আগস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে আওয়ামী রেজিমের বিদায়ের পর রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। কারণ, পতিত স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদ রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোগুলো পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে। ধ্বংস করা হয়েছে দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। দলীয়করণ করা হয়েছিলো জনপ্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, শিক্ষাপ্রশাসন, বিচারবিভাগসহ রাষ্ট্রের সকল অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোকে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনকে পরিণত করা হয়েছিলো দলদাস কমিশনে। আর দুর্নীতি দমন কমিশনকে পরিণত করা হয়েছিলো বিরোধী দল নিগ্রহ ও সরকারি দলের নেতাদের দায়মুক্তির জন্য ‘দায়মুক্তি কমিশন’ হিসাবে। তাই আওয়ামী রেজিমের পতনের পর রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি উঠেছে এবং দাবি বাস্তবায়নের জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু আমরা একথা বেমালুম ভুলে যাচ্ছি যে, শুধু রাষ্ট্র সংস্কার হলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে সকল সমস্যার সমাধান হবে না এবং এ জন্য চাই প্রচলিত রাজনীতির সংস্কার। একই সাথে রাজনীতিকদের আত্মসংস্কারও।

মূলত, গণমানুষের কল্যাণের ধারণা থেকেই রাজনীতির বুৎপত্তি ঘটেছে। রাজনীতির উদ্ভব হয়েছে মানবসভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে রাজার রাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার মধ্য দিয়ে। মেকিয়াভেলী রচিত ‘ The Prince ’ গ্রন্থটি রাজতন্ত্রের চরিত্র ও স্থায়িত্ব নিয়ে বলিষ্ঠ ও প্রাণবন্ত বিশ্লেষণ করেছে। বস্তুত, রাজনীতি হলো এমন এক বিশেষ চেতনা বা আদর্শ; যার উদ্দেশ্য শৃঙ্খলাবোধ, নিয়মানুবর্তিতা সর্বপরি মানবকল্যাণ। কিন্তু আমাদের দেশের চলমান রাজনীতির প্রেক্ষাপটে তা যে ছন্দ ও স্বরূপ উভয়ই হারিয়েছে বেশ আগেই। তাই রাজনীতি থেকে আমরা কাক্সিক্ষত কল্যাণ পাচ্ছি না।

রাজনীতি এমন এক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কিছুসংখ্যক বা বহুসংখ্যক ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত কোন গোষ্ঠী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার নিমিত্তে ঐক্য স্থাপন করে। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে রাজনীতিতে স্বার্থবাদিতা, উচ্চাভিলাষ ও আত্মপূজার অনুষঙ্গ যুক্ত হওয়ায় তা স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য হারিয়েছে। রূপ, রস, গন্ধ ও আবেদনও হারিয়ে ফেলেছে চলমান রাজনীতি। পাত্র-মিত্রদের ধারাবাহিক ব্যর্থতার কারণেই রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ অদৃশ্য ও অশুভ শক্তির হাতেই চলে গেছে। যা আমাদের জাতিসত্তার ভিত্তিমূলকেই নড়বড়ে করে দিয়েছে।

ক্ষমতাকেন্দ্রিকতা এবং স্বার্থান্ধতা আমাদের রাজনীতির জীবনী শক্তিকে চলৎশক্তিহীন করে ফেলেছে। সঙ্গত কারণেই রাজনীতি হারিয়েছে গণমুখী চরিত্র। স্থান করে নিয়েছে আত্মস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ, শ্রেণিস্বার্থ, সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থসহ শ্রেণি বিশেষের উচ্চাভিলাষ। এমতাবস্থায় সাধারণ মানুষ রাজনীতিবিমুখ হতে শুরু করেছে। বিষয়টি নিয়ে তেমন বিতর্ক না থাকলেও ক্ষমতাবানরা তা বরাবরই উপেক্ষা করে এসেছে। তারা মনে করছেন, রাজনীতি তার নির্দিষ্ট কক্ষপথেই যথারীতি আবর্তিত হচ্ছে এবং এর সুফলও ভোগ করছেন দেশের মানুষ। যদিও বাস্তবতার সাথে তার তেমন কোন মিল দেখেন না দেশের আত্মসচেতন মানুষ। মূলত, রাজনীতি এখন শ্রেণিবিশেষের উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ ও আত্মপূজার মোক্ষম হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। আর এ বৃত্ত ভাঙা অরাজনৈতিক সরকারের পক্ষে সহজসাধ্য হচ্ছে না একশ্রেণির রাজনীতিকদের অসযোগিতার কারণেই।

