Final aim of all love intrigues, be they comic or tragic, is really of more importance than all other ends in human life. What it all turns upon is nothing less than the composition of the next generation. It is not the weal or woe of any one individual, but that of the human race to come, which is here at stake.’ - Schopenhauer
অর্থাৎ ‘ভালোবাসা সকল ষড়যন্ত্রের চূড়ান্ত লক্ষ্য- তা অতি তুচ্ছ হোক বা দুঃখজনক হোক, মানবজীবনের অন্যান্য সমস্ত লক্ষ্যের চেয়ে সত্যিই তা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এটা পরবর্তী প্রজন্মের আকাক্সক্ষার চেয়ে কম কিছু নয়। এটি কোনও একক ব্যক্তির সুখ বা দুঃখ নয়, বরং ভবিষ্যৎ মানব জাতির সুখ বা দুঃখ, যা ঝুঁকির মুখে।’ -শোপেনহাওয়ার
আসলে মানুষ যা কিছুই করুক না কেন, তা শুধুমাত্র ভালোবাসার তীব্র আকাক্সক্ষার কারণেই করে। তা হতে পারে দেশের জন্য ভালোবাসা, মানবতার জন্য ভালোবাসা, ব্যক্তির জন্য ভালোবাসা, সম্পদের জন্য ভালোবাসা ইত্যাদি। ভালোবাসার প্রচণ্ড টান অনুভব করলেই কেবল মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত হয়ে যায়। ভালোবাসার কাছে সবকিছু তুচ্ছ হয়ে যায়। ২০২৪-এর জুলাই বিপ্লবটা ছিল কোটি কোটি মানুষের দেশের প্রতি ভালোবাসার একটা চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। এটা ছিল বর্তমান প্রজন্মের একটা উপহার পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। এ বিপ্লব শুধু কোনো একক ব্যক্তির সুখ বা দুঃখের বিষয় ছিল না, বরং এটা ছিল ভবিষ্যৎ বাংলাদেশিদের অনুকুলে সুখ বা দুঃখের একটা স্মৃতিসৌধ নির্মাণ। যখন স্বাধীনতা-সার্বভোমত্ব প্রবল ঝুঁকির মুখে ছিল। এটা ছিল একটা রাষ্ট্রের টিকে থাকার লড়াই। মানবাধিকারের লড়াই। স্বাধীকার ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার লড়াই। দেশের প্রতি ভালোবাসার এ লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছে লক্ষ-কোটি ছাত্র-ছাত্রী, তরুণ-তরণীÑএটা সবাইকে মানতে হবে। ছাত্রদের নেতৃত্বেই সাধারণ জনতা এই লড়াইয়ে অংশ নিয়েছে। উত্তাল সে দিনগুলোর একক কৃতীত্ব শুধুমাত্র ছাত্র-ছাত্রীদের। আর সেই প্রতিটি দিনই ছিল মহামূল্যবান।
২০২৪-এর ফেলে আসা সে ধুধুময় দিনগুলোর কথা আমরা কখনো যেন ভুলে না যায়। তাহলে আমাদের সব স্বপ্ন সত্যি সত্যিই ফেলানির মতো কাঁটাতারে চিরদিন ঝুলে থাকবে। আলোয় আলোয় আর হয়তো কখনো হাসবে না আমার প্রিয় বাংলাদেশ।
২০২৪ জুলাই আন্দোলনের বেশির ভাগ সময় আমি ছিলাম বনশ্রী, ত্রিমোহনী, মেরাদিয়া, খিলগাঁও, বাসাবো, রামপুরা, বাসাবো বিশ্বরোড, মালিবাগ রেলগেট আর মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার বিভিন্ন রাস্তাঘাট অলি-গলিতে। কখনো পিকেটিং করেছি, কখনো মিশে গেছি আন্দোলনকারীদের সাথে, কখনো ফুটপাতে বসে ছিলাম। ছিলাম মসজিদে। নব্বইয়ের আন্দোলনের কথা স্মরণ করে আমি চুপচাপ ঘরে বসে থাকতে পারিনি। নব্বই আন্দোলনে একটানা ৭দিন মানে রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে অবস্থান করেছিলাম বাংলামটরে। শুধু পাওরুটি আর কলা খেয়ে। তখন কিন্তু আন্দোলনের উপর এভাবে গুলী চলেনি। নূর