আশা-নিরাশার মধ্যে দিয়ে জুলাই-২৪ ছাত্র অভ্যুত্থানের প্রথম বার্ষিকী পালন হচ্ছে। এর আশার দিক হলো, অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের দিক থেকে এখনও পূর্ণ সক্রিয় এবং তাদের তত্ত্বাবধানে, রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে বার্ষিকী উপলক্ষে জুলাই সনদ ঘোষণা হতে যাচ্ছে। আর নিরাশার দিক হলো, জনগণ কর্তৃক গৃহীত একটি সফল ও সর্বাত্মক অভ্যুত্থানকে তার জায়গায় রাখা হয়নি এবং অতীতে যারা ক্ষমতায় গেছেন এবং সামনেও যারা ক্ষমতায় যাবেন এবং জুলাই অভ্যুত্থানের প্রত্যক্ষ ভূমিকায় যারা ছিলেন না, তাদের হাতেই জুলাই সনদ ও সংস্কারের ভাগ্য তুলে দেয়া হয়েছে। তারা ক্ষমতায় গিয়ে জুলাই সনদের বাস্তবায়ন করবেন এবং সনদপত্র, যতটা মনে হয়, জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার সামান্যই পূরণ করছে।

এই হতাশা আমাদের রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের প্রতি মানুষের অনাস্থা নয়, বরং এটা আমাদের রাজনীতি ও রাজনীতিকদের অপারগতা নিয়ে জনগণের যে কষ্ট, তারই প্রকাশ। গত প্রায় দেড় যুগেও আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলন জনসমর্থনহীন একটা সরকারের পতন ঘটাতে পারেনি। মানুষ মনে করে এর বড় কারণ ছিলো স্বৈরতান্ত্রিক ঐ সরকারের প্রতি প্রতিবেশী একটি বড় দেশের সর্বাত্মক সমর্থন এবং আমাদের রাজনীতিতে তাদের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ। সামনের রাজনৈতিক সরকার কি এই হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকবে, না মুক্ত থাকতে পারবে? যে কারণে আমাদের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি অতীতে এ সর্বনাশা হস্তক্ষেপকে মেনে নিয়েছে, সেই কারণ থেকে আমাদের রাজনীতি কি মুক্ত হয়েছে? মুক্ত হয়নি বলেই মানুষ মনে করে। তাহলে জুলাই সনদের ভাগ্যে কি ঘটবে? প্রতিবেশী দেশটি তো ঢাকঢোল পিটিয়েই বলছে, সামনের নির্বাচিত সরকারের সাথে প্রাণ খুলে ডায়ালগের জন্য দু’হাত বাড়িয়ে তারা অপেক্ষা করছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এর মধ্যেই বাংলাদেশের রাজনীতিকে যতটা স্বাধীন করেছে, ততটা পিছিয়ে নেবার জন্যে তারা প্রস্তুত। তাহলে জুলাই-২৪ অভ্যুত্থানের ফল কি শূন্য হতে যাচ্ছে? শূন্য হতে যাচ্ছে একথা বলার সময় এখনও আসেনি। কিন্তু আশাবাদী হবার মতো কোনো অবলম্বনও মানুষের কাছে নেই।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অনন্য জুলাই-২৪ ছাত্র-অভ্যুত্থান তার প্রথম বার্ষিকীতে এসেই এই অনিশ্চিত অবস্থায় পড়বে, মানুষ আবার পিছিয়ে পড়ার মতো আতঙ্কের মুখোমুখি হবে, এটা কেউ ভাবেনি। যা মানুষ ভাবেনি, সেই আশঙ্কা তাহলে তৈরি হলো কী করে? কারণটি হলো, জুলাই-২৪ অভ্যুত্থান ৩৬ জুলাই, ৫ আগস্ট, সাফল্যের যে চূড়ায় ওঠে, মাত্র ৩ দিনের মধ্যে তা সেখান থেকে ছিটকে পড়ে। সেদিন ৮ আগস্ট সবার গ্রহণযোগ্য একজন উপযুক্ত ব্যক্তিকে ছাত্ররা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে ক্ষমতায় বসাতে সমর্থ হয় বটে, কিন্তু তার হাতে দেয়া হয় আইন-সংবিধানের পুরনো ও পলিউটেড সব অস্ত্র এবং বিতর্কিত অনেক কর্মের হাত। এ কারণেই বাংলাদেশের জুলাই অভ্যুত্থান-২৪ দুনিয়ার দৃষ্টান্ত হওয়ার মতো একটি সফল বিপ্লব হলেও তার মতো বঞ্চিত বিপ্লব দুনিয়াতে বোধহয় আর নেই। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের প্রজাতন্ত্রীদেরকে তাদের বিপ্লবের পর পরিপূর্ণ সাফল্য (১৮৪৮ খৃ.) পাবার আগে অনেক বাধা, অনেক চড়াই-উৎরাই অতিক্রম করতে হয়েছে। কিন্তু অবশেষে তারাই সফল হয়। তাদের সংগ্রামে তারা রাজতন্ত্র-প্রশাসনের পুরনো কাঠামো গ্রহণ করেনি। হাতে তুলে নিয়েছিল তারা নতুন দিন, নতুন দেশ গড়ার জন্য নতুন কাঠামো, নতুন আইনের অস্ত্র। আমাদের জুলাই-২৪ অভ্যুত্থান বা বিপ্লবের ক্ষেত্রে তা হয়নি! যে আইন-কাঠামো দেশে স্বৈরাচার সৃষ্টি করেছিল, স্বৈরাচারকে রক্ষা করেছিল, সেই পুরনো আইন-কাঠামোকে আশ্রয় করেই অভ্যুত্থানের নায়করা এবং নতুন সরকার নতুন দিন ও নতুন দেশের স্বপ্ন দেখছিল। বিপ্লবের এই বিচ্যুত অবস্থানই অপরিহার্য সব সংস্কার ও বিচারের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়াবার সুযোগ দেয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিকে। দুই পক্ষের লড়াইয়ে (সংস্কার ও নির্বাচন) পুরনো আইন-কাঠামো এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি নির্বাচনকেই বিজয়ী করেছে এবং সংস্কার ও বিচারকে কার্যত ঠেলে দিয়েছে নির্বাচন-পরবর্তী সরকারের করুণার ওপর।

সংস্কার ও বিচারের প্রতি করুণা নির্বাচিত সরকার করবে না, তা আমরা বলছি না। কারণ জুলাই-২৪ অভ্যুত্থানকে তারা শুধু সমর্থনই করছেন না, তার অংশ হয়েও দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু মুশকিল হলো, দুনিয়ায় বড় ও সবল দেশের পাশে ছোট ও দুর্বল দেশের রাজনীতি স্বাধীন থাকতে পারছে না। ছোট ও দুর্বল দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, নিরাপত্তা সবই তারা গ্রাস করতে ইচ্ছুক। এক্ষেত্রে আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশীর অতীত রেকর্ড খুবই খারাপ। সামনে আরও খারাপ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তার ওপর আমাদের রাজনীতিকরা নানা কারণে বড় দেশটির সামনে মেরুদণ্ড সোজা রাখতে খুব কমই পারেন। এ কারণেই প্রয়োজনীয় সব সংস্কার ও বড় বড় বিচারকার্য শেষ হবার পর জাল-জঞ্জালমুক্ত নতুন দেশের দায়িত্ব নির্বাচনের হাতে তুলে দিতে পারলে, আমাদের রাজনীতিকরাই উপকৃত হতেন বেশি। এটা জনগণ বুঝলে লাভ নেই, যারা বুঝলে কাজ হবে তারা বোঝা উচিত। কিন্তু সমস্যা হলো, এই বুঝের চাইতে ক্ষমতার কুরছি অনেক অনেক বেশি আকর্ষণীয়।