আমাদের জাতীয় রাজনীতির এ বিচ্যুতি ক্ষমতাবানদের কাছে কখনোই গুরুত্ব পায়নি। বিশেষ করে রাজনৈতিক শক্তিগুলোর কাছে। কিন্তু ঠিকই গুরুত্ব পেয়েছে ক্ষমতাহীন ও সাধারণ মানুষের কাছে। অবশ্য পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী বিষয়টি কিছুটা হলেও উপলব্ধি করেছেন বলেই মনে হয়েছিলো। তদানীন্তন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রীর একটি বক্তব্যে সে কথারই প্রতিফলন দেখা গিয়েছিল। তিনি দেশ ও জাতির কল্যাণে রাজনীতিকে আরও পরিশীলিত, পরিমার্জিত ও সৃজনশীল করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন তার এক বক্তব্যে। সাবেক এ মন্ত্রীর একথার মাধ্যমে স্পষ্টই প্রমাণ হয় যে, আমাদের দেশের চলমান রাজনীতি নানাবিধ জটিলতায় ঘুরপাক খেয়েছে। তাই রাজনীতিতে বড় ধরনের সংস্কার সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি। তিনি অকপটে স্বীকার করেছিলেন যে, ‘নীতির রাজাকে ধারণ ও চর্চা করাই হচ্ছে রাজনীতি। এজন্য রাজনীতিকে আরও পরিশীলিত, পরিমার্জিত এবং সৃজনশীল করা দরকার। রাজনীতি যদি সৃজনশীল না হয় তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ ভালো হওয়ার অবকাশ থাকবে না। রাজার নীতিকে রাজনীতি বলা থেকে দূরে সরে এসে শ্রেষ্ঠ নীতি, নৈতিকতা, সততা ও মূল্যবোধকে ধারণ করতে রাজনীতি অর্থবহ ও ফলপ্রসূ হয়ে উঠবে। যখন সৎ, ন্যায়নিষ্ঠ ও ভালো মানুষের কদর কমে যায় তখন সমাজ ব্যবস্থা ও সভ্যতা ধ্বংসের মুখোমুখি হয়ে পড়ে। রাজনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো সমন্বিত চিন্তা ধারণ, লালন, চর্চা এবং বিশ্বাস। রাষ্ট্রের একজন সাবেক নির্বাহীর এমন বোধোদয় বা আত্মপোলব্ধি এবং তার বাস্তবপ্রয়োগ আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে বড় ধরনের ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হলেও তিনি নিজেই সে অশুভ বৃত্ত ভাঙতে পারেন নি বা ভাঙার চেষ্টাও করেন নি। তিনি আমাদেরকে নীতিবাক্য শুনিয়েই দায় শেষ করেছেন। অপরাজনীতির দুধ-কলা সবই উদরস্থ করেছেন। এসবই হলো রাজনীতিকদের দ্বিরাচারিতা; জাতির দুর্ভাগ্য।

একথা সত্য যে, আমাদের দেশের রাজনীতি এখন একশ্রেণির সুবিধাবাদী মানুষের নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের বৃত্তেই বৃত্তাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই আমাদেরকে এ অশুভ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। যারা রাজনীতি করতে চান, তাদের শুধু ক্ষমতাকেই রাজনীতি মনে না করার তাগিদ এসেছে বিবেকবান ও আত্মসচেতন মানুষের পক্ষ থেকে। জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে ন্যায়, সততা ও আদর্শের রাজনীতিকে ধারণ করাও এখন সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি হয়ে দেখা দিয়েছে। সে কথারই পরোক্ষ প্রতিধ্বনি শোনা গিয়েছিলো সাবেক মন্ত্রীর নিকট অতীতের বক্তব্যে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের পিছু ছাড়েনি।