হোসেন হত্যাকাণ্ড ঘটেছিলÑ শোনা যায় তাও ছিল বিশেষ একটা গোষ্ঠির পরিকল্পিত। আর শহীদ হয়েছিল ডা. মিলনসহ কয়েকজন। যাহোক, ৯০-এ শিল্পী আবুল কাশেম ভাইয়ের দরাজকণ্ঠের গণসংগীত এখনো কানে বাজেÑ ‘বীর মুসলমান ধরো আল কুরআন, ফিরায়ে আনো সেই হারানো সম্মান- নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার’। ২০২৪-এর তুলনায় ১৯৯০-এর আন্দোলন ত্যাগের দিক দিয়ে বলা যায় অতি নগণ্য। তখন নারীসহ সাধারণ মানুষকে এভাবে ব্যাপকহারে আন্দোলনে যুক্ত হতে দেখিনি। মেয়েরা সে আন্দোলনে রাজপথে ছিলই না বলা যায়।
আসলে যে যা বলুক জুলাই বিপ্লবের মূল নাায়ক ছিল ছাত্ররা-ছাত্রীরা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে নার্সারি পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীরা বিপ্লবের অগ্নি মশাল হয়ে জ্বলে উঠেছিল। ২০২৪-এ এসে আমি দেখেছি আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা, শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতী, মা-ভপ্নি-কন্যা, শ্রমিক-রিকসাওয়ালা সবাই রাস্তায় নেমে এসেছিল জীবনটাকে খেলারপুতুল হিসেবে হাতে নিয়ে। একমাত্র ফিলিস্তিন ছাড়া এভাবে লক্ষ-কোটি মানুষকে জীবন হাতে নিয়ে রাস্তায় নেমে আসতে আমি আর কোথাও দেখিনি। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ছিল ২০২৪ আন্দোলনের সম্পূর্ণ উল্টো। তখন কিন্তু ২৪-এর মতো জনসম্পৃত্ততা ছিল না। ৭১-এ ২৫ মার্চ একটা গণহত্যা হয়েছিল। এরপর মানুষ শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। ফলে শহর বা আক্রান্ত এলাকা থেকে মানুষ দলে দলে পালিয়ে গিয়েছিল ভারতে। কিন্তু অতি আশ্চর্যের বিষয় ২০২৪-এর এ আন্দোলনের সময় আন্দোলনকরীরা এবং দেশের সাধারণ জনগণ কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়নি। তারা খালি হাতে বুক চিতিয়ে অস্ত্রের সামনে বীরদর্পে দাঁড়িয়ে গেছে। যার ফলশ্রুতিতে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলতে বাধ্য হয়েছিলÑ ‘স্যার, গুলী করি। মরে একটা। একটাই যায়, স্যার। বাকিডি যায় না। এটাই স্যার সবচে বড় আতঙ্কের।’ খুনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে এভাবেই আন্দোলনের ‘সমস্যা’র কথা বর্ননা করছিলেন এক পুলিশ। এতেই প্রমাণিত হয়, জহির রায়হানের ‘আসছে ফাল্গুনে দ্বিগুন হবো’ পড়ে বড় হওয়া প্রজন্ম তাঁর লেখাকেও অতিক্রম করে গেছে।
এভাবে সংলাপ লেখা সম্ভব ছিল না পৃথিবীর কোনো লেখকের পক্ষে, ‘গুলী করি। মরে একটা। একটাই যায়, স্যার। বাকিডি যায় না। এটাই স্যার সবচে বড় আতঙ্কের।’ এমন বাস্তব সংলাপ হাজার বছরে একবারই লেখা হয়। ইতিহাস যেন মনে রাখে, এই দেশে একটা বিপ্লব হয়েছিল। যেখানে কেউ বন্ধুর লাশ ফেলে জীবন নিয়ে পালিয়ে চলে যায়নি। বরং বন্ধুর গুলী খাওয়া দেখে আরো তীব্র আক্রোশে বুক পেতে দিয়ে বলেছিল, ‘বুকের ভিতর দারুণ ঝড়, বুক পেতেছি, গুলী কর।’ আন্দোলনের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল মহিলাদের আশ্চর্যজনকভাবে অংশগ্রহণ। আমরা দেখেছি হাজার হাজার মা-বোনের সাহসী উচ্চারণ ও রাজপথের লড়াকু সৈনিক হিসাবে।
