সম্প্রতি সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে একের পর এক নিষ্ঠুর, বেদনাদায়ক ও মর্মান্তিক সব ঘটনা ঘটেই চলেছে। একটি ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আরেকটি ঘটনা পূর্বের ঘটনাকে ভুলিয়ে দিচ্ছে। আমরা এমনভাবে ভুলে যাচ্ছি, যেন কিছুই ঘটেনি। ফ্যাসিবাদের পতনের পর দেশের মানুষ আশা করেছিল একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ে উঠবে- যেখানে গুম, খুন, হত্যা ও ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ থেকে মুক্তি মিলবে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৫ বছর পেরিয়ে গেলেও সেসব স্বপ্ন আজ অব্দি অধরা। অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই দেশের বিভিন্ন স্থানে হত্যা, ছিনতাই, ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। প্রতিদিন ঘর থেকে বের হয়ে আবার নিরাপদে ফিরে আসা পর্যন্ত পরিবারের সদস্যরা এক অজানা আতঙ্কে থাকেন, কখন কে, কার প্রাণ কেড়ে নেয়। আইনশৃঙ্খলার অবস্থা এতটাই নাজুক যে, দিনের আলোতেই ঘটে যাচ্ছে খুন, ধর্ষণ ও ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা। মিটফোর্ডে ব্যবসায়ী সোহাগের হত্যা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ময়নাকে নির্মমভাবে হত্যা, চাঁদপুরে খতিবের ওপর বর্বর হামলা, পল্লবীতে ৫ কোটি টাকা চাঁদা না পেয়ে সন্ত্রাসীদের তাণ্ডব এবং শ্যামলীতে পরনের কাপড় খুলে ছিনতাইয়ের মতো ভয়ংকর ঘটনাগুলো থেকে স্পষ্ট- সহিংসতা, বিচারহীনতা এবং উগ্রতা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রকে গ্রাস করছে। এ নারকীয় হত্যাযজ্ঞের দ্রুত অবসান কাম্য। ৯ জুলাই দিনটি ফিরে আসবে, কিন্তু সোহান ও সোহানার বাবা লালচাঁদ ওরফে সোহাগ আর কখনও ফিরবেন না। এ দিনটি তাঁদের জীবনে এক দুঃসহ বেদনার স্মৃতি হয়ে রয়ে যাবে। রাজধানীর মিটফোর্ড এলাকায় সোহাগকে নরপশুরা কুপিয়ে ও পাথর দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এ ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়তেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা ভাইরাল হয় এবং দেশজুড়ে নিন্দার ঝড় ওঠে। এ দৃশ্যের ভিডিও যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, গোটা দেশ স্তব্ধ হয়ে যায়। মানবতা কেঁদে উঠে। শুধু একজন মানুষকে হত্যা করা হয়নি- হত্যা করা হয়েছে বিবেক, ন্যায়বোধ ও মানবতাকে।

এ ঘটনার নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই। আমরা স্তম্ভিত, ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ। বর্বর, পৈশাচিক এ ঘটনার নিষ্ঠুরতা প্রকাশ করাও কঠিন। ইতিহাসের পাতায় মিটফোর্ডের এ ঘটনা স্থান করে নেবে। মানুষ মানুষকে এভাবে হত্যা করতে পারে তা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। এ ভিডিও কতটা ভয়াবহ, নির্মম ও নিষ্ঠুর তা ভাষায় ব্যক্ত করে কাউকে বুঝানো যাবে না। শত শত মানুষের সামনে বিবস্ত্র করা, শরীরের ওপর উঠে লাফানোর ভিডিও ও পাথর মেরে হত্যার ঘটনার নির্মম দৃশ্য জাহেলিয়াতের লোমহর্ষক নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। পাশবিক এ হত্যার দায় আমরা কেউ এড়াতে পারি না। কারণ শত শত মানুষের সামনে সোহাগকে যখন হত্যা করা হয় তখন অনেকে তাঁর বাচার আকুতি শুনেছে। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। সবাই নীরব ছিল। কেউ কেউ ভিডিও ধারণ করেছিল। আবার কেউ কেউ দূর থেকে পাথর ছুড়ে মারার দৃশ্য দেখছিল। কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করেনি। প্রতিবাদ করার সাহসটুকু কেউ করার চেষ্টা করেনি। এমনকি জাতীয় হেল্প লাইন ৯৯৯ ফোন দেয়ার গরজটুকু কেউ করেনি। সবাই সন্ত্রাসীদের ভয়ে মুখ বন্ধ রেখেছিল। অথচ কোন একজন মানুষ যদি একটু আওয়াজ তুলত তাহলে সোহাগের জীবন হয়ত বেঁচে যেতে পারত। সোহান আর সোহানী ফিরে পেত তার প্রিয় বাবাকে। সন্তানের কাঁধে বাবার লাশ পাহাড় সমান ভারী। যাদের বাবা পৃথিবীতে বেঁচে আছেন তারা হয়ত এ বিষয়টি অনুধাবন করতে পারেন না। কিন্তু যাদের বাবা নেই, তারা বাবার শূন্যতা হারে হারে টের পান।

লালচাঁদ ওরফে সোহাগের সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্ক নেই, নেই কোন ব্যক্তিগত পরিচয়ও। তবু তাঁর নির্মম মৃত্যুতে হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। তাঁর পরিবারের দায়ভার কে নেবে? এ পরিবারটি কিভাবে চলবে? সে প্রশ্নের উত্তর নেই। তাঁর স্ত্রী লাকি বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন- পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিকে ওরা বাঁচতে দিল না। এখন আমরা কীভাবে বাঁচব? আমার সন্তান আর কখনো তার বাবাকে দেখতে পাবে না- আমার সব শেষ হয়ে গেছে। মর্মান্তিক এ ঘটনায় আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, নৃশংস এ হত্যার মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হবে। তিনি বলেন, মিটফোর্ডের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচারে সরকার বদ্ধপরিকর। পুলিশ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইন, ২০০২ এর ধারা ১০ এর অধীন দ্রুততম সময়ের মধ্যে আসামিদের বিচারের ব্যবস্থা করা হবে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, এ ঘটনাটা বড়ই দুঃখজনক। একটা সভ্য দেশে এমন একটি ঘটনা কখনোই আশা করা যায় না। এটার জন্য যাঁরা দায়ী, তাঁদের পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

দেশের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক সহিংসতা, দখল, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার, ছিনতাই ও হত্যার ঘটনাও ঘটছে। নিচে কিছু ঘটনা উল্লেখ করা হলো। গত শুক্রবার রাজধানীর শ্যামলীতে ছিনতাইয়ের ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায় ছিনতাইকারীরা এক পথচারী যুবকের সঙ্গে থাকা সবকিছু নেওয়ার পর তার গায়ের জামাকাপড়, পোশাক, পায়ের জুতা পর্যন্ত খুলে নেয়। এ সময় তাদের হাতে থাকা ধারালো অস্ত্র দিয়ে ভুক্তভোগীকে ভয় দেখানো হয়। ছিনতাই শেষে মোটরসাইকেলে চেপে ছিনতাইকারীরা পালিয়ে যায়। শুক্রবার ভোর ৫টার দিকে শ্যামলীর একটি গলিতে এ ঘটনা ঘটে। অপরদিকে ৫ কোটি টাকা চাঁদা না পেয়ে রাজধানীর পল্লবীর আলব্দিরটেকে এ কে বিল্ডার্স নামে একটি আবাসন নির্মাণ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানান, ৫ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করে না পেয়ে একদল লোক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। হামলাকারীরা এ সময় চারটি গুলী করেছে। সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত কর্মকর্তাকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ১১ জুলাই শুক্রবার চাঁদপুরে জুম্মার নামাজের পর শহরের প্রফেসর পাড়া মোল্লা বাড়ি জামে মসজিদের ভেতর খতিব মাওলানা আনম. নূরুর রহমান মাদানীকে কুপিয়ে জখম করা হয়। তিনি গুনরাজদী এলাকার বাসিন্দা। নির্মম এ নিষ্ঠুর ঘটনা সম্পর্কে মসজিদের মুসল্লিরা জানিয়েছেন যে, অনেকেই মসজিদ থেকে নামাজ শেষ করে বের হয়ে যান তখন খতিব সাহেব নামাজ পড়ছিলেন। এমন সময় বিল্লাল হোসেন নামের এক ব্যক্তি চাপাতি দিয়ে খতিবকে কোপাতে শুরু করেন। পরে মুসল্লিরা তাঁকে উদ্ধার করে চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। বর্তমানে তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

গত ৩ জুলাই সকালে কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার আকবপুর ইউনিয়নের কড়ইবাড়ি গ্রামে দুই নারীসহ তিনজনকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। খুলনার দৌলতপুরে নিজ বাসার সামনে যুবদল নেতা মাহবুবুর রহমান মোল্লাকে তার বাড়ির সামনে গুলী করে হত্যা করা হয়। ১৯ ফেব্রুয়ারি সকালে উত্তরায় ভিক্টর পরিবহনের একটি চলন্ত বাসে যাত্রীবেশী ৫-৬ যুবক অস্ত্র ঠেকিয়ে ছিনতাই করে। ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরে এক নারী ও পুরুষকে রামদা দিয়ে কোপানোর ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ সদর দপ্তরের ভাষ্যমতে- চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ৫ মাসে দেশে ১ হাজার ১৩৯ টি ডাকাতি ও দস্যুতার মামলা হয়েছে, যা গড়ে প্রতি মাসে ২২৮টি। গত বছর প্রতি মাসে এই সংখ্যা ছিল গড়ে ১৫৮। এই ৫ মাসে হত্যা মামলা হয়েছে ১ হাজার ৫৮৭টি, যা গড়ে প্রতি মাসে ৩১৭টি। আগের বছর প্রতি মাসে ছিল ২৮৬টি। নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় গত ৫ মাসে ৯ হাজার ১০০ মামলা হয়েছে, যা গড়ে প্রতি মাসে ১ হাজার ৮২০টি।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি জনমনে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। সন্ধ্যা হলেই ছিনতাই-ডাকাতির আতঙ্কে সাধারণ মানুষ বাসা থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছে। কোথাও কোথাও কিছু মানুষ মিলে কুপিয়ে ও পিটিয়ে মায়ের সামনে সন্তানকে মারছে, কোনো কোনো খুনি হত্যার পর মরদেহ টুকরা টুকরা করছে। ডেভিল হান্ট, নামক বিশেষ অভিযানের মধ্যেও খুনোখুনি, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, ধর্ষণ মব ভায়োলেন্স থামেনি। একজন বাবা সন্তানের সামনে খুন হচ্ছেন, একজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব মসজিদে কোপ খাচ্ছেন, একজন পথচারী পাথরের আঘাতে নিহত হচ্ছেন, আর জনতা নীরব দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে-এটাই কি আমাদের অর্জিত স্বাধীনতা? রাষ্ট্র যদি এখনই জেগে না ওঠে, সমাজ যদি বিবেকের কন্ঠে সাড়া না দেয় তাহলে সামনে আরও সংকট বাড়বে। মানুষের জীবনের নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার এবং মানবিক রাষ্ট্র গঠনে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। বাবা হারা সন্তানের কান্না, স্বামী হারা স্ত্রীর কান্না ও নিরস্ত্র মানুষের লাশের মিছিল আমরা আর দেখতে চাই না। আমরা এমন একটি বাংলাদেশ চাই- যেখানে রাষ্ট্র সকল মানুষের নিরাপত্তা ও ইনসাফপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করবে, এমনটিই আমাদের প্রত্যাশা। লেখক : প্রাবন্ধিক।