॥ এম. এ. কাদের ॥

জরা বা বার্ধক্য জীবনের এক চরম সত্য। শৈশবের সোনালি সকাল শেষ করে, তারুণ্য আর যৌবনের রোদেলা দুপুর পাড়ি দিয়ে, মাঝ বয়সের ব্যস্ত বিকেলটাও যখন চলে যায়, তখনই জীবন সায়াহ্নের গোধূলী বেলা হয়ে আসে বার্ধক্য। এ সময়টা আসলে মানব জীবনের শেষ অধ্যায়। নেহায়েত অকালমৃত্যু না হলে এ স্তরটিতে শেষ পর্যন্ত পদার্পণ করতেই হবে। বার্ধক্য তাই জীবনের নিয়তি। বার্ধক্যজনিত স্বাভাবিক পরিবর্তন ছাড়াও বৃদ্ধদের শরীরে নানা রোগব্যাধিও দানা বাঁধে। শারীরিক পরিবর্তনের কারণে কিছু রোগ প্রকৃতিগতভাবে বয়স্কদেরই হয়ে থাকে।

বর্তমান সমাজে সবচেয়ে অবহেলার শিকার এখন অসহায় প্রবীণরাই, কিন্তু ক্রমবর্ধমান বার্ধক্যের অসহায়ত্ব মোকাবিলা করার মত দরকারী প্রস্তুতি আমাদে নেই। অরক্ষিত এ প্রবীণদের সেবা দেয়ার জন্য যে নতুন-নতুন ব্যবস্থা প্রয়োজন তা গড়ে উঠছে না। অসহায় প্রবীণদের কল্যাণের বিষয়ে এখনই আমাদের উদ্যোগী হওয়া জরুরি। কেননা বার্ধক্য হচ্ছে প্রতিটি মানুষের অবধারিত সমস্যা। আজকের নবীনই আগামী দিনের প্রবীণ। তাই শ্রদ্ধার সংগে প্রবীণদের দেখভাল করতে হবে। আর এখন থেকেই নিজেদের স্বস্তিময় বার্ধক্যের প্রস্তুতি নিতে হবে। দয়া-দাক্ষিণ্য বা করুণার দৃষ্টিতে নয়, মানবাধিকারের ভিত্তিতে এবং প্রাপ্য মর্যাদার যুক্তিতে প্রবীণদের চাওয়া পাওয়া সমাধান করা প্রয়োজন। এর জন্য দরকার গণসচেতনতা, আর এ গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রবীণদের অবহেলা, অযতœ, দুর্ব্যবহার, নির্যাতনের ঘটনা এবং সবার করণীয় বিষয়গুলো সব শিক্ষা পাঠ্যসূচিতে এবং গণমাধ্যম কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে পারলে প্রবীণদের প্রতি কিছুটা হলেও সম্মান প্রদর্শন করা হবে।

মানুষের গড় আয়ু বাড়ার সংগে সংগে প্রবীণদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৯৯০ সালে বিশ্বে প্রবীণদের সংখ্যা ছিল ৫০ কোটি। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২০ কোটিতে। ২০৩০ সালে এর সংখ্যা হবে ১৫০ কোটি, এবং ২০৫০ সালে প্রবীণদের সংখ্যা ২০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশে বর্তমান প্রবীণদের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। ২০২৫ সালে প্রবীণদের সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ২ কোটি। ২০৫০ সালে প্রবীণসংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে চার কোটিতে। জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞদের মতে ২০৬০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে অপ্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় প্রবীণদের সংখ্যা বেশি হবে। এক বে-সরকারী জরিপে জানা গেছে বর্তমান বাংলাদেশে প্রায় ৫০ লক্ষ প্রবীণ অসুস্থ, অসহায়, অবহেলিত, নিঃসঙ্গ ও সেবাহীন জীবন যাপন করছেন।

যে প্রবীণ যৌবনে তার মেধা, মনন, দক্ষতা দিয়ে সমাজের অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন, জীবনের সকল সুখ বিসর্জন দিয়ে সন্তানদের মানুষ করেছেন, মানব কল্যাণে অবদান রেখেছেন, বৃদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে সেই মানুষটি অযতœ, অবহেলার আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। আপাতদৃষ্টিতে সমাজের বা সরকারের নূন্যতম দায়ীত্ব তাঁদের উপর বর্তায় না। শিশুদের উজ্জল ভবিষ্যত ও সুন্দর জীবন গড়ার জন্য পিতা-মাতা ও সরকারের যেমন দায়িত্ব আছে, অনুরূপ ভাবে প্রবীণদের জন্য সন্তান, সমাজ ও সরকারের দায়িত্ব নেয়া উচিত। প্রায় সব প্রবীণদেরই চিকিৎসা নেওয়ার প্রয়োজন হয়, এক্ষেত্রে প্রত্যেক উপজেলা শহরে প্রবীন হাসপাতাল গড়ে তুলে বিনা খরচে চিকিৎসা সেবা দিতে হবে। এছাড়া প্রত্যেক হাসপাতালে একই সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। চলাফেরার ক্ষেত্রে বাস, ট্রেন ও আকাশপথে অর্ধেক ভাড়ায় সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা করতে হবে। সকল প্রবীণদের জন্য প্রবীণ ভাতা চালু করতে হবে। সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রবীণদের যে কোন কাজের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেবা নিশ্চিত করতে হবে।

