মনসুর আহমদ
ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লীতে চলন্তবাসে গত ১৬ ডিসেম্বর গণধর্ষণের শিকার হওয়া ২৩বছর বয়সী মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রী জ্যোতি সিং পাণ্ডে জীবন দিয়ে সভ্যজগতকে জানিয়ে দিল যে, তোমাদের সভ্যতার দাবি মিথ্যা। সভ্যতার মুখোশে ঢাকা মুখের পেছনে মানুষ নামের কলঙ্ক অসভ্যরা সমাজকে লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে। অসভ্যতার চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে টাইমস অব ইন্ডিয়ার বরাত দিয়ে ২৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশের একটি পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়েছে, জাতীয় অপরাধ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী মুসলিম বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ রাষ্ট্র পীর আওলিয়াদের দেশ বাংলাদেশে ১৯৭১ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ৮৭৩.৩০শতাংশ হারে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে। ১৯৭১ সালে ২৪৮৭টি ধর্ষণের ঘটনার বিপরীতে ২০১১ সালে ঘটেছে ২৪২০৬টি ধর্ষণের ঘটনা। অথচ ১৯৫৩ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ছয় দশকে হত্যার মতো অপরাধ বেড়েছে ২৫০ শতাংশ। পাশাপাশি গত বছরে ভারতের মধ্যপ্রদেশে ৩৪০৬টি, পশ্চিম বঙ্গে ২৩৬৩টি, উত্তর প্রদেশে ২০৪২টি রাজস্থানে ১৮০০টি মহারাষ্ট্রে ১৭০১টি, আসামে ১৭০০টি ও অন্ধ্র প্রদেশে ১৪৪২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। শুধু ধর্ষণই নয়, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সাথে পালল্লাদিয়ে দিন দিন বেড়ে চলছে নারী নির্যাতন। এক রিপোর্টে প্রকাশ বাংলাদেশে ২০১২ সালে যৌতুকের কারণে নিহত ২৭০ জন, ইভটিজিং-এর শিকার ১৬৪ জন, ইভটিজিং পরে হত্যা ২৯ জন, ধর্ষিতা হয়েছে ৬০২জন এর মধ্যে ২২০ জন নারী এবং ৩৮২জন শিশু।
ধর্ষণের মতো ভয়াবহ ও নৃশংস ঘটনা শুধু যে ভারত-বাংলাদেশে ঘটছে তা নয় । অন্যান্য দেশেও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে চলছে। মূলত এ অমানবিক কাজটির মহোৎসব চলছে বিশ্বময়। এফবিআই ইউনিফরম রিপোর্টস ১৯৮১ তে প্রকাশ হয়েছে আমেরিকায় এক বছরে নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৮১, ৫৩৬টি। এফবিআই-এর মতে এ তথ্যই পরিপূর্ণ নয়। বরং ধর্ষণের অপ্রকাশিত সংখ্যা হবে কমপক্ষে এর দশ গুণ। ১৯৯২ সালের ২৪ এপ্রিল রয়টার পরিবেশিত সংবাদ-এ প্রকাশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১৯শত মহিলা ধর্ষণের শিকার হয়, ১৯৯৪ সালে ২লাখ ৭ হাজার ৬১০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ১৯৯৩ সালে আমেরিকায় দেড় লাখের বেশি নারী ধর্ষণের শিকার হয়, ১৯৯৪ সালের ২৫ জুলাই ইউএসআই-এর পরিবেশিত খবরে প্রকাশ, এই আমেরিকায় প্রায় সেকেণ্ডে একজন মহিলা ধর্ষিতা হয়।
