নাহিদ হাসান নাঈম
একটি জাতির অগ্রগতি নির্ভর করে সে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার গুণগত মান কতটা শক্তিশালী তার উপর। শিক্ষা একটি জাতির চিন্তা, চেতনা ও মূল্যবোধের মাপকাঠি। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি) ও সমমান পরীক্ষার ফলাফলের চিত্র আমাদের সামনে কিছু মৌলিক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, যা কোনভাবেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
২০২৫ সালের উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি) ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে গত বৃহস্পতিবার। সে ফলাফলের দিকে নজর দিলে মনে হয়, প্রশ্নগুলো আরও জটিল হয়ে গেছে। এ বছরে গড় পাসের হার মাত্র ৫৮.৮৪ শতাংশ, যেখানে বিগত ২০২৩-২৪ সালে গড় পাসের হার যথাক্রমে ৭৮.৬৪ শতাংশ ও ৭৭.৭৮ শতাংশ ছিল। অতএব, পূর্ববর্তী সময়ের ফলাফলগুলো থেকে দেখা যায় দুবছরের ব্যবধানে প্রায় ২০ শতাংশের বেশি পাসের হারের পতন ঘটেছে। ফলে আমাদের সামনে একটি প্রশ্ন আসেÑ এ পতন কি প্রকৃত অর্থেই শিক্ষার্থীদের মেধার চরম ব্যর্থতার পরিচয়, নাকি বহুদিন ধরে চাপা পড়ে থাকা বাস্তবতার প্রতিফলন?
শিক্ষাবিষয়ক নীতিনির্ধারকদের কাছে পাসের হার কমে যাওয়ার বিষয়টি নিঃসন্দেহে একটি অস্বস্তিকর পরিসংখ্যান। তবে এটি কেবল পতন নয়, বরং শিক্ষা কাঠামোর অভ্যন্তরে জমে থাকা অসংগতির স্বচ্ছ প্রতিফলনও বটে। বিগত সময়ে আমরা পাসের হার বৃদ্ধি করতে গিয়ে শিক্ষার গুণগত মানে বড় সংকট তৈরি হতে দেখেছি। অনেক সময় ফলাফল উন্নয়নের নামে প্রশ্নপত্রের মান কমানো হয়েছে, খাতা মূল্যায়নে নমনীয়তা দেখানো হয়েছে। পরিতাপের বিষয় হলো যে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোচিং ও গাইড নির্ভর সংস্কৃতিকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু ২০২৫ সালের প্রকাশিত ফলাফল সে বিগত দিনের কৃত্রিম চিত্রকে ভেঙে দিতে সক্ষম হয়েছে। এ বছরে প্রশ্নের মান বাস্তবভিত্তিক এবং মূল্যায়ন কিছুটা হলেও পূর্বের তুলনায় কঠোরতা আঁচ করা গেছে। কিন্তু আসল বিষয় হলো বর্তমান সময়ে শিক্ষার্থীরা প্রকৃতপক্ষে জ্ঞান অনুশীলন থেকে কতটা দূরে চলে গেছে, সেটির মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে সকলের কাছে। বাংলাদেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থা আজ এমন এক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে পাসের হার যেন গুণগত মানের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের একটি বৃহৎ অংশ কৃতকার্য হতে পারছে না, যদিও তারা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করেছে। ফলে এটা স্পষ্ট যে, আমাদের পরীক্ষার কাঠামো শিক্ষার্থীদের প্রকৃত দক্ষতা ও সৃজনশীলতা যাচাই করতে পারছে না।
যখন শতভাগ পাসের হার আসে, তখন আমরা খুশি হই। কিন্তু আমরা কখনও ভেবে দেখি না, সেই শতভাগ পাসের মধ্যে প্রকৃত অর্থেই বিশ্লেষণধর্মী, যুক্তিশীল চিন্তা, সমস্যা সমাধান, অথবা সৃজনশীলতা প্রকাশের সক্ষমতা কতটুকু আছে । ২০২৫ সালের উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল আমাদের মনে করিয়ে দেয়Ñ সংখ্যার দাপট দিয়ে কখনো বাস্তবতাকে দমিয়ে রাখা যায় না। শিক্ষার মান যদি ভেতর থেকে দুর্বল হয়ে পরে, তাহলে তার প্রতিফলন ফলাফলের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
২০২০ সালের করোনা মহামারির ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব এখনো কেটে ওঠেনি। অসম শিক্ষা পরিবেশ ও অনলাইন ক্লাস শিক্ষার্থীদের শেখার মৌলিক ভিত্তিতে বিঘ্ন ঘটিয়েছে। যদিও অনেকেই পরবর্তী পর্যায়ে উঠলেও তাদের বুনিয়াদি জ্ঞান অর্জনে ফাঁপা রয়ে গেছে। ফলে যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক পরীক্ষার দিকে ফিরে এসেছে, তখন কঠোর মূল্যায়ন ও প্রশ্নপত্রের গুণগতমানের কারণে ঘাটতিগুলো প্রকটভাবে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। এটিকে শিক্ষার্থীদের একার ব্যর্থতা নয়, বরং একটি বৃহৎ অংশের শিক্ষা জীবনকে সঠিকভাবে পুনর্গঠন করতে না পারার ফল। এ বছর শিক্ষাগত সংকট কেবল সংখ্যার মাধ্যমে আমাদের সামনে এসেছে।
২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের পর, ২০২৩ সালে চালু হওয়া নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রম নিয়ে শিক্ষা প্রশাসন অনেক প্রত্যাশা জাগিয়েছিল। সেখানে জায়গা করে নিয়েছিল শিক্ষার্থীদের মুখস্ত বিদ্যা থেকে মুক্ত করা, সৃজনশীল জ্ঞানভিত্তিক ও দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষা নিশ্চিত করা ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু প্রকৃত চিত্রে দেখা যায়, অধিকাংশ শিক্ষক প্রশিক্ষণ হীনতার কারণে নতুন কারিকুলামের দর্শন বা পদ্ধতি রপ্ত করতে হিমশিম খাচ্ছেন। ফলশ্রুতিতে পরীক্ষা প্রশ্নপত্র বিভ্রান্তিকর হয়েছে এবং মূল্যায়ন কাঠামোতে স্বচ্ছতার ঘাটতি লক্ষ্য করা গেছে। ফলে শিক্ষার্থীরা কাক্সিক্ষতভাবে নতুন বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে পারেনি; অনেকে পুরনো কাঠামোর উপরই নির্ভর করেছেন।
বাংলাদেশের শিক্ষানীতির বড় দুর্বলতা হলো ধারাবাহিকতা বজায় না থাকা। সব সরকারের সময় নতুন নীতি বা কারিকুলাম আনা হলেও, পুরনো কারিকুলামের ভুলত্রুটি বিশ্লেষণ করতে খুব কমই দেখা গেছে। শিক্ষা ব্যবস্থা একটি দীর্ঘমেয়াদী ও একটি জাতির জন্য স্পর্শকাতর বিষয়। এটি কোনো রাজনৈতিক চুক্তি নয়। ফলাফল হলোÑ নতুন পরীক্ষা কাঠামো, নতুন মূল্যায়ন, নতুন সিলেবাসের কারণে শিক্ষার্থীরা বিভ্রান্ত হয়। যারা নীতি নির্ধারণ করেন, তারা প্রায়শই একটি বিষয়ে বিশ্বাস করেন ‘পরিবর্তন মানে উন্নতি’, কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। পরিবর্তন অনেক সময় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক ফলাফলে অঞ্চলভিত্তিক বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ফলাফলে পাসের হার গ্রামীণ অঞ্চলের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। একই কারিকুলাম হলেও গ্রামীণ শিক্ষার্থীরা উপযুক্ত শিক্ষক সংকট, ইন্টারনেট সুবিধা, ল্যাব ও প্রযুক্তির অভাবের কারণে অনেক পিছিয়ে আছে। এতে সামাজিক বৈষম্যের প্রতিফলন ঘটে। যেখানে শহরের শিক্ষার্থীরা কোচিং, গাইড বই ও অনলাইন রিসোর্স পায়, সেখানে গ্রামীণ শিক্ষার্থীরা প্রায়শই পর্যাপ্ত শিক্ষা উপকরণ সংগ্রহের চিন্তায় দিন কাটায়।
শিক্ষক হলো একটি আদর্শ জাতি গড়ার কারিগর। তাদের স্থান অনেক উপরে,কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষক পেশা আর প্রেরণার উৎস নয়। কম বেতন, কাজের চাপ, প্রশাসনিক জটিলতা এবং সমাজে শিক্ষকের মর্যাদার ঘাটতি সব মিলিয়ে অধিকাংশ শিক্ষক মানসিকভাবে ক্লান্ত। নতুন কারিকুলাম বা মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় সৃজনশীলতা ধারণে তারা সক্ষম হয় না। যদি আগামী দিনে শিক্ষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনা নিশ্চিত না করা যায়, তাহলে শিক্ষার মান উন্নয়ন জাতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
শিক্ষাজীবনের ‘ফলাফল’ আমাদের দেশের সামাজিক মানদণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। এটি ধীরে ধীরে আমাদের সংস্কৃতিতে পরিণত হচ্ছে। একজন শিক্ষার্থীর ফলাফল তার ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের মান, মর্যাদা ও যোগ্যতা নির্ধারণ করে। শিক্ষার্থীরা পারিবারিক ও সামাজিক অদৃশ্য চাপের মধ্যে পড়ে। এ চাপ শিক্ষার্থীদের শেখার আগ্রহকে বিষে রূপান্তরিত করে।
শিক্ষক, অভিভাবক ও প্রতিষ্ঠান সকলেই প্রত্যাশা করে পাসের হার ভালো হোক। ফলে শিক্ষা কাঠামোতে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়। তাদের লক্ষ্য থাকে জ্ঞান বিকশিত করা নয়, বরং সাফল্যের বাহ্যিক প্রদর্শন করা । যতদিন এ অপসংস্কৃতি চালু থাকবে, ততদিন ফলাফলের উঠানামা এভাবেই চলতে থাকবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ফলাফল প্রকাশের পর তাদেরকে একটি প্রচলিত বিবৃতি দিতে দেখা যায় মূল্যায়ন প্রক্রিয়া কঠোর হওয়ায় পাসের হার কমেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন প্রতিবছর নীতিগত পরিবর্তনের পরও সমান সফলতা লক্ষ্য করা যায় না? কেন মানসম্মত, স্থিতিশীল ও আধুনিক মূল্যায়ন কাঠামো তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না? শিক্ষা মন্ত্রণালয় শুধুমাত্র ফলাফল ঘোষণার মধ্য সীমাবদ্ধ নয়, বরং তাদেরকে পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণাত্মক প্রতিবেদন প্রকাশ করা উচিত। কোন বিষয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা দুর্বল, কোন বোর্ডে সমস্যা বেশিÑ এগুলো চিহ্নিত করে পরবর্তীতে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। শিক্ষা একটি চলমান প্রক্রিয়া; এককালীন ইভেন্ট নয়।
বর্তমান প্রজন্ম প্রযুক্তির উপর ক্রমবর্ধমানভাবে নির্ভরশীল। শিক্ষার্থীদের সময়ের বড় অংশ সোশ্যাল মিডিয়া, টিকটক, ইউটিউব ইত্যাদিতে চলে যায়। ফলাফলে প্রাচুর্য থাকলেও দিনে দিনে জ্ঞানের গভীরতা বিলীন হয়ে হচ্ছে। অনেকে গুগল সার্চকেই ‘শেখা’ মনে করে, ফলে বিশ্লেষণধর্মী পড়াশোনায় তাদের অনীহা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রযুক্তিকে শিক্ষার্থীদের কল্যাণার্থে গবেষণা ও জ্ঞান চর্চার হাতিয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা অপরিহার্য।
২০২৫ সালের উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফল আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে আমাদের ব্যর্থতা কোথায়। একটি জাতি তখনই উন্নতির শিখরে পৌঁছায়, যখন সে নিজের ভুল-ত্রুটি স্বীকার করে, তা বিশ্লেষণ করে এবং সামনের দিকে অগ্রসর হয়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আজ যে কঠিন সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এখনই প্রয়োজন সৎ, সাহসী, নীতিনির্ধারণে দক্ষ নেতৃত্ব এবং একটি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে প্রতিটি শিক্ষার্থীকে সম্ভাবনার উৎস হিসেবে দেখা হবে, কেবল সংখ্যার ভিত্তিতে নয়।
লেখক: প্রাবন্ধিক।