বনশ্রী এলাকায় শিশু কন্যাদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। সম্ভবত ১৯ জুলাই আমি ত্রিমোহনী দিয়ে পায়ে হেটে একপর্যায়ে বনশ্রী ডিপিডিসি বিদ্যুৎ অফিস পর্যন্ত গেলাম। রাস্তাঘাট সব বেরিকেড দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়েছে, পিকেটিংও চলছে। রামপুরা টু ডেমরা প্রধান সড়ক একদম যানবাহন শূন্য। বিদ্যুৎ অফিসের ফিরোজ ভাই বললেন, সামনে যাওয়া ঠিক হবে না। প্রধান সড়ক বাদ দিয়ে চলে গেলাম গলির ভেতরে। বনশ্রী আবাসিক এলাকার ভেতরে ঢুকে দেখি এলাহিকাণ্ড। প্রতিটা গলিতে মা-বাবা, ভাই-বোন, শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই নেমে এসেছে রাস্তায়। এমনকি দুধের শিশুও। আমরা জানি বনশ্রী আবাসিক এরিয়ার রাস্তাগুলো অনেক প্রশস্ত। সব রাস্তা দেখছি বাঁশ আর রশি দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। রাস্তায় হাজার হাজার মানুষ। কারো হাতে পানি, কারো হাতে শুকনো খাবার এবং আশ্চর্যের বিষয় অধিকাংশের হাতে রং-তুলি। সবাই রাস্তায় ও দেয়ালে আল্পনা আর গ্রাফিতি অঙ্কনে মহাব্যস্ত। পাশাপাশি চলছে শ্লোগান। রাস্তায় লেখা হচ্ছিল ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিজ, পানি লাগবে পানি, খুনি হাসিনা নিপাত যাক, কোটা না মেধা- মেধা মেধা, ছাত্র হত্যার বিচার চাই ইত্যাদি। জুলাই মহাআন্দোলনে ছাত্র-ছাত্রী, শিশু, তরুণ-তরুণীসহ অনেকে সরকার ও সমাজের নানা অসঙ্গতি নিয়ে বিদ্রƒপাত্মক ভাষায় রাস্তা ও দেয়াল জুড়ে অনেক ধরনের শ্লোগান লিখেছিল। ফ্যাসিস্ট সরকারের কুৎসিত ছবি এঁকেছিল রাজপথ জুড়ে। ওয়াল ও রাস্তা জুড়ে ছিল খুনি হাসিনার রক্তখেকো বিকৃত ছবি। পুলিশের অত্যাচারের চিত্র। ছাত্রলীগের নির্যাতনের ছবি। সুদ, ঘুষ, খুন, চাঁদাবাজী, দুর্নীতির ছবিও ছিল প্রতিবাদের ভাষায়। ছিল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অসংখ্য কবিতার লাইন।
নতুন এক বাংলাদেশকে পাওয়া গেল ২০২৪ বিপ্লবের দেয়ালে দেয়ালে। গ্রাফিতি আর ক্যালিওগ্রাফির অন্য এক বাংলাদেশকে দেখা গেল দেয়ালে-রাজপথে। আশ্চর্যের বিষয় পৃথিবীর ইতিহাসে এভাবে স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনের প্রতিবাদ হিসেবে আরবি ক্যালিওগ্রাফি আঁকা যায় দেয়ালে দেয়ালে তা কেউ কোনো দিন কল্পনাও করতে পারেনি। এটা করেছিল সম্পূর্ণ মাদরাসার ছাত্ররা। এখনো নূর মসজিদ ও মালিবাগ জামেয়ার আশেপাশে অনেক আরবি ক্যালিওগ্রাফি জ্বলজ্বল করছে। সারা বাংলাদেশ জুড়ে একই ধরনের চিত্র এখনো উজ্জ্বল হয়ে আছে।
যে প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে খাতা-কলম, মোবাইল, ল্যাপটপ আর কম্পিউটারের সামনে রাত-দিন বুদ হয়ে বসে থেকে, ইউটিউব, ফেসবুক আর বিভিন্ন ওয়েবসাইটে, গেম খেলে-ফ্রি ফায়ার আর পাবজিতেÑ সে তাদের হাতের কোমল স্পর্শে রক্তের রঙে রঙিন হয়ে উঠল বাংলাদেশের নগর-মহানগর, শহর-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জের দেয়াল, গলিপথ থেকে রাজপথ। তারা এভাবে দেয়াল লিখন কখনো দেখেনি, নেই তাদের চিকামারার কোনো অভিজ্ঞতা। সে তো দেখেনি গত শতাব্দীর চিকামারার দৃশ্য। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই তো সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনও দেখেনি। নির্বাচনের চিকামারাও তারা বোঝে না। এ প্রজন্ম ড্রয়িং করে মাউস আর কী-বোর্ড দিয়ে কম্পিউটারের ক্যানভাসে। তারা ছবি আঁকে খাতার পাতায় আর মোবাইলে।