ইটালীতে প্রতি ঘন্টায় একজন মেয়ে তার সতীত্ব হারাচ্ছে। ১৯৯৫ সালে ফ্রান্সে গঠিত মেডিকেল বোর্ড ঘোষণা করছে যে সে দেশে একজনও সতী নারী নেই। Review Burean of Police Research and Development থেকে পাওয়া এক তথ্যে জানা যায়, ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত এই দশ বছরে সেখানে নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে যথাক্রমে ৩৮৯৩, ৬২০৩, ৪০৫৮, ৪৫৫৮, ৪৩০০, ৫০২৩, ৫৪০১, ৫৪২৭, ৫২৯৮, ৬২০৩, ৬৩৫৬টি।
বৃটেনের অবস্থাও এমন। বিলেতের ‘নাইনটিন’ নামের একটি ম্যাগাজিনে ১৯৮০ সালে ১০ হাজার বিলাতি মেয়ের উপর জরিপ চাালিয়ে বড়ই দুঃক্ষের সাথে বলেছে, এ সমাজে কুমারী কনে পাওয়া অত্যন্ত দুর্লভ। ১৯৫৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর এএফবি-এর খবরে প্রকাশ, লণ্ডনের ক্যান্টবেরী কাউন্সিলের স্বাস্থ্য দফতরের মেডিকেল অফিসার ডা. জে.এ.স্কট বিবৃতি প্রদান করেছেন যে, লণ্ডনে ১০% অবৈধ সন্তান জন্মগ্রহণ করে এবং অবৈধ জন্মহার ক্রমেই বেড়ে চলছে।
পশ্চিমা দেশের এ অভিশপ্ত অনাচার পশ্চিমা সংস্কৃতির অংগ হিসেবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে চলছে। উপরে বর্ণিত হিসাব ছাড়াও আর এক হিসাব মতে বাংলাদেশে ২৪ ঘন্টায় প্রায় অর্ধশত মহিলা ধর্ষণের শিকার হয়। পুলিশ প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত ধর্ষিতার সংখ্যা ২৪৭০ জন। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫২৫টি, ১৯৯৭ সালে ধর্ষিতা হয়েছে ১৩৭৩ জন। ১৯৯৮ সালে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২৯৬০টি, ১৯৯৯ সালে ধর্ষিতা হয় ৩৫০৪ জন। ২০০১ সালের প্রথম চার মাসে ১১১২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে।
সম্প্রতি টাঙ্গাইলে গণধর্ষণের শিকার স্কুলের ছাত্রী, টাঙ্গাইলে গণধর্ষণের রেশ কাটতে না কাটতে চট্টগ্রামে গণধর্ষণের শিকার আর এক তরুণী। এ ধরনের প্রতিদিনের নানা বিভৎস খবর নারী সমাজকে বড়ই ভাবিয়ে তুলছে। তা হলে কি নারী তার ইজ্জৎ, সম্মান ও শ্লীলতা অক্ষুণ্ন রেখে সমাজে বেচে থাকতে পারবে না ?
নারী জাতির ইজ্জত বাঁচাতে নারী পুরুষ সবকেই এগিয়ে আসতে হবে। পুরুষের দিকে তাকিয়ে নারী এ অপমান ভার আর কত দিন সইবে? পুরুষ শাসিত সমাজে নারী যদি এ ব্যাপারে তৎপর না হয় তা হলে নারীদের এ অপমান, লজ্জা কোন দিনই লাঘব হবে না।
তাই এ ব্যাপারে নারীদের প্রধান কাজগুলি হবে : ক] নিজেদের চেহারা-সুরতকে পরপুরুষদের থেকে হেফাজত করা। ইসলাম যে পোশাক পরিধানে নারীদেরকে উৎসাহিত করেছে সে পোশকে নিজেদের ইজ্জত-আব্রুর হেফাজতে যত্নবান হতে হবে নারী সমাজকে। নারীর প্রতিটি অঙ্গই পুরুষদের কাছে আকর্ষণীয় করে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই নারীদের এমন পোশাক পরিধান করে পথেঘাটে চলাফেরা উচিত হবে না যার ফলে পুরুষ মানুষ তার দিকে আকর্ষণ অনুভব করতে পারে। এ ব্যাপারটি দেরীতে হলেও বুঝতে পেরেছে ভারতের বুদ্ধিমান সমাজ। খবরে প্রকাশ ভারতে ধর্ষণযজ্ঞ বন্ধে নতুন যেসব আইনের খসড়া করা হয়েছে