DailySangram-Logo-en-H90
ই-পেপার আজকের পত্রিকা

কলাম

দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনসচেতনতা জরুরি

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার শাসনামলে দুর্নীতি রাষ্ট্র ও সমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছিল। নীতি ও সততার বিপরীত

Printed Edition
Default Image - DS

অধ্যক্ষ ড. বি এম শহীদুল ইসলাম

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার শাসনামলে দুর্নীতি রাষ্ট্র ও সমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছিল। নীতি ও সততার বিপরীত হচ্ছে দুর্নীতি। অর্থাৎ নীতি, আদর্শ ও সততার বিসর্জন দিয়ে অবৈধ পন্থায় কর্তব্যরত কোনো ব্যক্তি যখন সেবাপ্রার্থীকে স্বাভাবিক কাজ-কর্ম অর্থের বিনিময়ে করে দিতে সম্মত হয়, তখন তাক দুর্নীতি বলে। দুর্নীতি শব্দটি বিশেষণ বাচক শব্দ। সংস্কৃতি ভাষায় কোনো কিছু সমূলে বিনষ্ট বা ধ্বংস হওয়াকে দুর্নীতি বলে। ইংরেজিতে দুর্নীতি শব্দের অর্থ Corruption. দুর্নীতি শব্দের প্রথম ব্যবহার করেন এরিস্টটল। তারপর সিসারো দুর্নীতি শব্দের ব্যবহার করেন। তিনি ঘুষ এবং সৎ অভ্যাস পরিত্যাগ প্রত্যয়ে এটি যোগ করেছেন। রাষ্ট্র বিজ্ঞানী মরিস বলেছেন; “দুর্নীতি হলো ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার”। অর্থনীতিবিদ আই.সিনিয়র বলেছেন; দুর্নীতি এমন একটি কাজ যেখানে অনৈতিক অর্থ প্রদানের কারণে কোনো তৃতীয় পক্ষ সুবিধা ভোগ করে ও লাভবান হয়। যার ফলে তারা বিশেষ ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার নিশ্চিত করে। এতে করে দুর্নীতির সাথে যুক্ত পক্ষটি এবং তৃতীয় পক্ষ উভয়ই লাভবান হয় এবং এ কাজে দুর্নীতিগ্রস্ত পক্ষটি থাকে কর্তৃপক্ষ। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের কাফম্যান দুর্নীতির ধারণাটি আরো বিস্তৃতভাবে প্রকাশ করেন। ‘আইনানুগ দুর্নীতি’ শব্দদ্বয় যোগ করার মাধ্যমে সেখানে আইনকে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ করা হয়। যাতে নিজেদের রক্ষা করার জন্য আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনের ক্ষমতা আইনপ্রণেতার নিকট রক্ষিত থাকে। ট্র্যান্সপারেন্সির এক জরিপে উঠে আসে যে, দুর্নীতিতে সবচেয়ে এগিয়ে আছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো।

তবে আমাদের প্রিয়ভূমি বাংলাদেশ দুর্নীতিতে মোটেই পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশ বিগত ফ্যাসিবাদী সরকার শেখ হাসিনার শাসনকালে দুর্নীতির অন্যতম শীর্ষে অবস্থান করেছে। রাষ্ট্রের প্রতিটা সেক্টরে দুর্নীতির এক অস্বাভাবিক প্রতিযোগিতা চলেছে। এমনকি প্রতি বছর দুর্নীতির বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের মাধ্যমে চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করেছে।

১৯৭১-এ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ পর্যন্ত যারা ক্ষমতায় ছিল, তারা কেউ সোনার বাংলা, কেউ রূপসী বাংলা, কেউ পল্লী বাংলা, কেউ স্বাধীন বাংলা, আবার কেউ সবুজ বাংলা উপহার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও এদেশের জনগণ তাদের আশ্বাস অনুযায়ী আজ পর্যন্ত কোনো সুফল পায়নি। বরং স্বাধীনতার ৫৪ বছরে যারাই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল তারা নিজেরা দেশটাকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যার পর বন্দুকের নলের মাধ্যমে এরশাদ সামরিক শাসক হিসেবে আবির্ভূত হয়। পরে লোক দেখানো নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা বৈধ করে নেয় এবং স্বৈরশাসন কায়েম করে। তাদের দুর্নীতির মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, অবৈধ পন্থায় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এরশাদসহ জাতীয় পার্টির মন্ত্রী-এমপি ও দলীয় নেতাকর্মীরা গুলশান, বনানী, বারিধারায় প্লটের পর প্লট দখল করে নেয় এবং অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। তাদের ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্রসমাজকে উসকিয়ে দিয়ে বিশ্বিবদ্যালয়গুলোতে ছাত্রশিবিরের অসংখ্য নেতা-কর্মীদের হত্যা করে। এরশাদের জুলুম-নিপীড়ন এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল জনগণ উত্তাল তরঙ্গের ন্যায় সংগ্রাম করে ৯ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটায় ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর।