আন্দোলনকারীদের মুখে ছিল ‘এক, দুই, তিন, চার, খুনি হাসিনা গদি ছাড়’, ‘এই বাংলায় হবে না, বৈষম্যের ঠিকানা’, ‘আঠারোর হাতিয়ার, গর্জে ওঠো আরেকবার’, ‘আমার সোনার বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’, ‘এসো ভাই এসো বোন, গড়ে তুলি আন্দোলন’, ‘চলছেই চলবে, আমাদের আন্দোলন’-সহ সরকারবিরোধী বিভিন্ন ধরনের স্লোগান।
তরুণদের এ আন্দোলনে আরেকটা বিষয় লক্ষ্যণীয় ছিল। তা হলো আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন সবার মুখে মুখে, দেয়ালে দেয়ালে, রাজপথে। ‘মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দাম’ ‘কারার ঐ লৌহ কপাট, ভেঙে ফেল কররে লোপাট’; ‘বল বীর, চির উন্নত মম শির’; ‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে’; ‘অরুণ প্রাতের তরুণ দল’; ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা; ‘ভয়ের দেয়াল ভাঙলো এবার’ ইত্যাদি। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা এ আন্দোলনে অসামান্য প্রেরণা জুগিয়েছে। তাঁর কবিতা, গান যেমন ছিলো আন্দোলনকারীদের মুখে মুখে। তেমনি দেয়ালজুড়েও লেখা হয়েছিল রক্তগরম করা তার কবিতার পঙক্তি। এটা সারা বাংলাদেশ জুড়েই ছিল।
আসলে রংপুরে আবু সাঈদের শহীদ হওয়ার মধ্য দিয়ে জুলাই মহাআন্দোলন সর্বাত্মক গণআন্দোলনে রূপ নেয়। মহাবীরত্বের সাথে রাইফেলের নলের সামনে দু’হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে যাওয়া ছিল জুলাই আন্দোলনের একটা প্রতীক। মুহূর্তেই এ প্রতীকরূপী আবু সাঈদের দুই হাত প্রসারিত করা ছবি বিশ্বময় ভাইরাল হয়ে যায়। বুকে পর পর চারটি গুলী লাগার পরও দৌড়ে পালিয়ে যাননি আমাদের মহান বীর আবু সাঈদ। তার এ বীরত্বগাঁথা ছবি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম, ফেসবুক, ইউটিউব, ইন্টারনেটের মাধ্যমে পৌঁছে যায় ছাত্র-ছাত্রী তথা আন্দোলনকারীদের হৃদয়ে। আগুন ধরিয়ে দেয় রক্তে। মূলত তারপরই আন্দোলন সরকার পতনের এক দফায় গতি পায়। তাকে নিয়ে করা হয়েছে অসংখ্য দেয়ালচিত্র। প্রতিটি গ্রাফিতি বা দেয়াল চিত্রে দেখা যায় প্রসারিত দুই হাতসহ দণ্ডায়মান আবু সাঈদ। ছবির পাশে লেখা রয়েছে- ‘বুকের ভেতর দারুণ ঝড়/ বুক পেতেছি গুলী কর’। এ মহাবিপ্লবের আরেকজন মহান নেতা মীর মুগ্ধ। মুগ্ধ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল তৃষ্ণার্ত ছাত্র-জনতাকে পানি খাওয়ানোর জন্য। বুকে ঝুলানো আইডি কার্ড। হাতে পানির বোতল। মুখে শ্লোগান ‘পানি লাগবে পানি, কারো পানি লাগবে, পানি’। এই চিত্রটাও দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতিতে ব্যাপকভাবে স্থান পেয়েছে। দেয়ালে দেয়ালে মুগ্ধ পানির বোতল হাতে দাঁড়িয়ে আছে, সাথে লেখা আছে ‘পানি লাগবে, পানি?’।
