দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী লি জে-মিয়ং। তিনি ক্ষমতাসীন পিপল পাওয়ার পার্টির প্রার্থী এবং মন্ত্রিসভার প্রাক্তন সদস্য কিম মুন-সু’কে হারিয়ে দিয়েছেন। গত ডিসেম্বরে দেশটিতে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতা বলতে গেলে তাকে তৈরি করেছে। জনমত জরীপে তিনি এগিয়েও ছিলেন। ক্ষমতাসীন দলের অনৈক্য ও ভুলনীতি তাকে বিজয়ীর আসনে নিয়ে যায়। ২০২৪ সালের তেসরা ডিসেম্বরের ঘটনার আগে লি জে-মিয়ংয়ের ক্ষমতায় আসার পথে ছিল নানা বাধা ও জটিলতা। চলমান একাধিক মামলার পাশাপাশি দুর্নীতির অভিযোগ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের তদন্তে তার প্রেসিডেন্ট প্রার্থিতাই বাতিল হতে যাচ্ছিল। তখনই একটি সাংবিধানিক সংকট বদলে দিয়েছে সবকিছু। বিবিসির এক বিশ্লেষক বলছেন, সে রাতে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইউল সামরিক শাসন জারির ব্যর্থ চেষ্টাই নতুন এক রাজনৈতিক গতিপথ তৈরি করে দেয়। যা লিকে ক্ষমতায় যাওয়ার পথকে প্রশস্ত করে। ঠিক এর ছয় মাস পর, দক্ষিণ কোরিয়ার জনগণ বিজয়ী করে লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী লি’কে। কিশোর বয়সে ছিলেন একজন শ্রমিক, সেখান থেকে এখন পৌঁছেছেন দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার আসনে।
এশিয়ার উন্নত ও গণতান্ত্রিক দেশ দক্ষিণ কোরিয়ায় গত ৩ ডিসেম্বরে সামরিক শাসন জারির খবরে নড়ে নড়ে বসেছিল বিশ্ব। প্রেসিডেন্টের দলের লোকরাও পছন্দ করেনি এই উদ্যোগ। প্রায় ৫০ বছরের মধ্যে দেশটিতে সামরিক আইন জারির ঘোষণা ছিল এটিই প্রথম। তার সূত্র ধরে দেশটিতে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকট নানা ডালপালা মেলে অবশেষে নতুন নির্বাচনের পথে ধাবিত হয়।
দক্ষিণ কোরিয়ায় সামরিক আইন জারির যুক্তি হিসেবে ‘রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি’ ও উত্তর কোরিয়া থেকে হুমকির কথা জানান তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইউন। তবে দ্রুতই এটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে, বাইরের কোনো হুমকিতে নয়; বরং নিজস্ব রাজনৈতিক ঝামেলার জেরেই এ সিদ্ধান্ত নেন ইউন সুক। ২০২২ সালের মে মাসে ভোটে জিতে প্রেসিডেন্ট হন কট্টর রক্ষণশীল ভাবধারার রাজনীতিক পিপল পাওয়ার পার্টির ইউন সুক ইউল। তবে গত বছরের এপ্রিল থেকে কোণঠাসা হয়ে পড়েন তিনি। ২০২৪ সালের ১০ এপ্রিল দক্ষিণ কোরিয়ায় পার্লামেন্ট নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে দুটি বৃহত্তম দল, উদারপন্থী ডেমোক্রেটিক পার্টি ১৭৩ এবং রক্ষণশীল পিপল পাওয়ার পার্টি ১০৮টি আসন পায়। এ নির্বাচনে বিরোধী দলগুলি, বিশেষ করে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি জাতীয় পরিষদে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়। ফলে প্রেসিডেন্ট ইউনের সরকার তাদের চাহিদামতো বিল পাস করতে পারছিল না। চলতি বছর কয়েকটি দুর্নীতি কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে ইউনের প্রতি জনসমর্থনও অনেকটা কমে যায়। অভিশংসিত হয়ে ক্ষমতা ছাড়তে হয় তাকে। সে থেকে দক্ষিণ কোরিয়া কার্যকরভাবে নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে। দেখা দেয় রাজনৈতিক সংকট। অবশেষে ৩ জুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন নেতা খুঁজে পেল দেশটি।
দেশটি সম্পর্কে কিছু সাধারণ তথ্য। দক্ষিণ কোরিয়া পূর্ব এশিয়ার একটি রাষ্ট্র যা কোরীয় উপদ্বীপের দক্ষিণাংশ নিয়ে গঠিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে কোরীয় উপদ্বীপের উত্তর অংশটি সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনারা এবং দক্ষিণ অংশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা দখলে রেখেছিল। ১৯৫০-১৯৫৩ সালে কোরীয় যুদ্ধের পরে ধ্বংসপ্রায় দক্ষিণ কোরিয়া ১৯৯৩ সালে এসে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতিগুলির একটিতে পরিণত হয়। সেই ধারা চলমান। ৫ কোটি ১৭ লাখ জনসংখ্যার এই দেশটিতে গণতন্ত্র বজায় রয়েছে। আমেরিকার মিত্র দেশ হিসেবে বিভিন্ন ফোরামে দেশটি গণতন্ত্রের কথাই উচ্চকিত করে।
