মোঃ শামীম মিয়া

তামান্নার গল্প আমাদের শেখায়Ñনারীর পোশাক কখনো তার স্বপ্ন ও ক্ষমতাকে নির্ধারণ করতে পারে না। ক্লাস নাইনে ভর্তি হয়েছিল তামান্না। নতুন স্কুলে যাত্রা, নতুন পরিবেশ, স্বপ্নে ভরা চোখ। নিয়মিত সে বোরকা পড়ে যেত। যেভাবে তার পরিবার শিখিয়েছিল আর যেভাবে সে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত। প্রথমদিকে শিক্ষকরা কিছু বলেননি। কিন্তু হঠাৎ একদিন এক স্যার পুরো ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেনÑ“স্কুলে বোরকা পরে আসো কেন?” মুহূর্তেই তামান্না থতমত খেয়ে গেল। ভয়ের মধ্যেও সে বোরকা খোলেনি। শিক্ষক রেগে বললেনÑ“না খোললে ক্লাস থেকে বের হয়ে যাও।” তামান্না বেরিয়ে গেল, বুকভরা অপমান আর চোখভরা কান্না নিয়ে।

এ ঘটনা কেবল একটি কিশোরীর অভিজ্ঞতা নয়; এটি বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনের অন্তর্নিহিত মানসিকতার প্রতিচ্ছবি। দেশে কোথাও আইন বা নীতিমালায় লেখা নেই যে হিজাব বা বোরকা নিষিদ্ধ। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, মেয়েরা পোশাকের কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়, হাসাহাসির শিকার হয় বা অঘোষিত বাধার মুখে পড়ে। শিক্ষাঙ্গন, যেখানে শিক্ষার সর্বোচ্চ মূল্যায়ন করা উচিত, সেখানে পোশাক হয়ে যায় ক্ষমতার এক অদৃশ্য হাতিয়ার।

কলেজে ভর্তি হওয়ার সময়ও তামান্না একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়। তার রেজাল্ট প্রশংসিত হলেও, বাবা যখন বোরকার প্রসঙ্গ তুলেন, শিক্ষকদের মুখ কালো হয়ে যায়। যেন পড়াশোনার যোগ্যতা মুছে গেছে শুধুই পোশাকের কারণে। কাছের কলেজে সে ভর্তি হতে পারেনি। এটি শুধু একটি মেয়ের ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়; এটি পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যর্থতার প্রতীক। সংবিধান শিক্ষা সবার জন্য সমান সুযোগের নিশ্চয়তা দিলেও বাস্তবে সেই নিশ্চয়তা কার্যকর হয় না।

মিডিয়া ফেসবুক ইত্যাদির মাধ্যমে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরও পরিস্থিতি বদলায়নি। ক্লাসে দাঁড় করিয়ে বিদ্রƒপ করা হতো, সহপাঠীরা হাসাহাসি করত, অনেকে প্রশ্ন তুলতেনÑ“তুমি তো মডার্ন না, তাহলে কেন বিশ্ববিদ্যালয়ে?” এখানে ‘মডার্ন’ হওয়ার সংজ্ঞা দাঁড়ানো হয় পোশাক দিয়ে, মেধা দিয়ে নয়। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হলো বৈচিত্র্যকে সম্মান করা, শিক্ষার্থীর স্বাধীনতা বজায় রাখা। বাস্তবে পোশাকই হয়ে দাঁড়ায় পরিচয়ের একমাত্র মাপকাঠি।

ডাকসু নির্বাচনে বিষয়টি আরও প্রকট হয়। তামান্নার পোস্টারে শিং আঁকা হলো, মুখ বিকৃত করে কালি মাখানো হলো। অপরাধ একটাইÑসে হিজাব পরত। মনে হচ্ছিল, হিজাব মানেই রাজনীতির অযোগ্যতা। অথচ যখন ফলাফল ঘোষণা হলো, তামান্না সবার চেয়ে বেশি ভোট পেলো, দশ হাজারের বেশি ভোট পেল। পুরো ক্যাম্পাস গর্জে উঠলÑ“হিজাব! হিজাব!”। যে হিজাব একসময় বিদ্রƒপের কারণ ছিল, সেটিই হলো তার গৌরবের প্রতীক।

এ ঘটনার তাৎপর্য স্পষ্ট। শেষ পর্যন্ত সমাজ মেধা, সাহস ও নেতৃত্বকেই মূল্যায়ন করে। তামান্নার জয় কেবল একজন মেয়ের জয় নয়, এটি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির রূপান্তরের প্রতীক।

তবে প্রশ্ন রয়ে যায়Ñআমরা কেন পোশাককে কেন্দ্র করে বৈষম্যের পরিবেশ তৈরি করি? বাংলাদেশের সংবিধান স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করেছে, ধর্ম বা লিঙ্গের কারণে কাউকে বৈষম্যের শিকার করা যাবে না। শিক্ষা সব নাগরিকের অধিকার। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নারী অধিকার সংরক্ষার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। জাতিসংঘের নারী অধিকার সনদ ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় বলা আছে, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীদের সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। তবু বাস্তবে মানসিকতা না বদলালে আইন কার্যকর হয় না।