একইভাবে বিগত ১৬ বছরে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকার ক্ষমতার দাপটে নামে বেনামে পূর্বাচল নতুন শহরে অবৈধ পন্থায় পরিবারের সদস্যদের নামে, নেতা কর্মীদের নামে, আত্মীয়-স্বজনদের নামে প্লটের পর প্লট দখল করেছে। ২০০৯ সালে জগৎ শ্রেষ্ঠ ফ্যাসিবাদী শাসক শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে দেশকে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন বানিয়ে দেয়। বিগত ১৬ বছরে সচিবালয় থেকে শুরু করে সরকারি অফিসগুলোতে দুর্নীতির মহা উৎসব চলেছে। এসব দুর্নীতি দূর করতে হলে প্রয়োজন সৎ ও যোগ্য লোক তৈরি করা। যারা প্রশাসনে গেলে দুর্নীতি চিরতরে নির্মূল হয়ে যাবে। ইসলাম সত্য, ন্যায় ও নীতি-নৈতিকতার ধর্ম। দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের কোনো সুযোগ ইসলামে নেই। বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থা ও রাষ্ট্র কাঠামোয় দুর্নীতি প্রতিরোধের ব্যবস্থা অনুপস্থিত। যার কারণে সমাজে দুর্নীতির ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। রাষ্ট্রের প্রতিটা স্তরে ফ্যাসিস্ট সরকারের নিজস্ব দলীয় লোক নিয়োগ। সমাজে সৎ মানুষের অভাব, অসৎ মানুষের প্রাচুর্য এবং দেশে কিছু ‘বাজ’ প্রকৃতির লোকের সমাহার রয়েছে। এদের অনৈতিক কার্যকলাপ এবং অসৎ পন্থায় সম্পদের পাহাড় গড়ার স্বপ্নের কারণেই দুর্নীতি আরো ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। কিন্তু যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের (স) প্রতি আনুগত্য ও আল্লাহর প্রতি ভয় পোষণ করে, তারা কখনো দুর্নীতির চিন্তাও করতে পারে না। সুতরাং দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে হলে সৎ ও যোগ্য লোকদের সরকারি-বেসরকারি প্রশাসনগুলোতে দায়িত্বে বসাতে হবে। অযোগ্য লোকেরা যাতে সুপারিশের মাধ্যমে কোনো দায়িত্বশীল পদে অধিষ্ঠিত হতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। পাশাপাশি সততার স্তম্ভ মজবুত করতে হবে।

পতিত স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার অসৎ রাজনীতির কারণে দীর্ঘ ১৬ বছরে সচিবালয় থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত সকল স্তরে অনিয়ম ও দুর্নীতির করদরাজ্যে পরিণত হয়েছে। টাকা ছাড়া কোনো অফিসেই ফাইল মুভ করেনি। এ ব্যাপারে একজন ভুক্তভোগী ব্যক্তির একটি বাস্তব ঘটনার আংশিক সংক্ষিপ্ত পরিসরে উপস্থাপন করছি। “তিনি তার প্রতিষ্ঠানের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের বিষয়ে সচিবালয়ে নির্ধারিত কর্তৃপক্ষের নিকট নিয়মানুযায়ী আবেদন করেন। কাজটি সঠিক ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে সম্পন্ন করতে পরিদর্শনসহ সর্বোচ্চ ৩ মাসের বেশি সময় লাগার কথা নয়। কিন্তু লোকটি যতবার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে সচিবালয়ে দেখা করেছে, ততবারই কোনো না কোনো কারণ দেখিয়ে বিদায় দেয়া হয়েছে। বার বার ফেরত পাঠানো হয়েছে। কখনো কখনো বলা হয়েছে নতুন করে ব্যাংক ড্রাফ্ট করে পুনরায় আবেদন করতে হবে। শেষ পর্যন্ত তার নিকট নির্ধারিত অংকের অর্থ দাবি করা হলো। বলা হলো তাহলে আপনার কাজটি তিন দিনের মধ্যে হয়ে যাবে। বলা হলো সবকিছু রেডি আছে। ফাইলটা সচিব, প্রতিমন্ত্রী হয়ে মন্ত্রী পর্যন্ত যাবে। সুতরাং বুঝেন তো! তখন তিনি বললেন, এতো এমাউন্ট দেয়া তো সম্ভব নয়। তারা বললেন, এর চাইতে বেশি দিয়েও মানুষ কাজ করে নিচ্ছে। কিছু দিন পরে একদিন হঠাৎ করে ফোন দিয়ে কর্মকর্তা লোকটির নিকট পুনরায় আনুতোষিক দাবি করে কাজটি রিসিভ করতে বললেন। এটাই হচ্ছে আমাদের দেশে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমলে দুর্নীতির বাস্তব অবস্থা।

