নয়, দেশে উৎপাদিত পণ্য নিয়েও এই কারবারিদের অনেক আয়োজন। অভিযান, জরিমানা বা বিচার-সালিশে তা দমন সম্ভব নয়। আবার প্রতিরোধও অসম্ভব। কারণ এখানে নৈতিকতার বালাই নেই। অল্প সময়ের মধ্যে অতিরিক্ত মুনাফা হাতানোই মূল কথা। সেই বিবেচনায় রোজা-রমযান একটা মৌসুমি সুযোগ। রোজায় বিক্রি কয়েকগুণ বাড়লে বিশ্বের অন্যান্য দেশে ব্যবসায়ীরা দাম কমান। এখানে উল্টো। যে যেভাবে পারে বাড়তি মুনাফা হাতায়। যে কোনো অজুহাতে অল্প সময়ে অনৈতিকভাবে অতিরিক্ত মুনাফা করার প্রবণতা ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংক্রমিত হয়ে পড়েছে, যার চড়া মাসুল দিতে হয় ভোক্তাকে।
আমরা আশায় আশায় দিন গুনি, সরকার হয়তো কিছু একটা করবে। সিন্ডিকেটবদ্ধ ব্যবসায়ীদের গুদামে হয়তো সরকারি লোকরা হানা দেবে। লুকিয়ে রাখা পণ্যসামগ্রী তখন বেরিয়ে আসবে ‘আয়নাঘর’ থেকে। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। দু-একটি গুদামে সরকারি লোকরা হানা দিয়ে জরিমানা করেন বটে, কিন্তু এতে পণ্যের দাম কমে না। সব সরকারেরই কিছু স্তাবক থাকেন; তাদের কাজ হলো সরকারের এসব কথাকে সমর্থন দিয়ে নেক নজরে আসা। এই স্তাবকদলের অস্তিত্ব ব্রিটিশ আমলে ছিল, পাকিস্তান আমলে ছিল, এখনও আছে। ব্রিটিশ আমলে একজন ভারতীয় বলেছিলেন, সাহেবরা তাদের স্বর্গতুল্য মাতৃভূমি ছেড়ে অতিকষ্টে আমাদের সুখের কথা বিবেচনা করে অন্ধকার, উষ্ণ এই দেশে ম্যালেরিয়া, বসন্ত, কালাজ¦র, ডায়রিয়া, কুষ্ঠ ইত্যাদির বিপদকে উপেক্ষা করে এখানে এসে থাকছেন, এজন্য তাদের কাছে আমরা আজীবন কৃতজ্ঞ। রায় বাহাদুর উপাধি কি আর এমনি এমনি আসে!
পাকিস্তান আমলে মোনায়েম খানসহ মুসলিম লীগ ও অন্যান্য দলের নেতারা পাকিস্তানীদের ব্যাপক প্রশংসা করেছেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের মন্ত্রিসভার একজন সদস্য বলেছিলেন যে, স্যার আদেশ দিলে আমি রাস্তা ঝাড়ু দিতে রাজি আছি। ক্ষমতাসীনদের এসব প্রলাপ শুনে শুনে আমাদের কান অভ্যস্ত হয়ে গেছে। পলাতক হাসিনা সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছিলেন, সিন্ডিকেটের সদস্যরা খুবই শক্তিশালী। তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে গেলে হিতে বিপরীত হবে। অর্থাৎ পালহীন, লগিহীন নৌকো ভাসিয়ে দাও, যেদিকে যায় যাক।
থিউরির জট পাকিয়ে কেউ হয়তো বলছেন যে, খোলাবাজার অর্থনীতিতে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সমীচীন নয়। এ পর্যায়ক্রমিক মূল্যবৃদ্ধির ঢেউ সরকারের কথা শুনছে না। ক্রমে ক্রমে বেড়েই চলেছে। কিছুদিন আগে সরকার বিভিন্ন খাতে কর বা ভ্যাট বাড়িয়েছিল; অর্থ উপদেষ্টা খুবই গর্ব করে বলেছিলেন, এ ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে না। মানুষের পকেটে হাত পড়বে না। বেয়াড়া পণ্যমূল্য কিন্তু অর্থ উপদেষ্টার মতো জ্ঞানী এবং ধীরস্থির মানুষের কথাও শোনেনি।
