জাহিদ হাসান
মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন এক ব্যক্তিত্ব, যাঁর চিন্তা, নীতি ও কর্মধারা উপমহাদেশের গণরাজনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। তাঁর রাজনৈতিক দর্শন কেবল ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা আন্দোলনকেন্দ্রিক স্লোগানে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা একটি বিস্তৃত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, নৈতিক নেতৃত্ব এবং জনগণকেন্দ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার সমন্বিত রূপ। রাজনৈতিক তত্ত্বের পরিভাষায় তাঁর চিন্তাভাবনাকে একদিকে গণমুখী পপুলিজমের নৈতিক সংস্করণ বলা যায়, অন্যদিকে শোষণবিরোধী সমাজচেতনার একটি স্বতন্ত্র ভাষ্য হিসেবেও মূল্যায়ন করা যায়। বিশেষ করে ঔপনিবেশিক যুগ, পাকিস্তানি নিপীড়ন এবং স্বাধীনোত্তর রাষ্ট্রগঠন, এ তিন পর্বেই ভাসানী এমন এক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন, যা আজও আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে রয়েছে।
মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তি হলো গণমুখী রাজনীতি ও জনগণের ক্ষমতায়ন, শোষণমুক্তির আদর্শ ও অর্থনৈতিক ন্যায্যতা, নৈতিক নেতৃত্ব ও রাষ্ট্রক্ষমতার সমালোচনা, ধর্ম ও রাজনীতির সম্পর্ক ও জনগণকে রাজনীতির কেন্দ্রীয় উপাদান হিসেবে দেখা।
মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক তত্ত্বের সবচেয়ে মৌলিক অংশ হলো জনগণকে রাজনীতির ‘সাবজেক্ট’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। তাঁর মতে, জনগণ কেবল ভোটার নয়; তারা রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক। এই ধারণা আধুনিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক তত্ত্বে চর্চিত হলেও উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে ভাসানীর প্রয়োগ ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। কারণ তিনি গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে আবদ্ধ রাখেননি; বরং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক সচেতনতা এবং সামাজিক আন্দোলনকেই গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি বলে মনে করেছেন।
ভাসানী উপলব্ধি করেছিলেন যে রাষ্ট্রক্ষমতা প্রায়শই জনগণের আকাক্সক্ষাকে উপেক্ষা করে ক্ষমতাকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। তাই তিনি রাজনীতিকে ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতা হিসেবে দেখার বদলে জনগণের অধিকার রক্ষার সংগ্রাম হিসেবে দেখেছেন। তাঁর রাজনৈতিক দর্শনে “মজলুম জননেতা” উপাধিটি শুধু জনপ্রিয়তার প্রতিফলন নয়; বরং এটি জনগণের প্রতি তাঁর নৈতিক দায়বদ্ধতার রাজনৈতিক স্বীকৃতি।
তিনি ভূমিহীন কৃষকের জমির অধিকার, শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি, ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মোকাবিলার দায়িত্ব, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা- এসব প্রশ্নকে রাজনৈতিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে এনে দেখিয়েছেন যে রাষ্ট্র কেবল আইন-প্রশাসনের কাঠামো নয়; এটি একটি সামাজিক চুক্তি, যেখানে জনগণের কল্যাণই সর্বোচ্চ লক্ষ্য।