আমাদের সমাজে পোশাক নিয়ে দ্বিচারিতা স্পষ্ট। কেউ আধুনিক পোশাক পরলে বলা হয় উচ্ছৃঙ্খল, কেউ হিজাব পরলে বলা হয় রক্ষণশীল। উভয় ক্ষেত্রেই নারীর স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। প্রকৃত স্বাধীনতা হলো নিজের পছন্দের প্রতি সম্মান। নারীর পোশাক যদি হয় হিজাব, তবে সেটিই তার অধিকার। আবার যদি হয় অন্য পোশাক, সেটিও সমান অধিকার। সমাজ বা রাষ্ট্রের এখতিয়ার নেই তা নিয়ন্ত্রণ করার।

তামান্নার গল্প আমাদের শেখায়, শিক্ষাঙ্গনে এখনো বৈষম্য বিদ্যমান। কিন্তু তার জয় আশা দেখায়। প্রতিরোধের শক্তি দিয়েই অপমান জয় করা যায়।

এখন প্রয়োজন নীতিগত পদক্ষেপ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে স্পষ্ট করতে হবে, পোশাকের কারণে কোনো শিক্ষার্থী বৈষম্যের শিকার হবে না। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, যাতে তারা ব্যক্তিগত পক্ষপাত দিয়ে শিক্ষার্থীর স্বাধীনতাকে খাটো না করে। প্রশাসনকে পদক্ষেপ নিতে হবে, পোশাক নিয়ে হয়রানি হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে পারস্পরিক সম্মান গড়ে তুলতে হবে। গণমাধ্যমকেও দায়িত্ব নিতে হবেÑহিজাব বা বোরকা নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা না করে বৈচিত্র্যের ইতিবাচক দিক তুলে ধরতে হবে।

আমরা যদি সত্যিই আধুনিক, মানবিক ও প্রগতিশীল সমাজ গড়তে চাই, তবে নারীর পোশাক নয়, তার মেধা ও যোগ্যতাকে মূল্যায়ন করতে হবে। যে দিন আমরা এ শিক্ষাটি গ্রহণ করব, সেই দিনই বাংলাদেশ হবে প্রকৃত অর্থে বৈষম্যহীন সমাজ।

তামান্নার চোখের জল আমাদের প্রতিজ্ঞা মনে করিয়ে দেয়। যে চোখ একদিন অপমানে ভিজেছিল, আজ সেই চোখই গৌরবে ঝলমল করছে। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিতÑআগামী প্রজন্মের কোনো মেয়েকে যেন পোশাকের কারণে কাঁদতে না হয়। হিজাব বা বোরকা যেন তার স্বপ্নের পথে বাধা না হয়, বরং আত্মপরিচয়ের অংশ হয়ে ওঠে। তামান্নার জয় কেবল একজন মেয়ের জয় নয়; এটি পুরো সমাজের জন্য বার্তা। অপমানের দেয়াল ভাঙা যায়, বিদ্রƒপ স্তব্ধ করা যায়, বৈষম্যের শিকল ছিঁড়ে ফেলা যায়। তা সম্ভব হয় মেধা, সাহস ও প্রতিরোধের শক্তি দিয়েই। আমাদের প্রজন্মকে এ শিক্ষা নিতে হবে। পোশাক নিয়ে বিভাজন নয়, বৈচিত্র্য গ্রহণ করাই হবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ।

এ গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে নারীর অধিকার মানে শুধু আইন নয়, মানসিকতার পরিবর্তনও। সমাজকে প্রস্তুত করতে হবে, যাতে একদিন কোনো তামান্না তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারে, অপমান ছাড়া, স্বাধীনভাবে, হিজাবসহ বা না সহ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রÑসবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে, যেন নারীর স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে বাধা আর না থাকে। হিজাব তার বাধা নয়, শক্তি। বোরকা তার স্বাধীনতার অংশ। সমাজ যখন এ উপলব্ধি করবে, তখনই আমরা সত্যিকারের প্রগতিশীলতা ও মানবিকতা অর্জন করব।

আমাদের প্রজন্মকে শিক্ষা নিতে হবেÑঅপমানের দেয়াল ভাঙা যায়, বিদ্রƒপ স্তব্ধ করা যায়, বৈষম্যের শিকল ছিঁড়ে ফেলা যায়। হিজাব, বোরকা বা পোশাকের ভিন্নতা কখনো নারীর মেধা, যোগ্যতা বা নেতৃত্বকে সীমাবদ্ধ করতে পারে না। সে শিক্ষা যদি আমরা সবাই গ্রহণ করি, তাহলে আগামী প্রজন্মের বাংলাদেশ হবে ন্যায্য, বৈষম্যহীন ও মানবিক।