রমযানে পণ্যের দাম বৃদ্ধির মহোৎসব চলে। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে আগে থেকে নির্ধারিত পণ্য মজুদ করে ফেলেন। রোজার সময়ে প্রয়োজনীয় পণ্য বলতে বোঝায় খেজুর, ডাল, ছোলা, ভোজ্যতেল, চিনি, ঘি ইত্যাদি। কয়েক মাস ধরে এসব পণ্য বিপুল পরিমাণে আমদানি করা হয়েছে। কিন্তু এসব আমদানি মানুষের চাহিদা এবং সিন্ডিকেটের সদস্যদের কাছে নস্যি বলে বিবেচিত হবে।
সাধারণভাবে সিন্ডিকেট মালিকদের ঘরে হানা দিলে টেলিভিশনে চেহারা দেখানো যাবে বটে, কিন্তু পণ্যের দাম কমবে না। কিছু কিছু ব্যবসায়ী অপেক্ষা করে থাকেন, মুদ্রানীতি ঘোষিত হলেই তারা যে কোনো একটি ছুঁতোয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন। তারা এই বৃদ্ধির জন্য দায়ী করে থাকেন মুদ্রানীতিকে। মুদ্রানীতিতে কী আছে বা নেই তা অনেকেই পড়েও দেখেন না। রমযানকে বাড়তি কামাইয়ের টার্গেট করেই চলে কারসাজিটা। তা জায়েজ করতে অন্তহীন অজুহাত। নানা অজুহাতে একের পর এক বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়ানোর যত আয়োজন। টানা মাস কয়েক পেঁয়াজ-আলুর পর এখন তাদের চোখ চাল-তেলে। রমযান সামনে রেখে এ তালিকায় যোগ করেছে মসলাকে। দেড় মাস ধরে দফায় দফায় দাম বেড়েছে রান্নায় অতিপ্রয়োজনীয় এই পণ্যের। খুচরায় কোনো কোনো মসলার দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। এর মধ্যে এলাচের দাম বাড়ার গতি অস্বাভাবিক। গত দেড় মাসে মানভেদে এলাচের দাম কেজিতে বেড়েছে ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা। কালিজিরা, গোলমরিচের দামও চড়িয়েছে। দেশে মসলার চাহিদার প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর।
দামের কারসাজিতে কুশীলবরা ছাড় দিচ্ছে না কোনো পণ্যেই। যখন যেটাকে পারছে ধরছে। তাদের চালবাজির এখনকার হট আইটেম চাল। তা মিল গেট থেকে একদম আড়ত পর্যন্ত। মিল গেটে দাম বেড়ে যাওয়ায় সব ধরনের চালের দামই এখন চড়া। গত এক থেকে দেড় মাসের ব্যবধানে দেশের আড়তগুলোতে সরু চালের ৫০ কেজির বস্তাপ্রতি ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা, মাঝারি চালের বস্তায় ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে।
রোজার বাড়তি চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ বাড়াতে বেশ কিছু প্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি বাড়াতে এবং সহজ করতে সরকারগুলো বরাবরই অনেক ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়। ভোজ্যতেল, ছোলা, ডাল, মটর, পেঁয়াজ, মসলা, চিনি ও খেজুরের কোনো ঘাটতি যেন না হয় সে জন্য এসব খাদ্যপণ্য বাকিতে আমদানির সুযোগ পর্যন্ত দেয়ার রেকর্ড আছে। কিন্তু এর সুফল ভোক্তাদের নসিবে মেলে না। এ ক্ষেত্রে তাদেরও দায়িত্বশীল আচরণের বিষয় রয়েছে। ভোক্তাদের কারও কারও মধ্যে অতিরিক্ত পণ্য কেনার প্রবণতা রয়েছে। এটাও এক ধরনের মজুদ। উৎপাদন, মজুদ, সরবরাহ নিয়ে সরকারি অধিদপ্তরগুলোর কাছে সঠিক তথ্য-পরিসংখ্যানও জরুরি। তথ্য-সাবুদ সঠিক না হলে অভিযান ফলদায়ক হয় না। চলমান বাজার মনিটরিংকে কার্যকর করতেও তা দরকার।
