প্রফেসর ড. মো. আব্দুল্লাহেল বাকী
কী বিচিত্র সৃষ্টিজগত। আমাদের চারপাশে জানা-অজানা দেখা-অদেখা কত কিছু। সবারই এক পরিচয়। আমরা সৃষ্টি। আমরা অধীন-পরাধীন-চাকর। প্রত্যেককে আল্লাহই তাঁর একান্ত ইচ্ছা অনুযায়ী কেবলই তাঁর নিজস্ব সিদ্ধান্তে সৃষ্টি করেছেন। আমাদের কোন কিছুই আমাদের নয়, সবই আল্লাহর দেওয়া।
অধীন-পরাধীন-চাকর নিজ ইচ্ছানুযায়ী চলতে পারে না, চলা উচিত নয়। যে চাকর নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী চলে তার ভুল হয়, পারে না, আটকে যায়। মালিক খুশি হয় না, একসময় সে চাকরি হারায়। নিজ ইচ্ছানুযায়ী চলা এক চাকরের উদাহরণ। ইবলিস-এক জিন। স্রেফ তার নিজস্ব সিদ্ধান্তে আদমকে সিজদা করতে অস্বীকার করে। সে কারোও সাথে পরামর্শ করেনি, মালিকের মতামত নেয়নি। অন্যদিকে আর কেউই তাকে এ ব্যাপারে প্ররোচনা বা উস্কানি দেয়নি। বরং যে মালিক তাকে সামান্য জিন থেকে ফেরেশতাদের মধ্যে সামিল করেছিলেন সে মালিকের সাথে নিজের আন্দাজ-অনুমানভিত্তিক যুক্তি উপস্থাপন করে, বিতর্ক করে। মালিক তার প্রতি রাগান্বিত হয়ে তাকে বহিষ্কার করেন। যে নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী চলে ধ্বংস হয়, সে অন্যকেও নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী ধ্বংসের দিকে নিতে ইচ্ছা করে। সেজন্যেই ইবলিস আদমকেও তাঁর নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে উসকানি দেওয়া-উদ্বুদ্ধ করার ঘোষণা দেয়। অন্যদিকে মালিকের ইচ্ছানুযায়ী চলাতেই যে চাকরের সুখ-শান্তি-সম্মান-সমৃদ্ধি তার উজ্জ্বল প্রমাণ-আমাদের চারপাশের যে কোন সৃষ্টির প্রতি নজর দিলে অতি সহজেই বুঝা যায়-যেমন-ফেরেশতা। যারা প্রতিটি বিষয়ে সবসময় সারাটা জীবন আল্লাহর সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা হুবহু প্রতিপালন করে। কোন বিষয়ে সামান্যতম এদিক-সেদিক করার ক্ষমতা নেই। সেজন্যে তাদের কোন সমস্যাও নেই।
চাঁদ সূর্য হিমালয় সাগর মহাসাগর রাত ও দিনের আবর্তন, মাটি পানি আলো বাতাস, উদ্ভিদ ব্যাক্টেরিয়া ভাইরাস কীটপতঙ্গ পাখপাখালির প্রতি খেয়াল করলে সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা যায় তাদের কোন একান্ত ব্যক্তিগত স্বপ্ন-চাওয়া-পাওয়া নেই। তাদের সবকিছু পরিপূর্ণভাবে শুধু আল্লাহরই নিয়ন্ত্রণে। তাদের কোন ভবিষ্যত নেই, দোযখ নেই-বেহেশত নেই। তবুও তারা সবাই কত তৃপ্ত সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট। আল্লাহর প্রতি তাদের আনুগত্য কি নিখুঁত। তারা প্রমাণ করেছে আল্লাহর গোলামীতেই তাদের স্বস্তি শান্তি ও সাফল্য। সৃষ্টিজগতের সবখানে যে শৃঙ্খলা যে সাম্য ও সহযোগিতা তা শুধুই আল্লাহর নিখুঁত গোলামীর কারণে। সে জন্যে একদিকে তাদের কোন পুণ্যও নেই, অন্যদিকে তাদের কোন পাপ নেই, শাস্তির ভয় নেই। কারণ তারা দায়িত্বে কোন অবহেলা করেনি। মালিকের নির্দেশ পালনে তারা কত মনোযোগী, কত আন্তরিক, কত দায়িত্বশীল।
এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ। মানুষের রয়েছে নিজস্বতা, ইচ্ছাশক্তি, প্রবৃত্তি, আমিত্ব, নাফস। আমিত্বের কারণে মানুষ আল্লাহর দেওয়া জীবন নিয়ে খেলা করে, আল্লাহর সময়কে নিজের ইচ্ছামত ব্যবহার করে, আল্লাহর দেওয়া জ্ঞানকে নিজেদের অর্জন বলে দাবি করে, আল্লাহর হুকুমকে অবিশ্বাস করে, তাঁর নিষেধকে লংঘন করে, তাঁর সম্পদ ইচ্ছামত উপার্জন করে আর নিজ খেয়াল খুশিমত ব্যয় করে। আমিত্বই মানুষকে মালিকানার স্বপ্ন দেখায়। অন্যান্য সৃষ্টিকে তার অধীনস্থ ভাবে। সেগুলিকে হাত করে সে আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধে পর্যন্ত নামে। কিন্তু অত্যন্ত রূঢ় বাস্তবতা হলো মানুষ যেহেতু নিজস্ব চিন্তা-চেতনা বা চাহিদা থেকে সৃষ্টিই হয়নি, সেহেতু মানুষ নিজস্ব চিন্তা-চেতনা-চাহিদা দিয়ে সফল তো হতে পারেই না, বরং পদে পদে নানা বিড়ম্বনার শিকার হয়।