এগুলোর সমাধান না করলে প্রত্যেককেই বৃদ্ধ বয়সে এই অবহেলা ও কষ্টের স্বাদ নিতে হবে। অনেক সন্তান তাদের কর্মব্যস্ততার কারণে কর্মস্থল ত্যাগ করে বাবা-মার পরিচর্যা বা সেবা যতœ করতে পারেনা। অনেক পিতা-মাতা নিজের ভিটা মাটি ছেড়ে বিদেশে সন্তানের সাথে থাকতে পছন্দ করে না। এসব নানা কারণে দিনদিন সন্তানদের সাথে বাবা-মা’র সু-সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া অনেক পিতা-মাতার পুত্র সন্তান না থাকায় জামাই-মেয়ের বাড়ীতে থাকতে পছন্দ করেন না। এ থেকে পরিত্রান পাওয়ার একটাই উপায়; কষ্টের বৃদ্ধাশ্রম নয়, প্রত্যেক উপজেলায় আনন্দের সাথে বসবাস করার জন্য ‘আনন্দ আশ্রয়’ গড়ে তুলতে হবে। যেখানে একই বয়সের অনেকেই থাকার কারনে প্রবীণরা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে স্ব-ইচ্ছায় থাকতে চাইবেন।

প্রত্যেক উপজেলার শহরের কাছাকছি কমপক্ষে পাঁচ একর জমির উপরে এ “আনন্দ আশ্রয়” গড়ে তুলতে হবে। আনন্দ আশ্রয়ে থাকবে প্রবীণদের সুচিকিৎসার জন্য হাসপাতাল, থাকবে ভাল নার্সিং ব্যবস্থা, থাকবে ভাল মানের খাবার, বিনোদনের ব্যবস্থা, থাকবে প্রার্থনার জন্য মসজিদ, মন্দির, খেলার মাঠ, ব্যায়ামাগার ইত্যাদি। থাকবে ভাল আবাসনের ব্যবস্থা। এখানে যে কোন প্রবীণ স্ব-ইচ্ছায় থাকতে পারবেন। যাদের দেখার কেউ নেই, স্বামী-স্ত্রী এক সাথে বা একা একা থাকতে পারবেন। ধনী প্রবীণরা ভাড়া বা খরচ দিয়ে থাকতে পারবেন। একই বয়সে অনেকে এক সাথে থাকার কারণে প্রবীণরা আনন্দে থাকতে পারবেন। এতে সন্তান, আপন জনেরা দেশে বিদেশে যেখানেই থাকুক না কেন বাবা-মা ভালো আছেন ভেবে তারাও নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন। প্রয়োজনে সন্তান, আপনজন বিদেশ থেকে এসে কিছুদিন আনন্দ আশ্রয়ে বাবা-মাকে সঙ্গ দিতে পারবেন। গরীব অসহায় প্রবীণরা সরকারী খরচে থাকবেন। প্রয়োজন হলে তারা স্ব-ইচ্ছায় কিছুদিন নিজের বাড়ীতে, কিছুদিন “আনন্দ আশ্রয়ে” থাকতে পারবেন।

অসহায় প্রবীণদের বিষয়টি জাতীয় সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করে, জনসচেতনতা ও প্রচারের মাধ্যমে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ‘আনন্দ আশ্রয়’ গড়ে তোলার জন্য নিজ দায়িত্বে সকলে এগিয়ে আসলেই দ্রুত বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। ইতিমধ্যে এ মহৎ উদ্যোগকে বেশির ভাগ সচেতন মানুষ ও ভুক্তভোগী প্রবীণরা স্বাগত জানিয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়কে বাস্তবায়নের জন্য সমাজে দানশীল ও বিত্তবানরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চায়। প্রবীণদের জন্য সামাজিক আন্দোলনে তরুণদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন, কারণ প্রবীণদের এ সমস্যা সমাধান না হলে আগামীতে ভুক্তভোগী হবে বর্তমান তরুণ প্রজন্মই। প্রবীণদের জীবন যেন সত্যিকার অর্থেই হয় আনন্দের, শান্তিময়, মধুর স্মৃতিময়। তারা যেন নিজেদের অবহেলিত, পরিবারের ও সমাজের বোঝা মনে না করেন, এই হোক আপনার, আমার, সবার প্রত্যাশা।

লেখক : সাংবাদিক।