প্রথম কিস্তি

তুরস্কের তিনটি খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান যথাক্রমে ইউনিয়ন অব এনজিওজ ইন দি ইসলামিক ওয়ার্ল্ড (UNIW) ইকোনমিক এন্ড সোশ্যাল রিসার্সেজ সেন্টার (ESAM) , এবং আন্তর্জাতিক যুব ফোরামের (IYF) আমন্ত্রণে গত মাসের ১৮ তারিখে সৌদী এয়ারলাইন্স-এর একটি বিমানযোগে তিন সপ্তাহের জন্য তুরস্ক সফরে গিয়েছিলাম। সফরকালে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো কর্তৃক আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলন/ সেমিনারসমূহে যোগদান করা ছাড়াও তুরস্কের ক্ষমতাসীন একে পার্টি, প্রধান বিরোধী দল সাদা’ত পার্টির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, তুরস্কে শিক্ষারত বাংলাদেশী ছাত্রদের ফোরাম এবং উপমহাদেশের তিনটি দেশ; বিশেষ করে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং ইতিহাস-ঐতিহ্যের ওপর গবেষণারত প্রতিষ্ঠান Centre for Indian sub continental Studies (যাকে তুর্কি ভাষায় HAKAMER নামে অভিহিত করা হয়) এর গুরুত্বপূর্ণ কিছু কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করি। আমার সফরসঙ্গী ছিলেন এইড ফর হিউম্যানিটি নামক একটি ত্রাণ সংস্থার চেয়ারম্যান সাদ নিজামী নামক এক তরুণ দা’য়ী ও জনহিতৈষী। সফরটি অত্যন্ত উদ্দীপনাময় ছিল। শিক্ষা প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ সেমিনার-সিম্পোজিয়াম ও কর্মশিবিরে যোগদান প্রভৃতি উপলক্ষে দুনিয়ার অনেকগুলো দেশ সফর করার সুযোগ আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। এর মধ্যে তুরস্ক সফর সর্বদা আমার মনপ্রাণ কেড়েছে। দেশটি ওসমানীয় খেলাফতের কেন্দ্রস্থল ছিল।

প্রায় ৬০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এ দেশটির মুসলিম শাসকরা দুনিয়ার বিশাল অংশ শাসন করেছে; তাদের শাসন দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিস্তৃত অঞ্চলব্যাপী বলবৎ ছিল। এ খেলাফতের বিস্তৃতি এক সময় ভিয়েনা, বলকান অঞ্চল, গ্রীস, ইউক্রেনের অংশবিশেষ, মধ্যপ্রাচ্য; বিশেষ করে ইরাক, সিরিয়া, ইসরাইল, মিশর, উত্তর আফ্রিকা এবং পশ্চিম দিকে আলজেরিয়াও এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ওসমানীয় খেলাফতের অবসান ঘটে। এ খেলাফত রক্ষার জন্য আমাদের পূর্ব পুরুষ উপমহাদেশের মুসলমানরা আলেম-ওলামাদের নেতৃত্বে খেলাফত আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ১৯২৩ সালে তুর্কি নেতা মোস্তফা কামাল পাশা (কামাল আতাতুর্ক) তুর্কি রিপাবলিক বা প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর সাথে সাথেই খেলাফতের অবসান ঘটে। তিনি পাশ্চাত্যপন্থী ছিলেন এবং ইসলামকে উন্নতি-অগ্রগতির অন্তরায় বলে বিশ্বাস করতেন। তার শাসনামলে তুরস্কে হাজার হাজার আলেম-ওলামাকে হত্যা করা হয়। আরবী ভাষা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় এবং মসজিদে আজান দেয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। মেয়েদের হিজাব নিষিদ্ধ হয় এবং তাদের মিনি স্কার্ট পরা বাধ্যতামূলক করা হয়। মাদরাসা-মক্তব নিষিদ্ধ করার ফলে দেশে ইমাম সংকট দেখা দেয়। এমনকি মৃতদের জানাযা পড়ানো ও দাফন-কাফনের শরয়ী পদ্ধতি জানা লোকেরও অভাব দেখা দেয়। এ সংকট মোকাবেলার জন্য দেশটির পরবর্তী সরকারসমূহ ইমাম হাতিম স্কুল নামে বিশেষ শিক্ষালয় খুলতে বাধ্য হন। এ ইতিহাস অনেক বেদনার ও দীর্ঘ। পরবর্তী কোনো এক সময় এ ব্যাপারে ইনশাআল্লাহ আলোচনা করবো।