দুর্নীতি প্রতিরোধে করণীয় : সমাজ এবং রাষ্ট্রকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো প্রয়োজন:

১. অবৈধ আয়ের প্রতিযোগিতা: রাসুল (স) বলেন; “আমি তোমাদের জন্য দারিদ্র্যের আশঙ্কা করি না, আমি আশঙ্কা করি, তোমাদের কাছে আগের লোকদের মতো প্রাচুর্য আসবে। তখন তোমরা তা পাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করবে। আর এ প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে ধ্বংস করবে”। [সহীহ বুখারী: হাদিস ৪০১৫]।

২. সুসম বেতন-ভাতা প্রদান: দুর্নীতি প্রতিরোধে সকলকে সুষম বেতন-ভাতা প্রদান করা। কর্মচারীদের জন্য সীমিত বেতন-ভাতা নির্ধারণ দুর্নীতির অন্যতম কারণ। তাই সরকারি বেসরকারি স্বায়ত্তশাসিত সকল পদে সুসম বেতন-ভাতা প্রদান করা জরুরি। রাসুল (স) বলেন; “শ্রমিক কর্মচারিরা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীন করেছেন। সুতরাং তাদের প্রতি ইনসাফ কর”। [ সহীহ বুখারী: হাদিস-৩০]

৩. সততার সাথে নিয়োগ দান: রাষ্ট্রের সকল স্তরে সততার সাথে নিয়োগ দানের মাধ্যমে দুর্নীতি কমানো সম্ভব। যারা ঘুষ দিয়ে অবৈধভাবে চাকরি নেয়, তারা চাকরিতে গিয়ে সে টাকা পুষিয়ে নেয়ার কাজে ব্যস্ত থাকে। আবার অনেকের যোগ্যতা না থাকার কারণে সুপারিশ এবং ঘুষের মাধ্যমে নিয়োগ পেয়ে থাকে। তারা সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি করে থাকে।

এছাড়া সারা দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে হয় টাকার বিনিময়ে, না হয় আত্মীয় বা দলীয় সুপারিশের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে সমাজে অযোগ্য ও অসভ্য লোকদেরকে নিয়োগ দিয়ে থাকে। যার ফলে অযোগ্য লোকগুলো কমিটির প্রভাবে কাউকে পাত্তা না দিয়ে প্রভাব বিস্তার করে এবং দুর্নীতি করে। তবে কমিটির কিছু কিছু সভাপতি ও সদস্য সৎ আছে। [বুখারি: ৫৯ হাদিস দেখুন]।

৪. হারাম উপার্জনের প্রবণতা: অসৎ ও হারাম উপায়ে অর্থ উপার্জনের প্রবণতা মানুষকে দুর্নীতির দিকে ধাবিত করে। সুতরাং হারাম পথে উপায় করার মানসিকতা ও প্রবণতা পরিহার করতে হবে। রাসুল (স) বলেন; “হারাম উপায়ে বর্ধিত দেহ কখনো জান্নাতে যাবে না”। [মিশকাত: হাদিস নম্বর-২৪৩]

৫. সুদ ও ঘুষ নিষিদ্ধ করা: দুর্নীতি সমাজ থেকে নির্মূল করতে হলে সুদ ও ঘুষ রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। রাসুল (স) বলেন; ঘুষখোর ও ঘুষদাতা উভয়ই জাহান্নামে যাবে। সুদখোর, সুদ দাতা, সুদের দলিল লেখক সবাই জাহান্নামে যাবে”। [ ইবনে মাজাহ: হাদিস নম্বর ২২৭৭]

এছাড়াও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা, কুরআন ও সুন্নাহর বিধানের আলোকে চরিত্রবান লোক তৈরি করা ও প্রশাসনে নিয়োগ দেয়া, প্রশাসনের সকল স্তরে আল্লাহ ভীতি লোক বসানো, যাকাত ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা গড়ে তোলা, ঘুষের সিন্ডিকেট গুড়িয়ে দেয়া, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা এবং সুদের ব্যবসা সরকারিভাবে বন্ধ করার মাধ্যমে দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব । লেখক : শিক্ষাবিদ।