মওলানা ভাসানীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো রাজনৈতিক মুক্তিকে অর্থনৈতিক মুক্তির সঙ্গে একাকার করে দেখা। তাঁর মতে, যে সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য রয়ে যায়, যেখানে উৎপাদনব্যবস্থার ওপর কিছু মানুষের একচেটিয়া প্রভাব থাকে, যেখানে কৃষক-শ্রমিক শোষণের শিকার হয়- সেখানে রাজনৈতিক স্বাধীনতা বাস্তবায়িত হতে পারে না।
এখানে তাঁর চিন্তার সঙ্গে মার্ক্সীয় ধারা বা সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক নীতির একটি ছায়া দেখা যায়, যদিও তাঁর রাজনীতি কখনোই কড়াভাবে আদর্শিক ছিল না। বরং তিনি প্রেক্ষিত-নির্ভর বাস্তববাদী। তিনি বলেননি যে সমাজকে অবশ্যই নির্দিষ্ট কোনো মতাদর্শে পরিচালিত হতে হবে; বরং তাঁর চিন্তা ছিল-অর্থনৈতিক সম্পদের ন্যায়সঙ্গত বণ্টন ছাড়া সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
ফলে জমি সংস্কার, পানি ও নদীর ন্যায্য ব্যবহার, ফসলের দাম নির্ধারণে কৃষকের স্বার্থ, শ্রম অধিকার, খাদ্যস্বয়ংসম্পূর্ণতা- এসব প্রশ্ন তাঁর রাজনৈতিক দর্শনে কেন্দ্রীয় হয়ে ওঠে। ফারাক্কা লংমার্চ ছিল তাঁর এ অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির এক সুস্পষ্ট উদাহরণ। এটি শুধু নদীর পানি নিয়ে প্রতিবাদ ছিল না; বরং এটি ছিল সম্পদ বণ্টনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে জনগণের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা।
মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক দর্শনের আরেকটি বিশেষ দিক হলো রাষ্ট্রক্ষমতার প্রতি তাঁর গভীর সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি বিশ্বাস করতেন, ক্ষমতা স্বভাবগতভাবে কেন্দ্রীভূত হয় এবং সেই কেন্দ্রবিন্দু থেকে জনগণের কল্যাণ প্রায়শই উপেক্ষিত হয়। এ কারণেই তিনি বারবার দলত্যাগ করেছেন, নতুন দল গঠন করেছেন, প্রয়োজন হলে এককভাবে অবস্থান নিয়েছেন। তাঁর কাছে ক্ষমতার প্রতি আনুগত্যের চেয়ে নীতির প্রতি আনুগত্য গুরুত্বপূর্ণ। তিনি প্রায়ই বলতেন: “নির্যাতনের বিরুদ্ধে নীরবতা হলো নির্যাতনকারীর পক্ষ নেওয়ার সমান।”
তাঁর নেতৃত্বের নৈতিকতা তিনটি মূল স্তম্ভে দাঁড়িয়ে ছিল- ১. অবিচল নীতি: তিনি সুবিধাবাদী রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ২. জনস্বার্থকে অগ্রাধিকার: ব্যক্তিগত লাভ বা দলীয় স্বার্থ তাঁর কাছে কখনোই প্রাধান্য পায়নি। ৩. অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহসী প্রতিবাদ: স্বৈরাচারী শক্তির বিরুদ্ধে তিনি কখনো নীরব ছিলেন না। রাজনৈতিক বিজ্ঞানের আলোচনায় তাঁর নেতৃত্বকে “নৈতিক পপুলিজম” বলা যেতে পারে- যেখানে জনগণের পক্ষ নেওয়া শুধু কৌশল নয়, বরং নীতিগত অবস্থান।
মওলানা ভাসানীর পরিচয়ে ‘মওলানা’ শব্দটি তাঁর ধর্মীয় শিক্ষার পরিচায়ক, কিন্তু ধর্মকে তিনি কখনোই রাজনৈতিক বিভাজন বা স্বার্থসিদ্ধির উপায় হিসেবে ব্যবহার করেননি। তাঁর রাজনৈতিক দর্শনে ধর্ম একটি নৈতিক কাঠামো, কোনো ক্ষমতার প্রকরণ নয়। তিনি স্পষ্টভাবে বিশ্বাস করতেন- ধর্ম মানুষের কাছে ন্যায়, সত্য, সততা ও মানবিকতার পাঠ দেয়। ধর্মকে যদি ক্ষমতা অর্জনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তবে তা সমাজকে বিভক্ত ও দুর্বল করে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের নৈতিক মানদণ্ড নির্ধারণে ধর্মীয় মূল্যবোধ গুরুত্বপূর্ণ হলেও ধর্মীয় পরিচয়কে রাজনৈতিক বিভেদের ভিত্তি করা অনৈতিক। এ দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে ধর্মীয় রাজনীতির উগ্রতা এবং রাষ্ট্রীয় রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার উভয় ক্ষেত্রেই সমালোচনামূলক অবস্থানে দাঁড় করায়।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে মওলানা ভাসানী ছিলেন তৃতীয় বিশ্বের পক্ষে এক শক্তিশালী কণ্ঠ। তিনি উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামে কেবল সহানুভূতি দেখাননি; বরং নীতি-আদর্শের ভিত্তিতে যুক্তিসম্মত অবস্থান গ্রহণ করেছেন।
