প্রফেসর আর. কে. শাব্বীর আহমদ

ফিলিস্তিনসহ গোটা মুসলিম উম্মাহ আজ ইহুদি খ্রিস্টান মুশরিকদের হাতে লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে বিশ্বমুসলিমকে ঈমানী শক্তি নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। নির্যাতিত নিপীড়িত মানবতাকে বাঁচাতে হবে। নইলে বিশ্বজুড়ে মুসলমানরা অমুসলিমদের গোলামে পরিণত হবে। আল্লাহর গোলামিকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ লড়াইতে অবতীর্ণ হতে হবে।

আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সা.)-এর ভবিষ্যৎ বাণী : শাম বা সিরিয়া থেকে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের লড়াই হবে। এ লড়াইয়ে মুসলিমরা অংশগ্রহণ করলে আল্লাহর সাহায্যে মুসলিমদের বিজয় অর্জিত হবে। ইহুদি খ্রিস্টান মুশরিক রাষ্ট্র খণ্ড বিখণ্ড হয়ে বরবাদ হয়ে যাবে। -আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলছিল উসমানীয় খেলাফতের অধীনে ভূমধ্যসাগরের পূর্বে ২৮৪২৯ বর্গমাইলব্যাপী। ফিলিস্তিনে ইহুদি-ইসরায়েল বসতি স্থাপনের জন্য নিরন্তর যুদ্ধ-সংঘাত লেগেই ছিল। এ সংঘাতের উৎপত্তি ১৯ শতকের শেষের দিকে ইউরোপে ইহুদিদের উত্থানের মধ্য দিয়ে। যাদের আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিনে উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অটোমন অঞ্চল ব্রিটিশ দখলের পর বাধ্যতমূলক প্যালেস্টাইনকে ব্রিটিশ ম্যান্ডেট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। ক্রমবর্ধমান ইহুদি অভিবাসনের ফলে ইহুদি এবং আরবদের মধ্যে আন্তঃসাম্প্রদায়িক সংঘাত রূপ লাভ করে।

এর ধারাবাহিকতায় ২০০৬ সালে হামাস ও ইসরায়েল বেশ কয়েকটি যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েল-হামাস সশস্ত্র গোষ্ঠীর আক্রমণে বড় ধরনের যুদ্ধ রক্তক্ষরণ যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে গাজায় ইসরায়েলি ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডকে আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ, গণহত্যা পণ্ডিত ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো মানবতারিরোধী গণহত্যা হিসেবে আখ্যায়িত করে।

২০২৩ সালর অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ফিলিস্তিনি নিহতের সংখ্যা ৪৬ হাজার ৫০০ ছাড়িয়ে গেছে। আজ গাজা, রাফা জনমানবশূন্য বিধ্বস্ত বিরানভূমি। আহত নারী, শিশু, বিধবা, সর্বস্বহারা পুরুষদের গগণবিদারী চীৎকার, হাহাকারে আকাশ জমিন বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা একশো ষাট কোটি মুসলমান নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছি ইহুদি, নাসারা, মুশরিকদের তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের জুজুর ভয়ে। চতুর্মুখী হামলা যখন হবে কোনো মুসলিম দেশ রক্ষা পাবে না। ‘ অন্ধ হলে কী প্রলয় বন্ধ থাকে।’

প্রলয় চলছে ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইয়ামেন, কাশ্মীর, আরাকান, গুজরাট, আহমদাবাদে। এ প্রলয় ছড়িয়ে যাবে মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিশালী দেশগুলোতে। পাকিস্তান, ইরান, তুরস্ক, মিশর কেউ বাঁচতে পারবে না যদি শক্তিশালী মুসলিম দেশগুলো সম্মিলিতভাবে অর্থনৈতিক, সামরিক প্রতিরোধ গড়ে না তোলে। “হে মুসলিম বিশ্ববাসী আমাদের বাঁচাও”- আর্তনাদ ধ্বনিত হচ্ছে নির্যাতিত মুসলিম বিশ্বের সিরিয়া, ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, গুজরাট, আরাকানের লাখো-কোটি রোহিঙ্গাদের কণ্ঠে।

গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পেহেলগামে এক সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়েছে। মিয়ানমারের জান্তা সরকার ও বিদ্রোহীদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সংঘাতের কারণে ২০২৩ নভেম্বর থেকে পালিয়ে আসা প্রায় দু’ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে চরম সংকটাপন্ন অবস্থায় বেঁচে আছে।

ভারতের গুজরাটের মুসলমানদেরকে বাংলাদেশি নাগরিক তকমা দিয়ে গুজরাট রাজ্য থেকে সাড়ে ছয় হাজার মুসলিমকে আটক করেছে। অথচ আহমদাবাদ, সুরাট ও গুজরাটের লক্ষ লক্ষ মুসলমান যুগ যুগ ধরে এ সব রাজ্যে স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে বসবাস করে আসছে।

ওয়াকফ আইন বাতিল করে ভারত মুসলমানদের হাজার হাজার একর জমি জবরদস্তি করে দখল করার পাঁয়তারা করছে এবং মুসলমানদের প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন মাসজিদ, মাদরাসা ধ্বংস করার পরিকল্পনা নিচ্ছে। বিশ্বমুসলিমের অনৈক্য ও পরাশক্তিগুলোর লেজুড়বৃত্তিক মনোভাবের কারণে আজ গোটা মুসলিম উম্মাহ সাম্রাজ্যবাদের কবলে নির্যাতিত নিপীড়িত হচ্ছে। নির্যাতিত নিপীড়িত মুসলমানদের আর্তনাদের প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা’আলার ঘোষণা

“তোমাদের কী হয়েছে, কেনো তোমরা লড়াই করছো না আল্লাহর পথে? অথচ নির্যাতিত, অসহায় পুরুষ, নারী ও শিশুরা চীৎকার করে বলছে, হে আমাদের রব! আমাদেরকে এ জালিম অধ্যুষিত জনপদ থেকে নিষ্কৃতি দাও এবং আমাদের জন্য তোমার পক্ষ থেকে সাহায্যকারী বন্ধু পাঠাও! যারা ঈমানদার তারা লড়াই করে আল্লাহর পথে, আর যারা কাফির তারা লড়াই করে তাগুত বা আল্লাহদ্রোহীদের পথে। অতএব তোমারা শয়তানের দোসরদের হত্যা করো। নিশ্চয়ই শয়তানের ষড়যন্ত্র নিতান্তই দুর্বল। -সূরা আন নিসা-৭৫। আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন, হে ঈমানদারগণ! কাফিরদের সাথে ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ করো, যতোক্ষণ না সংঘাত, বিশৃংখলা নির্মূল হয় এবং আল্লাহর বিধান পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়। -সূরা আল আনফাল-৩৯

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে কেউ যদি কাউকে কোনো অন্যায় বা গর্হিত কাজ করতে বা আল্লাহর সীমা লংঘন করতে দেখতে পায়, সে যেন তাকে হাত দিয়ে প্রতিহত করে। যদি তা করতে সক্ষম না হয়, তাহলে প্রতিবাদের ভাষা দিয়ে তা প্রতিহত করে। যদি তাতেও সক্ষম না হয়, তাহলে অন্তর দিয়ে তাকে প্রতিহত করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করে। আর তা হচ্ছে ঈমানের সর্বনিম্ন স্তর। -সহীহ মুসলিম-৪৯

মক্কায় রাসূল (সা.) কাফিরদের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর নির্দেশে কিছুসংখ্যক মুসলিমদের নিয়ে মদিনায় হিজরত করে চলে যান। কিন্তু অসহায়, দুর্বল, পুরুষ, নারী, শিশুরা যেতে সক্ষম হয়নি। তাদের ওপর কাফিরদের চরম নির্যাতন নেমে আসে। তখন তারা আর্তনাদ করে বলে, হে আমাদের রব! আমাদেরকে জালিমদের নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য এ জনপদ থেকে বের করে নাও।

এহেন অবস্থায় রাসূল (সা.) মাত্র ৩১৩ জন সাহাবী নিয়ে বদর প্রান্তরে কাফিরদের মোকাবিলায় নিজেদের ঈমানি শক্তিতে জিহাদে অবতীর্ণ হন। তখন আল্লাহ তা’আলা ফিরিশতা পাঠিয়ে মুসলিমদের সাহায্য করে বিজয় দান করেন। ফলশ্রুতিতে মক্কার অসহায় নিপীড়িত মুসলিমগণ নির্যাতন থেকে মুক্তি পান এবং মদিনায় হিজরত করে নিরাপদে অবস্থান করেম আল্লাহ তা’আলার অশেষ রহমতে। বাতিলের সাথে আপস না করে প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করলে আল্লাহর সাহায্য নেমে আসে। বর্তমানকালেও এ ধরনের নজির বিভিন্ন মুসলিম দেশগুলোতে পরিলক্ষিত হয়েছে।

তাই এসব ঘটনাবলি ও কুরআন, হাদিসের নির্দেশ অনুযায়ী বর্তমান নির্যাতিত বিশ্বমুসলিমের ওপর কাফির, ইহুদি, খ্রিস্টান, মুশরিকদের যে নির্মম অত্যাচার চলছে, তার মোকাবিলা করার জন্য বিশ্বব্যাপী ঈমানদার, মুসলমানদের ঈমানি দায়িত্ব পালনের জন্য সম্মিলিতভাবে সার্বিক শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সময়ের অনিবার্য দাবি। অন্যথা সমস্ত মুসলমানদের আরো করুণ পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে।

লেখক : শিক্ষাবিদ, কবি, গীতিকার।