বাংলাদেশের সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার বাণিজ্যিক সম্পর্কটি বেশ দৃঢ়। এখানে কোরিয়ান কোম্পানী উন্নয়ন কাজে জড়িত আর বহু কিছুতে বিনিয়োগ রয়েছে দেশটির। বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের যাত্রার শুরুর দিকে কোরিয়ার ভূমিকা ছিল অসাধারণ। কোরিয়ার মতো কারিগরি জ্ঞানে সমৃদ্ধ দেশ থেকে দক্ষ প্রশিক্ষক এনে দেশে প্রশিক্ষক তৈরি করা হয়। আমাদের লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, অ্যাগ্রো প্রসেসিং, আইসিটি ইত্যাদি ক্ষেত্রে কোরিয়ান সহায়তা রয়েছে। বাংলাদেশ ও কোরিয়ার মধ্যে ১৯৭৩ সালে ডিপ্লোমেটিক সম্পর্ক স্থাপনের পর থেকে উভয় দেন একত্রে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য কোরিয়ার সহায়তায় বর্তমানে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় তিনটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে। অতি সম্প্রতি বিশ্বখ্যাত কোরিয়ান কোম্পানি ইয়াংওয়ান করপোরেশনের চেয়ারম্যান কিহাক সাংয়ের নেতৃত্বে কোরিয়ান বিনিয়োগকারীদের একটি দল প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশে বড় বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এসব নিরীখে দেশটির নতুন সরকারের সাথে সম্পর্কের বিষয়টি গুরুত্ববহ।
নতুন প্রেসিডেন্ট লি মিয়ং এর প্রসঙ্গে বিশ্লেষকরা বলেন, নানা বিতর্কে জড়ানো লি প্রায়ই প্রগতিশীল সংস্কারমূলক উদ্যোগ নিতেন। এর মধ্যে ২০২২ সালের নির্বাচনে সার্বজনীন মৌলিক আয়ের প্রতিশ্রুতি সেই সময়ের দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষমতা কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। এ কারণে কেউ কেউ তাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে, আবার অনেকে তাকে অবিশ্বাস বা অপছন্দ করে। কোরীয় রাজনীতির বিশ্লেষক ড. লীর মতে, “তিনি (মি. মিয়ং) একজন অত্যন্ত বিতর্কিত এবং লোকজন তাকে খুব একটা চিনতোও না। একজন বহিরাগত হয়েও নিজের নামটা এমনভাবে তৈরি করেছেন যা ঐতিহ্যবাহী ডেমোক্র্যাটিক পার্টির রীতিনীতির সাথে খাপ খায় না”। তার মতে, এবারের নির্বাচনি প্রচারণায় তিনি কিছুটা মধ্যম পন্থা অবলম্বন করেন। নির্বাচনি প্রচারণায় তিনি বড় ব্যবসা ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের গুরুত্ব তুলে ধরেছিলেন। বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে আসন্ন বাণিজ্য আলোচনাকেও সামনে এনেছিলেন। কোভিড-১৯ মহামারির সময় তিনি সর্বজনীন সহায়তা প্রদানের দাবিতে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে বেশ আলোচিত হন।
২০২২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দিতায় নেমে ০.৭৬ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে হেরে যান। এক বছরেরও কম সময় পরে ২০২২ সালের আগস্টে তিনি দলের নেতা নির্বাচিত হন। তবে তার ভাগ্য গড়ে দেয় ইউন সরকারের ভুল নীতি।
গত বছরের ৩ ডিসেম্বর অনেকটা হঠাৎ করে সামরিক আইন ঘোষণা করেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ইউন। দক্ষিণ কোরিয়ার ‘রাষ্ট্রবিরোধী শক্তি ও উত্তর কোরিয়া সমর্থকদের’ দমনের অজুহাতে এ সামরিক আইন জারি করা হয়। এরপরই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে বদলে যায়।
সে ঘোষণার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই অনলাইনে লাইভে এসে লি মানুষকে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে জড়ো হতে বলেন। এতে হাজারো মানুষ সাড়া দেয়। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। সামরিক বাহিনী সাধারণ মানুষকে প্রবেশ আটকে দেয়। সংসদ সদস্যরা বেড়া টপকে ভবনে প্রবেশ করেন । লি নিজেও ছিলেন তাদের মধ্যে। পরদিন ডেমোক্র্যাটিক পার্টি সংসদে ইউনের অভিশংসন প্রস্তাব আনে, যা ২০২৫ সালের ৪ এপ্রিল সর্বসম্মতভাবে সাংবিধানিক আদালতে গৃহীতও হয়। ৯ এপ্রিল লি দলের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়ে প্রেসিডেন্ট পদে লড়ার ঘোষণা দেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, সামরিক শাসনের ব্যর্থ উদ্যোগ দক্ষিণ কোরিয়ায় এক সাংবিধানিক সংকট তৈরি করে ও ইউনের রাজনৈতিক পতন ঘটায়, আর রাজনৈতিক দল