তাঁর আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি তিনটি স্তরে ব্যাখ্যা করা যায় ১. সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা: তিনি মনে করতেন যে বিশ্বব্যবস্থা বড় শক্তিগুলোর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং এই প্রভাব তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্র্য ও রাজনৈতিক অস্থিরতার অন্যতম কারণ। ২. জাতিগত self-determination- এর প্রতি শ্রদ্ধা: তিনি বিশ্বাস করতেন প্রতিটি জাতির নিজস্ব রাজনৈতিক পথ তৈরির অধিকার আছে। ৩. বৈশ্বিক সংহতির প্রয়োজনীয়তা: তিনি তৃতীয় বিশ্বের নেতৃত্বের মধ্যে ঐক্য দেখতে চেয়েছিলেন, যাতে বৈশ্বিক শোষণের বিরুদ্ধে সম্মিলিত অবস্থান তৈরি হয়। তাঁর আন্তর্জাতিক অবস্থান ছিল কোনো পরাশক্তির প্রতি অন্ধ আনুগত্য নয়; বরং স্বতন্ত্র রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও নৈতিকতার ওপর প্রতিষ্ঠিত।
স্বাধীনতার পরও মওলানা ভাসানীর অবস্থান ছিল সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর চোখে রাষ্ট্র গঠনের চ্যালেঞ্জ ছিল মূলত- সম্পদের ন্যায়বণ্টন, প্রশাসনিক জবাবদিহি, দুর্নীতির দমন, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের মালিকানাবোধ সৃষ্টি। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে স্বাধীন রাষ্ট্রেও শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে সাধারণ মানুষের দূরত্ব বৃদ্ধি পেতে পারে। তাই স্বাধীনতার পরও তিনি জনগণের অধিকার, ন্যায়বিচার এবং রাষ্ট্রীয় জবাবদিহির প্রশ্নগুলোকে সামনে এনেছেন। এখানে তাঁর রাজনৈতিক দর্শন জাতীয়তাবাদের উচ্ছ্বাসের বাইরে গিয়ে একটি দীর্ঘমেয়াদি রাষ্ট্রনৈতিক কাঠামো নির্দেশ করে, যা আজও বাংলাদেশের রাজনৈতিক আলোচনায় একটি পরিপক্ব দৃষ্টিকোণ যোগ করে।
আজকের রাজনৈতিক বাস্তবতায়, যেখানে-অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ছে, রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়শই জনগণ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, সে প্রেক্ষাপটে ভাসানীর রাজনৈতিক দর্শন নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক দর্শন কোনো একক মতাদর্শ বা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক প্রোগ্রামের ভেতর আবদ্ধ নয়; বরং এটি ন্যায়, মানবিকতা, গণঅধিকার, শোষণমুক্তি এবং নৈতিক নেতৃত্বের একটি সমন্বিত ধারণা। উপমহাদেশের রাজনীতিতে তিনি যেভাবে জনগণের স্বার্থকে কেন্দ্র করে রাজনীতিকে পুনর্গঠন করেছেন, তা তাঁকে ঐতিহাসিক গুরুত্বের একটি স্বতন্ত্র অবস্থানে নিয়ে যায়। তাঁর রাজনৈতিক দর্শন আমাদের শেখায়-ক্ষমতার মূল উদ্দেশ্য হলো জনগণের সেবা, রাজনীতি কখনোই মানবিকতার বাইরে যেতে পারে না, অন্যায়ের বিরুদ্ধে নীরবতা অনৈতিক, আর জনগণের অধিকারই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বৈধতা। তাই মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক দর্শন কেবল ইতিহাসের দলিল নয়; এটি সমকালীন রাজনীতির জন্যও একটি নির্দেশনা ও একটি নৈতিক মানদণ্ড।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।