আমিত্ব দিয়েই মানুষের পরীক্ষা। আমিত্বই মানুষের সর্বনাশ। আমিত্বই মানুষের অন্য সৃষ্টির মত আল্লাহর প্রিয় গোলাম হওয়ার পথের বাধা। আমিত্ব মানুষকে এমনকি আল্লাহ হওয়ার স্বপ্ন দেখায়। আল্লাহমুক্ত জীবনের অস্বাভাবিক কর্মধারায় মানুষ তখন খুব সহজেই শয়তানের অনুসরণ করে। মানুষের এ ইচ্ছাশক্তি/ প্রবৃত্তি/আমিত্ব/নাফস এর উপরে প্রভাব বিস্তার করেই বিশেষ করে মানুষের প্রাণের দুশমন শয়তান মানুষকে তার বিশ্বাস কাজ-কর্ম ও আচার-আচরণের মৌলিক অবস্থা থেকে বিচ্যুত করে। মানুষকে নানা প্রকার পাপের মধ্যে ডুবিয়ে দেয়। মানুষের জীবনকে বিষিয়ে তোলে। নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাই মানুষের জন্যে মূল সমস্যা। উদাহরণ-
শয়তানের প্ররোচনায় আদম দম্পতি জান্নাতে নিষিদ্ধ ফল খেয়েছিলেন। এ বিষয়ে তাঁরা মালিকের সাথে কোন পরামর্শ বা মতামত না নিয়েই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। মালিককে বিষয়টি জানালে কোনভাবেই ভুল হতো না।
উত্তোরণ প্রক্রিয়া-ইবলিসের প্ররোচনার আগে আদম ও তাঁর স্ত্রী নিজ থেকে কখনও নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার ইচ্ছা করেননি, সেজন্যে নিষিদ্ধ ফল খাওয়ামাত্র মালিকের সুনির্দিষ্ট নিয়মে আদম দম্পতির প্রতিক্রিয়া হলো এবং পোশাক খুলে গেল। এতে তাঁদের ভুল ভাঙলো। মালিক হালকা ভর্ৎসনা করে তাঁদেরকে আবারো ইবলিসের ব্যাপারে সাবধান করে দিলেন এবং নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার ভুল ক্ষমা করলেন। মজার ব্যাপার হলো মানুষ ছাড়া আর অন্য কোন সৃষ্টিকে ইবলিসের ব্যাপারে সাবধান করা হয়নি। একমাত্র কারণ তাদের নিজস্বতা নেই, ফলে তাদের পেছনে ইবলিস লাগে না।
পরবর্তী অবস্থা-পৃথিবীতে আদম-ইবলিস দ্বন্দ্ব অব্যাহত-নিজস্বতা থেকে বেঁচে থাকার প্রচেষ্টারত মানুষদেরকে রক্ষায় মালিকের সহযোগিতাও অব্যাহত। মালিকের দয়ার অনুপম পদক্ষেপ-বছরে এক মাস-রমযান। রমযানে ইবলিস বন্দি থাকে, নিজস্বতা অস্বীকারকারীরা নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী না চলে মালিকের ইচ্ছানুযায়ী চলার সুযোগ পায়। মালিক তাদেরকে ক্ষমা করেন-উদ্ধার করেন-রক্ষা করেন। মালিকের ইচ্ছা অনুযায়ী চলতে চায় এমন চাকরের জন্যে অত্যাবশ্যক হয় মালিকের দিক-নির্দেশনার। মালিকের সেই দিক-নির্দেশনাই হলো আল কুরআন-যা মালিক রমযানে প্রেরণ করেছেন।
কুরআন দিয়ে কী করব? মালিকের দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ সম্পাদন করা। সেজন্যে প্রয়োজন হবে পড়া/তিলাওয়াত-মুখস্থ-ব্যকরণ-ভাব-ভাষা-অর্থ-বুঝা-ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ জানা। যে কোন সমস্যায় মালিকের সাথে কথা বলবে, পরামর্শ নিবে, ভুল হলে ক্ষমা চাইবে, সংশোধন করবে। মালিক তো দিনে অন্তত ৫ বার আমাদেরকে সরাসরি তাঁর সাথে সুবিধা-অসুবিধা শেয়ার করার ব্যবস্থা করেছেন ৫ ওয়াক্ত নামাযে-যেখানে মূলত: পড়া/তিলাওয়াত-মুখস্থ-ব্যকরণ-ভাব-ভাষা-অর্থ-বুঝা-ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের খুবই কার্যকরী ব্যবস্থা রয়েছে।
আরবী কুরআন দিয়ে অনারবরা কিভাবে কী করবে?
