আমাদের দেশে খুবই অনগ্রসর ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী বেদে সম্প্রদায়। অপরাপর অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে মূল ধারায় ফিরে আনার জন্য বিভিন্ন সময়ে সরকার ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও বেদে সম্প্রদায়ই এক্ষেত্রে রীতিমত ব্যতিক্রম। কারণ, এদের নিয়ে কারো তেমন মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। ফলে এরা আজও অবহেলিত ও অধিকার বঞ্চিত।
খ্রীস্টান মিশনারীগুলো সেবার নামে এবং নানা প্রলোভনে দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়কে ধর্মান্তরিত করতে সক্ষম হলেও ইসলাম ধর্মের অনুসারি আমাদের বেদে সম্প্রদায় আজও তাদের স্বকীয়তা, ধর্মীয় বোধ-বিশ্বাস, আবেগ-অনুভূতির সাথে আপস করে নি বরং তারা প্রতিনিয়ত প্রান্তিকতা, দারিদ্র্যতা ও নানাবিধ প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে আজও টিকে থাকার প্রাণান্তকর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ সরকার বা বেসরকারি কোন সংস্থা এসব জনগোষ্ঠীকে মূল ধারায় ফিরে আনার তেমন চেষ্টা করেনি। করলেও তা যথাযথ ও পর্যাপ্ত নয়।
মূলত, বাংলাদেশের একটি যাযাবর ইন্দো-আর্য জনগোষ্ঠী হলো বেদে সম্প্রদায়। এরা ঐতিহ্যগতভাবে নদীতে বসবাস করে। বাংলাদেশে প্রায় আট লাখ বেদের বসবাস রয়েছে। মূলত, বেদেরা একটি প্রান্তিক গোষ্ঠী। বেদেদের প্রায় ৯৮% দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে এবং প্রায় ৯৫% বেদে শিশু বিদ্যালয়ে যায় না। ফলে তারা আজও শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। শুধু তাই নয় বরং ঐতিহাসিকভাবে বেদেরা ভোট দিতে পারতো না। কারণ, তাদের স্থায়ী আবাস ছিল না। একই কারণে তারা ব্যাংক ঋণ বা ক্ষুদ্রঋণের জন্য আবেদনও করতে পারতো না। অবশ্য ২০০৮ সালে বেদেরা বাংলাদেশে ভোটাধিকার অর্জন করতে সক্ষম হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে এখনো রয়েছে নানাবিধ বাধা-প্রতিবন্ধকতা। একই সাথে হয়রানিও।
বেদেদের অধিকাংশই সাপ সম্পর্কিত ব্যবসায় জীবনযাপন করে। তারা ভাগ্যবতী গুল্ম এবং ভেষজ ওষুধও বিক্রি করে। বেদেদের অন্যান্য পেশা হলো বিনোদন পরিষেবা (যেমন বানরখেলা, জাদুখেলা) এবং ক্ষুদ্র ব্যবসা। গ্রামবাসীদের একটি অংশ বেদেদের জাদুকরী শক্তিতে বিশ্বাস করে। তারা বিশ্বাস করে বেদেরা জাদুকরী ক্ষমতার মাধ্যমে অশুভ আত্মাদের কারও শরীর ত্যাগ করাতে পারে। তাঁদের কাউকে কাউকে ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং খুলনার মতো বড় শহরের ব্যস্ত রাস্তায় ভিক্ষা করতেও দেখা যায়।
অধিকাংশ বেদের কোনো ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই এবং তারা আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা ব্যবহার করে না। তাঁদের অধিকাংশই বাংলা ভাষায় কথা বলে। এদের বেশিরভাগই মুসলিম; কিন্তু ইসলামের সাথে হিন্দুধর্ম, আধ্যাত্মবাদ এবং সর্বপ্রাণবাদ অনুসরণ করে থাকে। কথিত আছে, ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে শরণার্থী আরাকানরাজ বল্লাল রাজার সাথে এরা ঢাকায় আসে। পরবর্তীকালে তারা ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নেয়। এরা প্রথমে বিক্রমপুরে বসবাস শুরু করে এবং পরে সেখান থেকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, এমনকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামেও তারা ছড়িয়ে পড়ে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, বেদের আদি নাম মনতং। বেদে নামটি অবজ্ঞাসূচক বাইদ্যা (হাতুড়ে ডাক্তার)। পরিমার্জিত ‘বৈদ্য’ (চিকিৎসক) থেকে উদ্ভূত। বেদেরা আরাকান রাজ্যের মনতং আদিবাসী (Mon-tong) গোত্রের দেশত্যাগী অংশ। যুদ্ধ ও শিকারে অতিশয় দক্ষ বেদেরা কষ্টসহিষ্ণু ও সাহসী।
বেদেরা কৌমসমাজের রীতিনীতি মেনে চলে ও দলবদ্ধ হয়ে থাকে। আপাতদৃষ্টিতে বেদেদের পিতৃপ্রধান সমাজ হলেও মেয়েরা সংসার পরিচালনায় যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বেদে ছেলেরা অলস প্রকৃতির। নৌকা এদের অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ। বছরের অধিকাংশ সময় বিশেষ করে ফসল তোলার মৌসুমে ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে এরা গ্রামে-গঞ্জে পরিভ্রমণ করে। তাদের সাথে থাকে সাপের ঝাঁপি বা ওষুধের ঝুলি। এরা সপরিবারে গ্রামে গ্রামে এসব ফেরি করে। এটিকে তারা গাওয়াল বলে অভিহিত করে। তারা গাওয়ালে যায় শীতের শুরুতে অগ্রহায়ণ মাসের শেষের দিকে ও আষাঢ় মাসের দ্বিতীয়ার্ধে।
সহজ-সরল জীবনযাপনকারী বেদেরা খুবই সৎ প্রকৃতির। অপরাধ করে গুরুতর শাস্তির ভয় থাকলেও সর্দারের কাছে তারা অপরাধ স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হয় না। এদের জীবন ধারণের মান অত্যন্ত নিম্ন ও অপরিচ্ছন্ন। এদের খাদ্য তালিকায় বাছবিচার নেই। বিভিন্ন ধরনের মাদকেও এরা আসক্ত। বাঙালি মুসলমানদের সাথে এদের সামাজিক সম্পর্ক খুব কম। মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও তারা হিন্দু দেবদেবীর প্রশস্তি রচনা করে। বিশেষত রাম-লক্ষ্মণ-বিক্রমাদিত্যের গুণকীর্তন করে।
আমাদের দেশের বেদেরা মোট নয়টি শাখায় বিভক্ত। এগুলো হলো লাউয়ো বা বাবাজিয়া, চাপাইল্যা, বাজিকর, বেজ বা মিচ্ছিগিরি, গাইন, মেল্লছ, বান্দাইরা, মাল এবং সাপুড়িয়া। এরা সকলেই জমিতে কায়িক পরিশ্রম করাকে অমর্যাদার কাজ বলে মনে করে। এদের সার্বজনীন পেশা হলো চিকিৎসা ব্যবসা ও ওষুধ বিক্রয়। নানারকমের বুনো লতাপাতা আর শেকড়বাকড় এরা ভেষজ হিসেবে ব্যবহার করে। এদের চিকিৎসা পদ্ধতিতে মন্ত্র অর্থাৎ ঝাড়ফুঁকের প্রয়োগ অত্যন্ত বেশি। এরা জড়িবুটি দিয়ে শিশু চিকিৎসা, বাত ও দাঁতের ব্যথা, মালিশ প্রভৃতিতে অভিজ্ঞ বলে বিশ্বাস প্রচলিত আছে। এরা নানাধরনের খেলা দেখায়, উল্কি পরায় ও দৈহিক কসরত প্রদর্শন করে। এরা কোন বৈজ্ঞানিক ও লিখিত চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করে না। চিকিৎসার কাজে মন্ত্র, গাছের শিকড়বাকড়, পশুপাখির হাড়, ধনেশ পাখির তেল, গরু বা মহিষের শিং, কাঁচ ভাঙ্গা, কাকিলা মাছের ধারালো দাঁত ইত্যাদি প্রকারের লোকজ ওষুধ ও জীবের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যবহার করে। এরা মূলত টোটকা চিকিৎসার কাজ করে থাকে। বিভিন্ন ধরনের আকর্ষণীয় খেলা দেখিয়ে এরা লোকজন জড়ো করে ওষুধের ওপর মানুষের বিশ্বাস বৃদ্ধি করে ওষুধ বিক্রয় করে। বেদেদের বিভিন্ন শাখার চিকিৎসা পদ্ধতি ও ওষুধপত্রের ব্যবস্থা পদ্ধতি ভিন্ন রকমের। লাউয়ো বেদে বা বাবাজিয়ারা বড়শি দিয়ে মাছ ধরে, মাছ ও মাছের হাড়ের মালা বিক্রয় করে। এদের নিবাস মূলত বিক্রমপুরের বিয়ানিয়া, নারায়ণগঞ্জের চারার ঘোপ, কুমিল্লার আমিরাবাদ, মাইছাখালী, হুরাইল, নারগাঁও, নারায়ণপুর, হাজীগঞ্জ, লাকসাম ও মেহের কালীবাড়ি।