তাতে মেয়েদের স্বল্প পোশাক পরিহারের বিষয়টিকে গুরুত্ত্ব দেয়া হয়েছে। ভারতে পণ্ডিচেরী রাজ্য প্রদেশে সরকার এরই মধ্যে শিক্ষার্থীদের জন্য আপাদমস্তক ঢাকা যায় এমন ওভার কোট পরা বাধ্যামূলক করতে যাচ্ছে। যখন অমুসলিমরা বিষয়টি অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছে তখন মুসলমানের দেশে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মেয়েদেরকে উলংগপনায় অভ্যস্ত করতে চলছে শত প্রচেষ্টা।
এখানেই শেষ নয়, রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় মত্ত হয়ে যে নারীগোষ্ঠী সমাজে পর্দা প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে, চরিত্রবান সমাজ গঠনে নিজদেরকে সোপর্দ করেছে সেসব পর্দানশীন মহিলাদের মুখ থেকে তাদের আবাল্য লালিত বোরকা খুলে ফেলার ধৃষ্টতা দেখাতে প্রশাসন কর্তৃপক্ষ এতটুকু সমীহ করছে না। প্রতিপক্ষকে অপমান করার অন্তরালে যে তারা গোটা সম্ভ্রান্ত নারী সমাজের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছূড়ে দিয়েছে তা কি তারা অনুধাবন করার যোগ্যতা রাখে না? এভাবে একদিকে স্কুল কলেজ ও ভদ্র পরিবারে ছাত্রীদেরকে বোরকা পড়তে বাধা দেয়া হবে, প্রতিপক্ষকে হেয় করার জন্য মুসলমান নারীদেহ থেকে বোরকা খোলার মহোৎসব চলবে অপরদিকে দেশ থেকে নারী ধর্ষণ বন্ধ হবে এমন আশা করা কোন প্রকারেই সুস্থ মস্তিষ্কের লক্ষণ হতে পারে না। খ] নারীদেরকে পর্দা অনুশীলনে আগ্রহী ও অভ্যস্থ হতে হবে। দিলের পবিত্রতা রক্ষার জন্য এর দ্বিতীয় কোন বিকল্প নেই। আলাহ নিজেই বলেন, “ তোমাদের ও তাদের দিলের পবিত্রতা রক্ষার জন্য এটিই উপযুক্ত পন্থা।” [সুরা আল অহজাব -৫৩]।
নারী পুরুষদের মিলিত বৈঠক, সভাসমিতি, সহশিক্ষা এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও অফিস আদালতে নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা হবে আর নারী দের প্রতি পুরুষেরা ঝুঁকে পড়বে না এমনটি মনে করা এটি প্রকৃতি বিরুদ্ধ চিন্তা। তাই এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের করণীয় অনেক। বাংলা দেশের মতো এমন ধর্ষণ প্রবাহ আমার জানা মতে পৃথিবীর দ্বিতীয় কোন মুসলিম দেশে নেই। কারণ সব দেশে বেশি কম হলেও ইসলামী মূল্যবোধ ও পর্দার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বর্তমান। তাই আমাদের দেশ পরিচালনার দায়িত্বশীলদের এ বিষয়ে ও সব দেশ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
গ] রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সমাজের বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে নারীদের কর্মক্ষেত্রকে আলাদা করে দিতে হবে। চাকর গ্রহণের ব্যাপারে যদি নারীরা একটু সতর্ক হন তাহলে পুরুষদেরকে এড়িয়ে চলা সহজ হবে। নারী-পুরুষের মধ্যে একটা নিরাপদ দূরত্ব থাকলে নারী ইজ্জত বিনষ্ট হবার সম্ভাবনা কমে যাবে। অমি একবার পোল্যাণ্ডে গিয়েছিলাম । সেখানে দেখেছি হাল্কা ধরনের কাজে নারীদেরকে এবং ভারী কাজে পুরুষদেরকে লাগান হয়েছে। তাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব এ ভাবে নারী-পুরুষের কর্মক্ষেত্র আলাদা করে দেয়া। এবং নারীদেরও উচিত কর্মক্ষেত্র বাছাইয়ের ব্যাপারে নিজদের আরও সচেতন হওয়া।