আমি ২৪ জুলাই আবুল হোটেলের সামনে ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে ছিলাম। তিন দিক থেকে মারাত্মক আক্রমণ আসছিল আন্দোলনকারীদের উপর। রামপুরা চৌধুরী পাড়ার দিক থেকে পুলিশ, বিজিবি ও যুবলীগ, মালিবাগ রেলগেটের দিক থেকে পুলিশ, র্যাব, আর্মি এবং আনসার ক্যাম্পের দিক থেকে পুলিশ, আনসার, ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ। শুধু নয়াটোলা ছাড়া কোনো দিকে যাওয়ার মতো উপায় ছিল না। একটা অগ্নিদগ্ধ পুলিশের গাড়ি দেখলাম আবুল হোটেলের সামনের রাস্তায় পড়ে আছে। একপর্যায়ে সাংঘাতিক গোলাগুলি, টিয়ারসেল আর সাউন্ডগ্রেনেডের হামলা শুরু হলো। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় লক্ষ্য করলাম সাধারণ মানুষ অধিকাংশ ছিল এ আন্দোলনের পক্ষে। গোলাগুলির মধ্যে আমরা কয়েকজন একটা বাড়ির গেটের ভিতর ঢুকে গেলাম। বাড়িরওয়ালা সবাইকে নিরাপদে সেল্টার দিলেন। পুলিশ ও সন্ত্রাসীদের কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেননি।
যাহোক, ছাত্রদের এ মহান আন্দোলনে সঠিক ও ভুল অনেক কিছুই ছিল। প্রতিটি আন্দোলনেই এটা থাকে। মানুষ মাত্রই ভুল হয়। সঠিক-ভুল এগুলো তো খুবই আপেক্ষিক বিষয়। আমার কাছে যা সঠিক, অন্যের কাছে তা ভুল মনে হতেই পারে। আবার অন্যের কাছে যা সঠিক আমার কাছে তা ভুল মনে হয়। এটার প্রধান কারণ, একের আর অন্যের মানসিকতার পার্থক্য। তাই কোনটা ভুল আর শুদ্ধ এমন তুচ্ছ বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করার প্রয়োজন নেই। তর্কে-বিতর্কে এর সমাধান কখনোই হবে না। আমাদের দরকার হলো একটি সহনশীল ও গঠনমূলক সমাজের ক্ষেত্র তৈরি করা। যেখানে সবাই সবার মতটা তুলে ধরতে পারবে। সবার জন্য যুক্তির দোয়ার উন্মোচন করা। এভাবেই সমাজ ও রাষ্ট্রকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। প্রখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী ইবনে সিনা লিখেছেন, ‘বিতর্ক জ্ঞানীদের জন্য মেধার শাণস্বরূপ, মূর্খদের জন্য শত্রুতা তৈরির বীজ হিসেবে কাজ করে।’ আমরা আগামী প্রজন্মের জন্য একটা উর্বর ভিত্তিভূমি রেখে যেতে চায়। আর কত কাল আমরা চানক্যনীতির আড়ালে পিষ্ট হতে থাকবো।
আগুনের হলকার মতো একটা আওয়াজ ভাসতে থাকে বাতাসে, ইথারে ইথারে, একটা ঘোষণা আসতে থাকে লু হাওয়ার সাথে সাথে। ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিজ।’ তারপর থেকে এখনো পর্যন্ত চোখের সামনে যা কিছু দেখছি একদিন সব হয়তো উধাও হয়ে যাবে স্বপ্নের মতো। চাঁদের আলোয় কতই না বিশাল দেখা যায় এই পৃথিবীকে, এমন এক সময় আসবে তখন স্মৃতির আয়নায় এই পরিচিত পৃথিবীটাকে অনেক ছোট মনে হবে। আনন্দের আগমনী বার্তা নিয়ে এসেছিল যে ঘোষণা, সময়ের বিবর্তনে তা হয়তো একদিন মন খারাপের একটা যুক্তি নিয়ে হাজির হবে। তখন হয়তো কাউকে পাশে পাওয়া যাবে না। সব সময় স্মৃতির সাগর ডুব মেরে থাকে দিনের আলোয়। এমনকি সব স্মৃতিকেও মেঘ আড়াল করে রাখে। সাধারণত স্মৃতিতে থাকে বাস্তবতা বিবর্জিত আবেগ। আমাদের এ আবেগকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে ২০২৪-এর এ মহান জুলাই বিল্পবকে আমাদের প্রকৃত স্বাধীনতার দলিলে স্থান দিতে হবে। তা জুলাই সনদ বা যে নামেই হোক। এবার যদি আমরা ব্যর্থ হই তাহলে আমাদের এই বাংলাদেশকে আর কখনো আমরা সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবো বলে মনে হয় না।
লেখক : সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক।