আসিফ আরসালান
গত ১৩ জুন লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই বিএনপির এ্যাটিচুডে বিস্ময়কর পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আরো অবাক ব্যাপার হলো, এ বৈঠককে কেন্দ্র করে বিএনপির বিরুদ্ধে কোনো নেতিবাচক মন্তব্য না করা সত্বেও বিএনপি অকস্মাৎ জামায়াতে ইসলামী এবং এনসিপির বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আক্রমনাত্মক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে। অথচ জামায়াত এবং এনসিপি ঐ বৈঠক সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক বক্তব্য তো দেয়ইনি, বরং এ ধরনের বৈঠক ও আলাপ আলোচনাকে ইতিবাচক বলেছে। জামায়াত এসম্পর্কে যা বলেছে সেটি হলো, বিদেশের মাটিতে এ ধরনের বৈঠক , বিশেষ করে একজন সরকার প্রধান ও একটি রাজনৈতিক দলের বৈঠক নিয়ে যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা ঠিক হয়নি।
লন্ডন বৈঠকের পর জামায়াতে ইসলামী তাদের নির্বাহী পরিষদের বৈঠক শেষে যে বিবৃতি দিয়েছে সেখানে গঠনমূলক সমালোচনা যদি কিছু থেকে থাকে তাহলে সেটা সরকার সম্পর্কেই বলা হয়েছে। দলের বৈঠক শেষে আমীরে জামায়াত যে বিবৃতি দিয়েছেন সেখানে বলেছেন, “বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করে সরকার যেভাবে ব্রিফিং ও বিবৃতি দিয়ে বৈঠকের বিষয়বস্তু প্রকাশ করেছেন তাতে একটি বিশেষ দলের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করেছেন। এর ফলে প্রধান উপদেষ্টার নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হয়েছে।” অন্যদিকে এনসিপি বলেছে, “জুলাই সনদ কার্যকর করা ও বিচারের রোডম্যাপ ঘোষণার পর পরই নির্বাচন সংক্রান্ত আলোচনা চূড়ান্ত হওয়া উচিত।” এনসিপি অভিযোগ করেছে, সরকার লন্ডন বৈঠকের মাধ্যমে একটি দলের দাবিকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। জামায়াত এবং এসব বিবৃতিতে যদি কেউ নাখোশ হয়ে থাকেন তাহলে সেটি প্রধান উপদেষ্টার হওয়ার কথা। কিন্তু বিএনপি তাতে চটে গেলো কেনো?
এ প্রসঙ্গে ১৯ জুন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বক্তব্যে বলেছেন, যাদের নির্বাচনে জয়লাভের কোনো চান্স নাই তারাই এ বৈঠকের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। তিনি আরো এক ধাপ এগিয়ে বলেন, আগামী নির্বাচনে হেরে গেলে ঐসব দলের আর কোনো মূল্য থাকবে না, সে ভয়েই তারা লন্ডন বৈঠক নিয়ে নেতিবাচক কথা বলছে।
আমি সাধারণত কোনো রাজনৈতিক নেতা , তিনি ছোট হোন বা বড় হোন, তার বিরুদ্ধে কথা বলিনা। আমার সমালোচনা হয় রাজনৈতিক এবং আদর্শিক। মির্জা ফখরুল একজন সজ্জন ব্যক্তি হিসেবেই পরিচিত। তিনি এসব কথা বললেন কিভাবে? আগামী ফ্রেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে দেশে নির্বাচন হবে। সে নির্বাচনকে জামায়াত ওয়েলকাম করে। জামায়াতের বক্তব্য হলো, দেশের বাইরে লন্ডনে সরকার প্রধান ড. ইউনূসের সাথে বিএনপি প্রধান তারেক রহমানের বৈঠক হতেই পারে। প্রকাশিত রিপোর্ট মোতাবেক বৈঠকের শুরুতে তারেক রহমান নাকি প্রস্তাব করেন যে, আগামী নির্বাচন যদি ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে করা হয় তাহলে ভালো হয়। ড. ইউনূস তারেক রহমানের এ প্রস্তাব গ্রহণ করেন। অতঃপর এসম্পর্কে একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। বিবৃতিটি পাঠ করেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জনাব খলিলুর রহমান। অথচ বিএনপির দাবি ছিলো উপদেষ্টা পরিষদ থেকে ৩ জন উপদেষ্টার পদত্যাগ। এ ৩ জন হলেন খলিলুর রহমান, আসিফ মাহমুদ ও মাহফুজ আলম। ড. ইউনূস ও তারেক রহমান যখন একান্তে আলোচনা করছিলেন তখন পাশের ঘরে এক সাথে উপবিষ্ট ছিলেন খলিলুর রহমান, বিএনপির আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সচিব ইব্রাহিম।
জামায়াতের বক্তব্য হলো, এ ধরনের একটি বৈঠক বাংলাদেশের মাটিতেও হতে পারতো। দ্বিতীয়ত লন্ডনে বৈঠক হলেও তাৎক্ষণিকভাবে লন্ডনের মাটিতে তার ফলাফল ঘোষণা না করে প্রধান উপদেষ্টা তারেক রহমানকে বলতে পারতেন যে, তিনি তার বক্তব্য শুনেছেন। দেশে ফিরে গিয়ে তিনি অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সাথে কথা বলবেন এবং তখন ফলাফলটি ঘোষণা করা হবে। জামায়াতের এ অবস্থানে ভুল কোথায় ছিলো? বরং এ অবস্থানটিই রাষ্ট্রীয় প্রোটোকল সহ অন্যান্য দিক দিয়ে সঠিক হতো।
কী বলা হয়েছে ঐ বিবৃতিতে? তারেক রহমানের ঐ প্রস্তাবের জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেন যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের রমযান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সে সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন হবে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, প্রধান উপদেষ্টা যে রমযানের আগে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে নির্বাচন করার সম্মতি দিয়েছেন সেটি কিন্তু শর্ত সাপেক্ষ। অর্থাৎ একটি হলো, প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করা। এর মধ্যে প্রধান দু’টি কাজ হলো ভোটার তালিকা আপডেট করা। অন্যটি হলো নির্বাচনী এলাকার সীমানা প্রয়োজন হলে পুনর্নিধারণ করা। এছাড়া আরো আনুসাঙ্গিক বিষয় রয়েছে যেগুলো নির্বাচন কমিশন দেখবেন।
দ্বিতীয় শর্ত হলো, বিচারের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন। বর্তমান সরকারের বয়স হয়েছে ঠিক সাড়ে ১০ মাস। এটি একেবারে কম সময় নয়। কিন্তু এর মধ্যে বিচারের কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে? একটি বিচারের চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। আরো ৫/৭টি এ মাসের মধ্যেই দেওয়ার কথা। এসব বিচার করতে সময়ের প্রয়োজন। বিশেষ করে এসব বিচার শেখ হাসিনা স্টাইলে অসচ্ছ, প্রতারণা এবং প্রহসনমূলক যাতে না হয় সেটি নিশ্চিত করা। বিচারটি যাতে আন্তর্জাতিক মানের হয় তাও নিশ্চিত করা। দুঃখজনক হলেও সত্য যে বিএনপি এসব বিচার সম্পর্কে কিছুই বলছে না। বিচারের মধ্যে রয়েছে বিডিআর ম্যাসাকার, শাপলা ম্যাসাকার, কয়েক হাজার গুম ও খুন, হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের আদলে ১৬টিরও বেশি আয়নাঘর এবং জুলাই ও অগাস্ট বিপ্লবে ১৪ শত ছাত্র জনতাকে হত্যা করা এবং ২৬ হাজার ছাত্র-জনতাকে আহত করা। বিএনপি ক্ষমতায় এলে এসব বিচারের গতি কতখানি বেগবান থাকবে সেটি নিয়ে জনগণকে ইতোমধ্যেই কানাঘুষা করতে দেখা যাচ্ছে।
আরেকটি বিষয় হলো, হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরে লুটপাটতন্ত্র কায়েম। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্যরে শ্বেতপত্র মোতাবেক বিগত ১৫ বছরে শেখ হাসিনা এবং তার চ্যালাচামুণ্ডারা ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে পাচার করেছেন। ১ মার্কিন ডলার ১২২ টাকা হলে ২৩৪ বিলিয়ন ডলারে কত হয় সেটি আপনারা হিসাব করে নিতে পারেন। এখানে বলা যেতে পারে যে, ১০ লক্ষ সমান ১ মিলিয়ন। ১ হাজার মিলিয়ন সমান ১ বিলিয়ন। এ ১ হাজার মিলিয়নকে বা ১ বিলিয়নকে ২৩৪ দিয়ে গুণ করুন। আমার ক্যালকুলেটরে এ গুণফলের স্থান সঙ্কুলান হয়নি। তবে এটুকু বলা যেতে পারে যে পাচারের এ অংক হবে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা। এগুলোর উদ্ধার কাজ শুরু হয়েছে। শুধু মাত্র লন্ডনেই ২০ বিলিয়ন পাউন্ড পাচার করার হিসাব পাওয়া গেছে। এ টাকা উদ্ধারের জন্যই ড. ইউনূস সেদিন লন্ডন গিয়েছিলেন।