গাইন বেদেরা সুগন্ধি মশলা বিক্রয় করে। এদের নিবাস নেত্রকোনায়। বেজ বেদেরা (মিচ্ছিগিরি) বরিশাল, পিরোজপুর ও চাঁপাই নবাবগঞ্জে থাকে। এদের পেশা চোখের চিকিৎসা করা। এরা ভাঙ্গা কাচ দিয়ে চোখে অস্ত্রোপচার করে। চাপাইল্যা বেদেদের (সাজদার) পেশা হচ্ছে বিষ-ব্যথা নিরাময়কারী মাছের কাঁটা, বাঘের থাবা ও পাখির হাঁড়ের মালা বিক্রয়। এছাড়া এরা আফিম, মুক্তার অলঙ্কার, চুড়ি, শাঁখা, হাঁসুলি ও ঝিনুক বিক্রয় করে। এরা তাঁতি ও জোলাদের জন্য খুব সস্তায় সুন্দর সুন্দর সানা (বুনানি শলা) তৈরিতে পারদর্শী। এরা দক্ষ ডুবুরিও। এদের নিবাস ঢাকার টঙ্গী, ডেমরা ও বাড্ডা, মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া, মির্জাপুরের চা বাগান এবং কুমিল্লার আমিরাবাদ। বাজিকর বেদেরা শিয়ালের হাড় ও ধনেশ পাখির তেল বিক্রয় করে। শিয়াইল্যা বেদেরা সর্বভুক বলে অন্য বেদেদের সাথে তাদের লেনদেন হয় না। এরা গরু, শূকর, সাপ খায় এবং হিন্দু দেবদেবীর উপাসনা করে। এরা থাকে লালমনিরহাট ও ভারতের সীমান্ত এলাকায়। বান্দাইরা বেদে ওষুধ বিক্রয় করে ও বানরের খেলা দেখায়, বিভিন্ন ভোজবাজি ও শারীরিক কসরত উপস্থাপন করে। এরা রাম-লক্ষ্মণের বন্দনা-গীত গায় এবং রাম-রাবণের শৌর্যবীর্য ও হনুমানের কীর্তির বর্ণনা করে। লালমনিরহাট ও ভারতের কলকাতায় এদের বসবাস।
মাল বেদেদের (মাল বৈদ্য) পেশা সাপের বিষ ঝাড়া, দাঁতের পোকা ফেলা, রসবাতের তেল বেচা এবং শিঙা ফুঁকা। এরা সাপ ধরে বিক্রয় করে কিন্তু সাপের খেলা দেখায় না। এদের নিবাস মাদারীপুর, বিক্রমপুর, ঢাকা, রাজশাহী, কুমিল্লা, নোয়াখালী এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম। সাপুড়িয়া বেদেরা (সাপুড়ে) সাপের তাবিজ কবজ ও ওষুধ বিক্রয় করে ও সাপ ধরে। এরা সাপের খেলা দেখায় কিন্তু সাপ বিক্রয় করে না। এরা মনসা দেবীকে এখনও খুব শ্রদ্ধা করে। বিক্রমপুর, ঢাকা, সুনামগঞ্জ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে এদের বসবাস।
বেদেদের নিজস্ব ভাষা আছে। এ ভাষার নাম ঠেট বা ঠের। স্বগোত্রীয়দের সাথে কথা বলার সময় এরা এ ভাষা ব্যবহার করে থাকে। তবে বাংলা-ভাষাভাষীর সাথে এরা বাংলা ভাষা ব্যবহার করে। উল্লেখ্য, এ ঠেট ভাষার সাথে আরাকানিদের ভাষার প্রভূত মিল আছে। তাদের ভাষায় ব্যবহৃদ অধিকাংশ শব্দই বাংলা ভাষার আদিরূপ প্রাকৃত থেকে উদ্ভূত।
মূলত, বেদেরা এদেশেরই নাগরিক। ভোটাধিকারসহ সব ধরনের নাগরিক সুবিধা তাদের প্রাপ্য। বাংলাদেশে এরা বরাবরই ক্রমহ্রাসমান একটি জনগোষ্ঠী। সময়ের পরিবর্তনে বেদেদের মধ্যে কেউ কেউ শিক্ষা ও অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে পেশা বদল করছে বা অন্য সম্প্রদায়ের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে স্বকীয় কৌম পরিচয় হারিয়ে ফেলছে। অবশ্য এ সংখ্যা নেহায়েত কম।