পড়া-তিলাওয়াত-মুখস্থ-ব্যকরণ-ভাব-ভাষা-অর্থ-বুঝা-ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এতকিছু সম্ভব নয় বলে কুরআন বাদ দিয়ে দিবে? শুধু পড়া-তিলাওয়াতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে? দু-চারটি ছোট সূরা/আয়াত শুধু মুখস্থ করবে? দু-চারজন এমনকি পুরো আরবী কুরআন শুধু মুখস্থ করেই দায় সারবে? কেউ কেউ দু-চারটি ছোট সূরা/আয়াতের অর্থ শিখেই শেষ করবে? হাতে গোনা ৫-৭ জন একটু আধটু ব্যকরণ-ভাব-ভাষা-বুঝবে, কিছুটা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করবে? তাহলে দৈনন্দিন জীবনের সুবিশাল অঞ্চলের সীমাহীন বিষয়াদী মালিকের দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী পালন করা কি সম্ভব হবে? যদি তা নাই হয় তাহলে কী হবে? সবকিছু আমাদের ইচ্ছামত-মনমত-অভ্যাস মতই হবে, ফলে শয়তান আমাদেরকে পথ দেখাবে। এমতাবস্থায় নামায-রোজা-কুরআন ইত্যাদি নিজ ইচ্ছা-অভ্যাস ও সুবিধা-অসুবিধা অনুযায়ী ব্যবহারকারীদেরকে মালিকের দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী এসব করতে বললে বিরক্ত হবে, এসব বিষয়ে এভাবে এতটা করা সম্ভব নয়-সময় নেই-অনেক কঠিন, যা পারি করি-হলে হোক না হলে না হোক-ইত্যাদি নানাবিধ মন্তব্য করবে। আর কুরআনকে নিয়ে তারা শুধুই সওয়াবের হিসাব গুনবে।
অন্যদিকে মালিকের ইচ্ছা ও নির্দেশনা অনুযায়ী জীবনযাপন করতে আগ্রহীরা শক্তভাবে কুরআন ধরবেন, ফলে মালিকের সিদ্ধান্তে চলবেন, সেজন্যে শয়তানের প্ররোচনা থেকে বেঁচে থাকবেন।
রমযান তো চলে গেছে, কিন্তু কুরআন রেখে গেছে। রমযান থাকতে যারা কুরআন ধরেছি এখনও যদি তা শক্তভাবে ধরে রাখি তাহলে রমযান না থাকলেও কোন অসুবিধা নেই। রমযানেই যারা কুরআন ধরেননি-তাঁরা এখনও কুরআন ধরতে পারেন, কোন অসুবিধা নেই। যদি না ধরেন তাহলে আপনার নিজস্বতা-আমিত্ব-নাফসই দায়ী। অন্য আর কেউ নয়। কে কিভাবে কতটুকু কুরআন ধরতে পারলাম সে অনুযায়ীই পরিমাপ করা যাবে কার রমযান কিভাবে কতটুকু সফল হয়েছে।
রমযানেই হোক আর এখনই হোক, কুরআন ধরতে না পারার একমাত্র কারণ নিজস্বতা-আমিত্ব-নাফস। নিজস্বতা-আমিত্ব-নাফস না থাকলে শয়তান কাজ করতে পারে না, নিজস্বতা-আমিত্ব-নাফস থাকলে কুরআন বাদ দিতে শয়তান লাগে না।
আমিই যখন পারি তখন আর অন্য কাউকে লাগবে কেন?
আমি না পারলে যে পারে তার কাছে তো যেতেই হবে।
খুব ভালভাবে খেয়াল করতে হবে-কুরআন পড়া/তিলাওয়াত-মুখস্থ-ব্যকরণ-ভাব-ভাষা-অর্থ-ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ বুঝা সবকিছু কি মালিকের দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী হচ্ছে নাকি এখানেও আমার-আমাদের মন/পছন্দ/ইচ্ছা কাজ করছে? কুরআনের শিক্ষক-ছাত্র-প্রচারক-গবেষক সবাই যেন কুরআন বিষয়ে মালিকের দিক-নির্দেশনা সঠিকভাবে উপলব্ধি ও যথাযথভাবে পালন করতে পারি সুমহান মালিকের কাছে সে প্রার্থনা করি। আমীন।
লেখক : সাবেক অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।