তুরস্কের সবচেয়ে বড় শহর ইস্তাম্বুল, বয়স প্রায় ২৬০০ বছর। খৃষ্টপূর্ব ৬৬০ অব্দে এখানে বসতির সন্ধান পাওয়া গেছে। রাজধানী আঙ্কারার ইতিহাস ব্রজ্ঞ যুগ থেকে। ইস্তাম্বুল রোম ও বাইজেন্টাইন আমলের মতো পুরনো এ শহরটি একাধিক নামে পরিচিত ছিল। বাইজেন্টাইনের রাজধানী থাকাকালে এর নাম ছিল বাইজেন্টাইম। পরবর্তীকালে রোমান আমলে এর নাম হয় কনস্টান্টিনোপল। বিশাল শক্তিধর গ্রীক, রোমান ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য মুসলমানদের হাতে পরাভূত হবার ফলে তাদের ধ্বংসস্তূপের উপর গড়ে উঠে ওসমানীয় খেলাফত তথা মুসলিম সাম্রাজ্য। কনস্টান্টিনোপলের নাম দেয়া হয় ইসলামবুল। এই ইসলামবুলই অপভ্রংশ হয়ে এখন ইস্তাম্বুল নামে পরিচিতি লাভ করেছে।

তুরস্কের ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ ইতিহাস। এর সানলি উরুষ প্রদেশে নমরূদের প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ এখনো আছে। নমরূদ হযরত ইব্রাহীম (আ.)-কে যে বিশাল অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করেছিলেন, আল্লাহর আদেশে সে আগুন ইব্রাহীম (আ.)-এর জন্য আরামদায়ক ঠাণ্ডায় রূপান্তরিত হয়েছিল। এ কুণ্ডলীর স্থলটি এখন সেখানে বিশাল হ্রদের আকারে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে অবস্থান করছে। এ হ্রদে মাছের চাষ হয়। দর্শনার্থীরা মাছগুলোকে খাবার সরবরাহ করে। এ বড় হ্রদটির পাশে আর একটি ছোট হ্রদ রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, ঐ হ্রদটি নমরূদের মেয়ে জুলাইখার জন্য তৈরি আরেকটি অগ্নিকুণ্ড। জুলাইখা নিজের পিতাকে খোদা না মেনে ইব্রাহীমের (আ.) আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছিলেন। এজন্য নমরূদ তার মেয়েকেও অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করেছিলেন। পবিত্র কুরআনে দ্বিতীয় ঘটনাটির কোনো উল্লেখ নেই। আল্লাহ আগুনকে ইব্রাহীমের জন্য আরামদায়ক শীতল হবার নির্দেশ দিয়েছিলেন, কুরআনে অন্য কারুর উল্লেখ নেই। সানলি উরফাতে ইব্রাহীম (আ.)-এর জন্ম গুহাও রয়েছে। এর অদূরে একটি গ্রামে হযরত আদম (আ.)-এর স্মৃতিরও সন্ধান পাওয়া যায়। স্থানীয় লোকদের মতে, হযরত আদম (আ.) এই গ্রামেই কৃষিকাজ শুরু করেছিলেন। তারা জানিয়েছেন যে তার চাষকৃত আঞ্জির, গন্ধম (গম), তুলা ও জয়তুন এখান থেকেই দুনিয়ার বিভিন্ন স্থানে বিস্তৃতি লাভ করেছে। সানলির দক্ষিণে আরো প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে হযরত আইয়ুব (আ.)-এর আরোগ্য স্থান নামে একটি জায়গা আছে। যে গুহায় তিনি আরোগ্য লাভ করেছিলেন সে গুহাটি এখন দর্শনার্থীদের অনেকটা তীর্থ স্থানের মতো। এখানে একটি কুয়া আছে। আল্লাহর আদেশে তাঁর পায়ের আঘাতে কুয়া সৃষ্টি হয়েছিলো এবং এ কুয়ার পানিতে গোসল করার পরে তাঁ পচা-গলা দুর্গন্ধযুক্ত শরীর সুস্থ হয়েছিল। জমজমের পানির মতো এই কুয়ার পানিও দর্শনার্থীরা কন্টোইনার ভর্তি করে নিয়ে যান।

তুরস্কের আনাচে-কানাচে অনেক নবী-রাসূল এবং সাহাবায়ে কেরামের কবর রয়েছে। নূহ (আ.)-এর কিস্তির ধ্বংসাবশেষও এ দেশটির যুধি পাহাড়ে পাওয়া গেছে। গ্রীক নগরী ট্রয় ও তুরস্কে, দেশটির সব স্মৃতি এখানে আলোচনা সম্ভব নয়। ২১ তারিখে ইস্তাম্বুল থেকে বিমানযোগে আনাতোলিয়া পৌঁছি এবং সেখান থেকে আমাদের জন্য বিমানবন্দরে অপেক্ষমান দুই মোহাম্মদ (একজন তুরস্কের, আরেকজন ফিলিস্তিনের) গাড়িযোগে প্রায় তিন ঘণ্টা ড্রাইভ করে ডেমার শহরে নিয়ে যায়। এ শহরটি ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত, জনসংখ্যা ৩০,০০০। পরিবেশ অত্যন্ত মনোরম। ডেমার শহরের অদূরে খৃষ্টের জন্মের ১৪০ বছর পূর্বে একটি ভূমিকম্পে একটি গ্রীক শহর ধ্বংসের কিছু নমুনা প্রত্যক্ষ করলাম। তিন খণ্ডে বিভক্ত এ শহরটির একটি অংশ সমুদ্র তীর থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে, আরেকটি অংশ এক কিলোমিটার দূরে দ্বীপের আকারে এবং তৃতীয় খণ্ডটি সমুদ্রকূলে তার বিশাল স্থাপত্যশৈলী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বড় বড় পাথর খোদাই করে ভবনগুলো তৈরি এবং একাধিক তালা সম্পন্ন ভবনগুলোয় উঠানামার জন্য খোদাই করা সিঁড়িগুলো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সমুদ্র তীরের বাড়িগুলো এখন আর বাড়ির আকারে নেই, দেখলে পাথরের পাহাড় বলে মনে হয় (Rocky Hill) , মাটির কোনো রকম সাপোর্ট ছাড়া এই পাথরের উপর গজিয়ে ওঠা বিশাল বিশাল গাছ আল্লাহর মহত্ব ঘোষণা করছে।

ডেমের শহরটি কৃষি প্রধান। এখানে বিভিন্ন জাতের আঙুর, আঞ্জির, জয়তুন, অন্যান্য ফলফলাদি ও তরিতরকারি উৎপন্ন হয়। কৃষি উৎপাদনের গ্রীন হাউস পদ্ধতিও দেখলাম। ভূমধ্যসাগরের এ অংশে মাছ বা জলজ প্রাণী তথা সাপ কিংবা কুমিরের বসবাস নেই। এ অর্থে খুবই নিরাপদ এবং অনেকেই পরিবার-পরিজন নিয়ে এখানে গোসল করেন ও সাঁতার কাটেন।

২২ আগস্ট জুমার নামাযের পর ফিলিস্তিন সমস্যার উপর আয়োজিত সম্মেলনটি শুরু হয়। এতে ৪৬টি দেশের ২১০ জন প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ ছিল প্রাণবন্তু ও তথ্যসমৃদ্ধ। তাদের আলোচনায় ফিলিস্তিনীদের উপর বিশ্ব শক্তিসমূহের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ও উসকানিতে ইসরাইলের নৃশংস ও অমানবিক আচরণের একটি নিটোল চিত্র উঠে এসেছে। সম্মেলনের তরফ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়েছে যে, ফিলিস্তিনবাসীরা আজকে তাদের নিজেদের দেশে পরবাসী। তারা আশ্রয়হীন; অন্ন, বস্ত্র. বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা সবকিছু থেকে বঞ্চিত। তারা ইসরাইলী সেনাদের গোলাগুলিতে মরছে, দুর্ভিক্ষে মরছে, চিকিৎসার অভাবে মরছে। সারা দুনিয়া তাদের উপর নিপীড়নকে মনে হয় যেন উপভোগ করছে। (অসমাপ্ত)