বস্তুত, বেদেরা বাংলাদেশের অতিপরিচিত প্রান্তিক যাযাবর গোষ্ঠী। ভূমিহীন এ মানুষেরা দলবদ্ধভাবে নৌকায় বাস করে। এ জন্য তাদের জলের জিপসিও বলা হয়। সাপের খেলা দেখানোর জন্যই এরা বেশি জনপ্রিয়। সর্বজনের কাছে বেদে সম্প্রদায় যাযাবর জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্যমতে ‘এরা মূলত নৌকায় বসবাস করে এবং ক্ষুদ্র ব্যবসার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। আটটি গোত্রে বিভক্ত এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে মালবেদে, সাপুড়িয়া, বাজিকর, সান্দার, টোলা, মিরশিকারি, বারিয়াল সান্দা ও গাইন বেদে প্রধান। মূল পেশা ক্ষুদ্র ব্যবসা হলেও শিঙ্গা লাগানো, তাবিজ বিক্রি, সাপ খেলা, সাপের কামড়ের চিকিৎসা, সাপ বিক্রি, আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্য সেবাদান, ভেষজ ওষুধ বিক্রি, কবিরাজি, বানরখেলা দেখানো, চুড়িফিতা বিক্রি, জাদু দেখানো ইত্যাদি তাদের জীবিকা নির্বাহের অবলম্বন।’
তবে এদের জীবনধারার শুরুটা ঠিক এভাবে ছিল না। বহুকাল ধরে তাদের নৌকাতেই বসবাস ছিল। বিভিন্ন নদীতে ছিল তাদের দল বেঁধে চলাফেরা। ছোট ছোট নৌকার বহর নিয়ে দেখা যেত এদের নদীবন্দরে। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে বাংলাদেশ থেকে নদীগুলো সংকুচিত হয়েছে, সে সঙ্গে সংকুচিত হয় বেদেদের জীবনও। এভাবে বেদেরা জীবনের তাগিদে একসময় উপকূলে আসা শুরু করে। একপ্রকার বাধ্য হয়েই বহু বেদে পরিবার এখন বসবাস শুরু করেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় গোষ্ঠীভুক্ত হয়ে। ঢাকার সাভার, মুন্সিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, গাজীপুরের জয়দেবপুর, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, মিরেরসরাই, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম, ইত্যাদি জায়গায় এদের বসবাস দেখা যায়। একই সঙ্গে কূলে এসে বেদেদের জীবনে বেড়েছে নানাবিধ শঙ্কা ও অনিশ্চয়তা। একদিকে যেমন নেই তাদের নিরাপদ মাথা গোঁজার কোনো ঠাঁই, অন্যদিকে আছে পরিবারগুলোর ছেলেমেয়েদের ভরণপোষণ ও শিক্ষা, কিৎসাজনিত বিশাল সমস্যা। বর্তমানে বেদেরা সম্পূর্ণ ঠিকানাবিহীন ও অনিশ্চিত। এদের কুঁড়েঘরের ছাউনি হয় শত ছিন্ন পলিথিন কিংবা নাইলনের অথবা সিমেন্টের ব্যাগে। আর খেজুরপাতার পাটি দিয়ে তৈরি বিছানা।
শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত ও বসন্ত সব ঋতুতেই ছেলেমেয়ে, স্ত্রী নিয়ে নৌকাতে বা ঝুপরি ঘরে অবস্থান করে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। জীবিকার সন্ধানে ওরা ছুটতে থাকে এদিক-ওদিক। পুকুর, ডোবা বা জলাশয়ে কারও সোনা-রুপা হারিয়ে গেলে উদ্ধার করে দেয় তারা। নানা প্রতিকূলতার মোকাবিলা করে কোনোমতে বেঁচে আছে। অবহেলিত এ বেদে-বেদেনিরা সভ্য মানুষের চোখের সামনে দিয়ে অবলীলায় এদের জীবন কাটালেও কোনো মানুষই তাদের জীবন নিয়ে ভাবে না অথবা তাদের পুনর্বাসনের কথা কেউ চিন্তাও করে না।
ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করানোর ইচ্ছা থাকলেও পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে সম্ভব হয় না। যা আয় হয়, তা দিয়ে কোনোমতে দিন কাটে। কঠিন রোগ হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। ঝাড়ফুঁকে সারলে তো ভালোই অন্যথায় মৃত্যু অনিবার্য। বর্তমান আধুনিক সমাজে যেকোনো মানুষের মৌলিক অধিকার স্বীকৃত। অন্ততপক্ষে খাদ্য, বস্তু, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের সুযোগ রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকেরই অধিকার। তাই বর্তমান সময়ে আমাদের উন্নয়নশীল এ দেশে অবহেলিত এ বেদে সম্প্রদায়কে নিয়ে নতুন করে ভাবার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। অবশ্য এ লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর ‘বেদে জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি’ নামে একটি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে আসছে ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে। তবে তা কতটুকু ফলপ্রসূ হচ্ছে, তা-ই এখন দেখার বিষয়। আর আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে অবহেলিত এ যাযাবর সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়ন ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে সরকার ও সচেতন নাগরিকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে তাদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে।
একথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, একবিংশ শতাব্দীতেও আমাদের দেশের বেদে সম্প্রদায় পশ্চাদমুখী, অবহেলিত ও অধিকার বঞ্চিত। এদের অধিকাংশ ইসলাম ধর্মের অনুসারি হলেও শিক্ষা ক্ষেত্রে পশ্চাদপদতার কারণে তারা ইসলামের মৌলিক শিক্ষা থেকে তারা পুরোপুরি বঞ্চিত। তারা নিজেদেরকে ইসলাম ধর্মের অনুসারি বলে দাবি করলেও শিক্ষার অভাবেই তাদের মধ্যে ভিন্ন ধর্মীয় আদর্শের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ফলে তাদেরকে এখন মিশ্র ধর্মের অধিকারী বলাই অধিক যুক্তিযুক্ত। আমাদের দেশের অনেক অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় ফিরে আনার জন্য সরকার বা বেসরকারি সংস্থাগুলো নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করলেও বেদেদের ব্যাপারে তেমনটা নয়। এমনকি আমাদের দেশের ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোও ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী বেদে সম্প্রদায় নিয়ে খুবই উদাসীন। এদের মধ্যে ইসলামের প্রকৃত মর্মবাণী প্রচার করা গেলে অতিঅল্প সময়ের মধ্যেই তাদেরকে মূল ধারায় ফিরে আনা সম্ভব।
সরকার ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর উচিত এ অনগ্রসর ও পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠীকে মূল ধারায় ফিরে আনার জন্য সময়োচিত এবং কার্যকরী প্রকল্প গ্রহণ করে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা। একই সাথে ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোকে এদের মধ্যে ইসলামের মর্মবাণী প্রচার ও সচেতনতা সৃষ্টি করা জরুরি। তাহলেই এসব জনগোষ্ঠীকে মূল ধারায় ফিরে আনা সম্ভব।