ভিন্নমত রাজনীতির একটি অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গ। এতে বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। যার মধ্যে আছে কারও নিজস্ব রাজনৈতিক অভিমত মানুষের মাঝে প্রচার করা, অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে মতবিনিময় ও আইন প্রণয়ন। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় মানুষ প্রায়ই নিজস্ব মতবাদ তুলে ধরতে রাজনৈতিক দল গঠন করে। দলের সভ্যগণ প্রায়শই বিভিন্ন বিষয়ে সহাবস্থানের ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করে। এক্ষেত্রে নির্বাচন হল সাধারণত বিভিন্ন দলের মধ্যে একটি প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতার উদ্দেশ্য আর্ত-মানবতার কল্যাণ ও জাতীয় স্বার্থ। তাই রাজনীতি কখনো কারো উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার অনুষঙ্গ হতে পারে না। কিন্তু নিকট অতীতে আমাদের দেশে রাজনীতিতে এমন অশুভ চর্চা হয়েছে। এখন এ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার একটি ভালো সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তা আমরা কতখানি কাজে লাগাতে পারছি, তা-ই এখন দেখার বিষয়।

রাজনৈতিক ব্যবস্থা হলো এমন কাঠামো যা কোন সমাজের মধ্যকার গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক পদ্ধতিসমূহকে সংজ্ঞায়িত করে। রাজনৈতিক চিন্তার ইতিবৃত্ত খুঁজে পাওয়া যায় অতিপ্রাচীন যুগে; যেখানে প্লেটোর রিপাবলিক, এরিস্টটলের রাজনীতি, চাণক্যর অর্থশাস্ত্র ও চাণক্য নীতি এবং কনফুসিয়াসের লেখার ন্যায় দিগন্ত উন্মোচনকারী কাজগুলোর মধ্যে। মূলত, রাজনীতি সাধারণ অর্থে নাগরিক ও রাজনৈতিক শক্তির সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মকাণ্ডকে বোঝানো হয়। রাজনীতি কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার ভিত্তিতে গঠিত সামাজিক সম্পর্ক নিয়ে গঠিত। উইলিয়াম কেরি তার বাংলা অভিধানে রাজনীতি শব্দের অর্থ করেছেন রাজন্য (the king) ) + নীতি (justice), অর্থাৎ রাজার ন্যায়বিচার। বার্নার্ড ক্রিক দাবি করেন যে, ‘রাজনীতি হলো নীতিমালার একটি স্বতন্ত্র রূপ, যার দ্বারা মানুষ নিজেদের অসামঞ্জস্য মিটিয়ে ফেলা, বৈচিত্র্যময় আগ্রহ ও মূল্যবোধ উপভোগ এবং সাধারণ প্রয়োজনের বিষয় পরিচালনায় সরকারি নীতি তৈরির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মিলেমিশে কাজ করে’। আড্রিয়ান লেফ্টউইচের মতে, ‘রাজনীতি সমাজ ও সমাজসমূহের মধ্যে সমবায়, মতবিনিময় ও দ্বন্দ্বের সকল কাজের জন্ম দেয়। যার দ্বারা মানুষ তাদের জৈবিক ও সামাজিক জীবনের উৎপাদন ও প্রজননের নিমিত্তে মানবীয়, প্রাকৃতিক ও অন্যান্য সম্পদ ব্যবহার, উৎপাদন ও বন্টনের ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করে’। এক কথায় রাজনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে গণমানুষের কল্যাণে যা কিছু প্রয়োজন তার সকল কিছুই নিশ্চিত করা।