এরপর আসে সংস্কার। সমস্ত শিক্ষিত লোক সংস্কার বলতে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন সংবিধান সংস্কারের ওপর। কিন্তু গত সাড়ে ১০ মাস হয়ে গেলো, সংবিধান সংস্কার বিন্দু মাত্রও এগোয়নি। এ অবস্থায় ড. ইউনূস যখন প্রতিটি কথায় ঐক্যমতের কথা বলেন তখন ঐক্য তো আমাদের সামনে মরিচিকা হয়ে দেখা দিচ্ছে। সামনের এক দেড় মাস বেশ টারবুলেন্ট হবে বলে মনে হচ্ছে। কারণ তখন এসে যাবে সংবিধান সংস্কারের মৌলিক বিষয়গুলি এবং জুলাই চার্টার ঘোষণা।
তখন বিএনপির এ্যাটিচুড কী হবে? ইংরেজিতে একটি কথা আছে, Morning shows the day অর্থাৎ সকাল দেখেই বোঝা যায়, দিনটি কেমন যাবে? আমরা এটা নিয়ে আগাম কোনো মন্তব্য করবো না। তবে নীচে দু’একটি ঘটনা না বললেই নয়।
নানা ঘটনা প্রবাহে এখন জনমনে প্রশ্ন উঠেছে ঢাকা মহানগরী বিশেষ করে দক্ষিণ ঢাকা এখন কার হাতে? স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের হাতে? নাকি বিএনপি নেতা ইশরাকের হাতে? বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ মহানগরীর এক কোটি লোকের হর্তাকর্তা বিধাতা এখন ইশরাক হোসেন। তিনি মেয়রের চেয়ারে বসেছেন। কিন্তু মেয়রের শপথ নিতে পারেননি। তিনি মিটিং করছেন। পেছনে ব্যানারে লেখা আছে, “মাননীয় মেয়র”। এ লেখা নিয়ে ‘ডেইলি স্টার’, ‘ডেইলি নিউ এজ’ সহ মেইন স্ট্রিম পত্র-পত্রিকা তীব্র সমালোচনা করলে পরদিন লেখা হয়, “নির্বাচিত মেয়র”। সে মেয়র সাহেব (?) মশক নিধন কর্মসূচি উদ্বোধন করেন, গত ঈদে পশুর বর্জ্য অপসারণে দারুণ ভাবে ব্যর্থ হন। এখন বিএনপি তো নিজেই বলছে যে, মেয়র নির্বাচনের মেয়াদ ছিলো ৫ বছর। সে মেয়াদ তো এক মাস আগেই শেষ হয়ে গেছে।
তাছাড়া মির্জা ফখরুল অসংখ্যবার বলেছেন, শেখ হাসিনা সরকার এবং তার সংবিধানের অধীনে কোনো নির্বাচন মানবে না বিএনপি। যারা এ সিদ্ধান্ত অমান্য করবেন তাদেরকে দল থেকে বহিস্কার করা হবে। ইশরাক হোসেন তো দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে ইলেকশন করেছেন, শেখ হাসিনার সরকারের আমলে এবং বর্তমান সংবিধানের অধীনে। ইশরাককে কি বহিস্কার করা হয়েছিলো? এখন তিনি যেসব কাণ্ডকীর্তি করছেন সেগুলোকে নেহায়েত তোঘলকি কাণ্ড ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে? এগুলো অফেন্স এবং বড় ধরনের অফেন্স। আরেক বিএনপি নেতা শামসুজ্জামান দুদু বলেছেন যে, বিএনপি নেতারা প্রস্রাব করলে নাকি এনসিপির নেতাকর্মীরা ভেসে যাবে। বিএনপি নেতা কর্মীরা থুথু ফেললে নাকি এনসিপি নেতাকর্মীরা ডুবে যাবে। আমরা শুধু এটুকুই বলতে চাই যে, রাজনীতির ভাষাও হওয়া উচিত শালীন এবং শিষ্টচার সম্পন্ন।
আরেক জন নেতা নিলোফার ইয়াসমিন মনি। সংরক্ষিত কোটায় এক সময় এমপি ছিলেন। একটি টক’শোতে তিনি এনসিপির এক মহিলা নেত্রীকে বলেন যে, বিএনপি যদি এনসিপিকে ধাওয়া দেয় তাহলে এনসিপি নাকি দৌড়ে কুল পাবে না। নিলোফারের এ ইউটিউব আমার কম্পিউটারে সেভ করা আছে। এনসিপির ঐ তরুণী নেত্রী তখন বলেন যে, নিলোফার আপা, আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরে একটি বারের জন্যও ধাওয়া দেননি কেনো? কথায় বলে, কথা বলতে নাকি ট্যাক্স লাগে না। এসব উক্তি দেখে মনে হচ্ছে, কথাটি সত্য।
Email:[email protected]