প্রতিবছর পবিত্র রমযান মাস আসার সঙ্গে সঙ্গে খেজুরের চাহিদা এবং বাজারের পরিস্থিতি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে রমযান মাসে খেজুর একটি অপরিহার্য পণ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। ইফতারে খেজুরের ব্যবহারের পেছনে ধর্মীয় গুরুত্ব রয়েছে, যা মুসলমানদের জন্য সুন্নত।
বাংলাদেশে খেজুরের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ১ লাখ মেট্রিক টন, যার মধ্যে প্রায় ৬০-৭০ হাজার মেট্রিক টন শুধু রমযান মাসেই ব্যবহৃত হয়। দেশে খেজুরের আমদানির প্রধান উৎসগুলো হলো সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত (বিশেষ করে দুবাই), মিশর, ইরাক, তিউনিসিয়া এবং আলজেরিয়া। এসব দেশ থেকে বিভিন্ন প্রকারের খেজুর যেমন আজওয়া, আম্বার, মাবরুম, সুকারি এবং ডেগলেট নূর আমদানি করা হয়।
গত ২ জানুয়ারি রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে ‘খাদ্যপণ্যের যৌক্তিক দাম’ নিয়ে সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেমিনারে বাজার নিয়ন্ত্রণে পণ্যের উৎপাদন, চাহিদা ও সরবরাহের সঠিক তথ্য নিশ্চিত করে সরবরাহ ব্যবস্থাপনার জন্য কমিশন গঠনের দাবি জানান ব্যবসায়ীরা। তবে ছাত্র প্রতিনিধিদের দাবি, রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা ছাড়া বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। আলোচকরা বলেছেন, মানুষের আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে ব্যয় বাড়ছে।
আর এতেই খাদ্যের বাজার প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু এ প্রসারিত বাজার দিনে দিনে আনরেগুলেটেড হয়ে যাচ্ছে। ভোক্তার অসহায়ত্বের শেষ কোথায়-এ নিয়ে প্রশ্ন তোলে ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ক্যাব। আর চিরচেনা যুক্তি তুলে ধরে পণ্যমূল্য বাড়ার কারণ ব্যাখ্যা করেন ব্যবসায়ীরা। ক্যাব বলছে, বৈষম্যবিরোধের কথা বলে এ সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। কিন্তু বৈষম্য প্রতিনিয়ত বাড়ছে। চাঁদাবাজি বন্ধের আহ্বান জানিয়ে, রাজনীতিবিদদের সৎভাবে উপার্জনের পথ তৈরির উপর গুরুত্বারোপ করেন বক্তারা। সিটি গ্রুপের পরিচালক বলেন, ‘আমরা যখন পণ্য কিনতে যাই, তারা কিন্তু একটা প্রিমিয়াম চার্জ নেয়। এটা কান্ট্রি রেটিংয়ের ওপর হয়। একই পণ্য যখন পাশের দেশ ইন্ডিয়া কেনে, তখন তাদের চেয়ে বেশি দামে আমাদের কিনতে হয়।’
বাজারে অস্থিতিশীলতার দায় বিগত সরকারকে দিয়ে আসন্ন রমযানে দ্রব্যমূল্য না বাড়ার আশ্বাস দেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। সরকারকে সহায়তার কথা জানায় রাজস্ব বোর্ড ও ট্যারিফ কমিশন।
লেখক : সাংবাদিক।