রাজনীতি ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষমতার অনুশীলন হিসাবে দেখা হয়। আবার কেউ কেউ বিষয়টিকে আদর্শিক ভিত্তিতে সামাজিক ক্রিয়া হিসাবে দেখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এ পার্থক্যকে বলা হয় রাজনৈতিক নৈতিকতাবাদ এবং রাজনৈতিক বাস্তববাদের মধ্যে পার্থক্য। নৈতিকতাবাদীদের বিবেচনায় রাজনীতি হলো নীতিশাস্ত্রের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত বিষয় এবং অতি আদর্শ চিন্তার ক্ষেত্রে এর অবস্থান সর্বোচ্চ পর্যায়ের। এক্ষেত্রে এরিস্টটলের দৃষ্টিভঙ্গী হচ্ছে, ‘রাজনৈতিক হওয়ার অর্থ হল সবকিছুই কথা ও যুক্তির মাধ্যমে নির্ধারিত হবে, সহিংসতার মাধ্যমে নয়। সবকিছুই হতে হবে সুশৃঙ্খলভাবে। সেখানে বার্নার্ড ক্রিকের বক্তব্য হচ্ছে, ‘রাজনীতি হলো উন্মুক্ত সমাজ পরিচালনার পন্থা। রাজনীতি হলো রাজনীতি আর অন্য প্রকারের নীতিনিয়মগুলো হল অন্যকিছু।’

আন্তঃসরকারী সংস্থা এবং বহুরাষ্ট্রীয় সংঘবদ্ধতার মাধ্যমে বিশ শতকে রাজনৈতিক বিশ্বায়নের সূচনা হয়েছিল। লীগ অব নেশনস প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এটি জাতিসংঘ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছিল। এর মাধ্যমে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। আঞ্চলিক সংহতকরণের উদ্দেশ্যে তৈরি হয় আফ্রিকান ইউনিয়ন, আসিয়ান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মারকোসু। আন্তর্জাতিক স্তরের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা।

মূলত, জাতীয় রাজনীতি নাগরিকদের কল্যাণের নিয়মনীতিতে পরিচালিত না হলে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কখনোই সার্থক ও ফলপ্রসূ হয়ে ওঠে না। এক্ষেত্রে সুশাসন হচ্ছে অন্যতম অনুষঙ্গ। বস্তুত নিয়মকানুন, আইন, বিচারসহ রাষ্ট্রাচারের সকল অনুষঙ্গের স্বাভাবিকতায় ব্যত্যয় না ঘটিয়ে জনগণ, প্রশাসন, রাজনৈতিক শক্তিগুলো তথা রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত সবকিছুকেই আধুনিকতা ও সাংবিধানিক মানদণ্ডে প্রতিষ্ঠাই হচ্ছে সুশাসন। কোন সমাজরাষ্ট্রে যখন সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় তখন সেখানে আধুনিকতার মানদণ্ডে রাষ্ট্র উন্নীত হতে পেরেছে বলে মনে করা হয়। আর এ জন্য সবার আগে প্রয়োজন হয় ইতিবাচক ও গণমুখী রাজনীতি। যেখানে ক্ষুদ্র দলীয় ও গোষ্ঠী স্বার্থের বিপরীতে জাতীয় স্বার্থ প্রাধান্য পায়। ফলে রাষ্ট্র ও নাগরিক জীবন সর্বাঙ্গ সুন্দর হয়ে ওঠে; রাষ্ট্র পরিণত হয় কল্যাণরাষ্ট্রে।

১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা যে স্বাধীনতা অর্জন করেছি তার উদ্দেশ্য ছিল জনগণের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতাসহ উন্নত জীবনব্যবস্থার নিশ্চয়তা প্রদান। এ ক্ষেত্রে নানা চড়াই-উতরাই অতিক্রম করতে হলেও আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্নগুলো অনেক ক্ষেত্রেই আজও অধরাই রয়ে গেছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে আমাদের দেশের চলমান স্বার্থবাদী নেতিবাচক রাজনীতি এবং একশ্রেণির রাজনীতিকের আদর্শিক দেউলিয়াত্ব। মূলত আধুনিক রাষ্ট্র বলতে শুধু অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদতা দূরীভূত করার মাধ্যমে সমৃদ্ধির দিকে ধাবিত হওয়াই নয়, একই সঙ্গে শিক্ষা-সংস্কৃতি ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিককে গড়ে তোলাকেও অধিকতর গুরুত্ব দেয়া জরুরি।