ঘ] নারী ধর্ষণ ও নির্যাতন বন্ধে রাষ্ট্রের মৌলিক কাজ সমাজের সর্বস্তরে খোদা ভীরু চরিত্র সৃষ্টির প্রয়াস। নারী -পুরুষ সবাই খোদা ভীরু হলে পাপের এই ভয়ানক সয়লাব বন্ধ হবে। একটি উদাহরণ মক্কা মদীনায় হজ্জের মওসুম। যারা হজ্জে গিয়েছেন তারা দেখেছেন মক্কায় খানায়ে কাবাকে ঘিরে মহিলা-পুরুষ একসাথে কাবা তওয়াফ করছে, সাফ মারওয়া সায়ী করছে, পাশাপাশি অবস্থান করে নামায আদায় করছে। এত লক্ষ লক্ষ পুরুষ ও মা-বোনদের সমাবেশে নারীদের প্রতি সামান্যতম অসৌজন্যমূলক কোন আচরণ হয়েছে এমন কোন নজীর নেই। কারণ হল মনের পবিত্রতা। তাই আল্লাহ আমাকে দেখছেন এমন অনুভুতি মনে সৃষ্টি হলে সমাজ থেকে সব ধরনের অন্যায় পাপ মুছে যাবে। এব্যাপারে ব্যক্তিকে অতিক্রম করে রাষ্ট্রের দায়িত্ব অনেক বেশি।
ঙ [ শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারসহ সংস্কৃতি ক্ষেত্র কে বেহায়াপনা ও অশ্লীলতা মুক্ত করতে হবে। ভারতে গণধর্ষণ যেন তাদের সংস্কৃতিতে পরিণত হতে চলেছে। এর প্রধানতম কারণ তাদের দেশের অপসংস্কৃতি। বলিউডের সিনেমায় অশীল নৃত্যগীতের প্রচলন, পর্ণো ছবির ছয়লাব স্টেজ শোতে স্বল্প বসনাদের যৌন উত্তেজক নৃত্য পরিবেশন ইত্যাদি ধর্ষণের মূল চালিকা শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আকাশ সংস্কৃতির বদৌলতে এ সব নোংরামী বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। যার পরিণতি দেশে এই ধর্ষণ প্রবাহ। আজ তাই বাংলাদেশ থেকে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ বন্ধ করতে হলে অপসংস্কৃতির সয়লাব বন্ধ সহ ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠাই রাষ্ট্রের প্রধান কাজ হওয়া প্রয়োজন।
চ] ধর্ষণ বন্ধের জন্য প্রয়োজন ইসলামী বিধান অনুযায়ী ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক দ্রুতবিচার সম্পন্ন করা। আইনের ফাঁক দিয়ে যেন এসব পাপীরা এড়িয়ে যে তে না পারে সে দিকে কড়া নজর প্রদান নারী পুরুষ সবার নাগরিক দায়িত্ব। আমাদের দেশে ধর্ষিতারা নিন্দিত হয় সমাজ তাদেরকে ঘৃণা করে এ মনোভাব বদলাতে হবে। ধর্ষকদেরকে ঘৃণা করতে হবে, ওদেরকে সামাজিকভাবে বয়কট করেতে হবে। ধর্ষণে সেঞ্চুরী করে যে দেশে ধর্ষকরা পুরষ্কৃত হয় সে দেশে নারী ধর্ষণ বন্ধ হবে এমন ভাবনা পাগলের কাজ ব্যতিত কিছু নয়। ধর্ষিতারা জুলুমের শিকার, যে সমাজের পুরুষেরা তাদের জায়া কন্যা জননীদেরকে ধর্ষকদের ব্যাঘ্র নখর থেকে রক্ষা করার যোগ্যতা রাখে না তাদের কোন অধিকার নেই ধর্ষিতাদেরকে হেয় জ্ঞান করার। হে নারী সমাজ, আপনারা জেগে উঠুন, নিজেদের ইজ্জত বাঁচাতে দৃঢ় মনোবল ও সাহস নিয়ে সমাজের কুলাঙ্গার সারমেয়দের বিরুদ্ধে লোষ্ট্র হাতে নিয়ে শক্ত পায়ে দাঁড়ান ।
লেখক : প্রাবন্ধিক।