পিপিপি দল কার্যত ভেঙে পড়ে। এ সংকটে খুব অল্প কয়েকজনই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সুবিধা নিতে পেরেছেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে সফল লি জে-মিয়ং। তবে তার ভবিষ্যৎ এখনো আদালতের রায়ের ওপর ঝুলে আছে। নির্বাচনের আগ পর্যন্ত আদালত মামলার কার্যক্রম স্থগিত রেখেছে। এখন তিনি ক্ষমতায় থেকেও দোষী সাব্যস্ত হতে পারেন। আর সেক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরিয়া আবারও এক রাজনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দক্ষিণ কোরিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট লি জে-মিয়ং এমন এক সময়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, যখন তার সামনে রয়েছে একগুচ্ছ সংকট, অর্থনৈতিক মন্দার ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি, বৈশ্বিক বাণিজ্যযুদ্ধ এবং পিয়ংইয়ং ও মস্কোর মধ্যে সামরিক সম্পর্ক ঘিরে উদ্বেগ বাড়ছে। তাকে একইসঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার ঐতিহ্যগত নিরাপত্তা-অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র এবং দেশটির বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার চীন এই দুই পরাশক্তির ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্বকে সামাল দিতে হবে। লি-এর প্রধান অগ্রাধিকারের মধ্যে থাকবে দক্ষিণ কোরিয়ার রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখা। এটি এশিয়ার চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি, যার ওপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতি ও বৈশ্বিক বাণিজ্য উত্তেজনা ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করেছে।
বিশ্লেষকরা বলেন, লি এমন এক দেশের নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছেন, যা এখনও ডিসেম্বরে ইউনের সামরিক আইন জারির প্রয়াস ঘিরে শুরু হওয়া রাজনৈতিক সংকটের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি এবং যার কারণে সমাজ গভীরভাবে বিভক্ত। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক গি-উক শিন এএফপিকে বলেন, ‘যদি নতুন প্রশাসন অতিরিক্ত আগ্রাসীভাবে রক্ষণশীলদের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে এটি উল্টো করে কট্টর ডানপন্থীদের আরও সক্রিয় করে তুলবে এবং রাজনৈতিক মেরুকরণ প্রশমনের প্রচেষ্টা দুর্বল হয়ে পড়বে।’ লি-র প্রশাসনের আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে বিশ্বের অন্যতম সর্বনিম্ন জন্মহার, জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধি এবং অসমতা।
নতুন সরকার কিছু কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যাচ্ছেন। কোরিয়া হেরাল্ড ১১ জুন জানায়, ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রধান নীতিনির্ধারক জিন সুং-জুন বুধবার বলেছেন যে তিনি একটি পরিকল্পিত অতিরিক্ত বাজেট চান যাতে ব্যক্তিগত খরচ বৃদ্ধিতে সহায়তা করার জন্য একটি নগদ অর্থ বিতরণ কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত থাকে। প্রেসিডেন্ট লি জে-মিয়ং তার সহযোগীদের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সহায়তা করার জন্য দ্রুত একটি অতিরিক্ত বাজেট তৈরি করার নির্দেশ দেওয়ার দুই দিন পর ডিপির প্রতিনিধি জিন সুং-জুন এই মন্তব্য করেন। ফেসবুকে একটি পোস্টে জিন বলেছেন যে পরিকল্পিত অতিরিক্ত বাজেটে সকল নাগরিকের জন্য একটি নগদ অর্থ বিতরণ কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত করা হবে। জিনের মতে, যদি এটি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে অর্থটি একটি কুপন আকারে প্রদান করা হবে যা তাদের আশেপাশে ব্যবহারের জন্য অনুমোদিত হবে। দেখা যাচ্ছে জনতুষ্টিমূলক কাজ মি. লি মিয়ং হাতে নিয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট লি আর কী কী করবেন তা আগামী দিনগুলোতে স্পষ্ট হবে। দেশটির সংকট উত্তরণ ও বিভিন্ন রাষ্ট্র বিশেষ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনি কোন পন্থা অবলম্বন করেন তাও ধীরে ধীরে স্পষ্ট হবে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।