অবশ্য ক্ষমতাসীনরা সব সময় বলে থাকে যে, তারা গণমানুষের কল্যাণেই সব সময় রাজনীতি করে থাকেন। তাদের রাজনীতির সকল কিছুই মানবকল্যাণে নিবেদিত। বিশেষ করে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার আমাদেরকে এমন আপ্তবাক্যই শুনিয়ে এসেছে সব সময়। কিন্তু তাদের এমন দাবি কখনোই বাস্তবসম্মত ছিলো না বরং ‘খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি’ বলেই গণ্য করা হচ্ছে। বস্তুত, তারা যেসব অর্জনের বিষয়ে ঢাক-ঢোল পিটিয়েছেন তা ইতিবাচক ও গতিশীল রাজনীতি ছাড়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। আর আমাদের দেশের চলমান রাজনীতি এখনও সে মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। রাজনীতি আটকে পড়েছে একটা সঙ্কীর্ণ বৃত্তে। ফলে আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন অনেক ক্ষেত্রেই আজও অপূর্ণই রয়ে গেছে।

মূলত, শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, আইন-শৃঙ্খলা এসব ক্ষেত্রে সম্মিলিত অগ্রগতি ছাড়া কোন জাতিই আত্মনির্ভরশীল হতে পারে না। সে ক্ষেত্রে আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন আংশিকভাবে চললেও পরিপূর্ণ আধুনিক রাষ্ট্রের সংজ্ঞায় আমাদের উত্তরণ প্রশ্নসাপেক্ষই রয়ে গেছে। সঙ্গত কারণেই এখন আমাদের জন্য আবশ্যক হয়ে পড়েছে অর্থনৈতিক বিপ্লবের চাকা সচল রাখার পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আধুনিক মতাদর্শের চর্চা সুসংহত করা। আর এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে সর্বপ্রথম যে কাজটি অত্যাবশ্যকীয় তাহলো দেশের চলমান রাজনীতিকে নেতিবাচক বৃত্ত থেকে বেড়িয়ে এনে একটি গণমুখী রাজনীতির সূচনা করা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমাদের তেমন কোন অর্জন নেই বললেই চলে।

আমাদের দেশের রাজনীতি যে নেতিবাচক বৃত্তে আটকা পড়েছে তা নিয়ে তেমন বিতর্ক নেই। আর সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের একজন মন্ত্রীর বক্তব্যে সেকথা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ফলে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই চলমান রাজনীতিতে বড় ধরনের সংস্কারের আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে। একই সাথে রাজনীতিকে আরও ক্রিয়াশীল পরিশীলিত, পরিমার্জিত ও সৃজনশীল করার তাগিদও এসেছে বিভিন্ন মহল থেকে। সমাজের ভাল মানুষের যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে। আর এ মহতি উদ্যোগ গ্রহণ করা কোন একক গোষ্ঠী বা রাজনৈতিক শক্তির পক্ষে সম্ভব নয় বরং জাতীয় ঐকমত্যই পারে আমাদেরকে এ অচলাবস্থা থেকে মুক্তি দিতে। কিন্তু এক্ষেত্রে রাজনীতিকদের দায়িত্বটাই সবচেয়ে বেশি। শুধু অমৃতবচন বা কথামালার ফুলঝুড়ির মাধ্যমে কোন সমস্যার সমাধান হবে না। রাজনীতিকদের হতে হবে আদর্শবাদী ও বাস্তবমুখী।

এমতাবস্থায় রাষ্ট্র সংস্কারের পাশাপাশি রাজনীতিতে বড় ধরনের সংস্কারের আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে। রাজনীতিকরা যদি তাদের নেতিবাচক বৃত্ত থেকে বেড়িয়ে আসতে না পারেন, তাহলে শুধুই রাষ্ট্র সংস্কার কোন কাজে আসবে না বরং নিষ্ফলা হয়ে যাবে আমাদের সকল অর্জন। তাই রাজনীতিকদের আত্মসংস্কার ও আত্মসমালোচনা এখন সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি। শুধু কাগজে কলমে রাষ্ট্র সংস্কার কোনভাবেই দেশে সুশাসন ফিরে আনবে না। সবার আগে রাজনীতিকদের মানসিকতার সংস্কার জরুরি। একই সাথে জরুরি আত্মসমালোচনারও। অন্যথায় কোন কিছুই আমাদের জন্য ফলদায়ক হবে না; বৃত্ত ভাঙা যাবে না কোনভাবেই।

[email protected]