আজ ১৬ ডিসেম্বর, মহান বিজয় দিবস। বিজয় দিবসের এ শুভলগ্নে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এ জনপদের সব মানুষকে জানাই বিজয় অভিবাদন। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও রক্তের বিনিময়ে জনগণের স্বাধীন রাষ্ট্রের আকাক্সক্ষা বাস্তবে রূপলাভ করেছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। তাই প্রতিবছর এ দিনটিকে জাতি স্মরণ করে গভীর শ্রদ্ধার সাথে। আমাদের বিজয়ের ৫৪ বছর পূর্ণ হবে এ ডিসেম্বরে। জাতীয় ইতিহাসের পাতায় গত ৫৪ বছরে যুক্ত হয়েছে আনন্দ-বেদনা এবং গর্ব ও দীনতার নানা ঘটনা। এমন প্রেক্ষাপটে বিজয়ের দামামা বাজানোর পাশাপাশি আমাদের পালন করতে হবে আত্মসমালোচনার দায়িত্বও। কারণ, আত্মসমালোচনা ছাড়া কোনো জাতি তার কাংখিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না।

ইতিহাসের পাঠক মাত্রই একথা জানেন যে, এ জনপদের মানুষের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা দীর্ঘদিনের একটি লালিত বিষয়। স্বাধীনতার লক্ষ্যে তারা যুদ্ধ করেছেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে, পাকিস্তানের জালেম শাসকদের বিরুদ্ধে। স্বাধীনতার এ দীর্ঘপথ পরিক্রমায় নেতৃত্ব প্রদানের জন্য আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে থাকি নবাব সিরাজ-উদ্দৌলা, শহীদ তিতুমীর, নবাব সলিমুল্লাহ, শেরে বাঙলা এ. কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহারাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদ জিয়াউর রহমানসহ আরো অনেক মহান নেতাকে। আমরা জানি যে, স্বাধীনতা অর্জনের চাইতেও কঠিন হলো স্বাধীনতা রক্ষা এবং স্বাধীনতার লক্ষ্যসমূহ অর্জন করা। এ ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জিত না হলে স্বাধীন রাষ্ট্রও পরিণত হতে পারে ব্যর্থ রাষ্ট্রে।

স্বাধীনতার ৫৪ বছরে বাংলাদেশ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিছুটা এগিয়ে গেছে। কিন্তু রাজনৈতিক অঙ্গনে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও নৈতিক বিবেচনার অভাবে জাতীয় ঐক্য ও সংহতির ক্ষেত্রে আমরা ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছি। রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন ব্যর্থতার কারণে আমরা কাক্সিক্ষত উন্নয়ন, সুশাসন ও নিরাপত্তা লাভে সমর্থ হইনি। ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট আজ দেশে-বিদেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। এমন বাস্তবতায় আমাদের দীর্ঘকালের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম এবং স্বাধীনতার ইতিহাস পুনঃপাঠ প্রয়োজন। আমাদের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম তো শুধু ক্ষমতার পালাবদলের জন্য ছিল না। ব্যক্তি বা দলের মহিমা কীর্তনও আমাদের স্বাধীনতা যুুদ্ধের লক্ষ্য ছিল না। গণতান্ত্রিক মূলবোধ ও ইনসাফের চেতনায় এ জনপদের মানুষের সামগ্রিক মুক্তিই ছিল আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্য। দেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটলে এবং সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নতি হলে আমরা উপলব্ধি করবো স্বাধীনতার লক্ষ্য পূরণ হচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, বিশেষ বিশেষ ঘরানার মানুষদের অতি উন্নতি হলেও আমজনতা এখনো জীবনযুদ্ধে বিপর্যস্ত। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে এসে গণতন্ত্রের জন্য আমাদের হাহাকার করতে হচ্ছে। একটি স্বচ্ছ ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টি এখন আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে উঠেছে। এর বহু কারণ রয়েছে, তবে বড় কারণ হলো, শেখ হাসিনার বিগত ১৫ বছরের ফ্যাসিস্ট শাসন।

শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট আমলে দিনের ভোট রাতে হয়েছে। ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪ আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হওয়ার মত ঘটনাও আমাদের দেশে ঘটেছে। ভোট ছাড়াই বিজয় লাভের এমন উদাহরণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ফ্যাসিস্ট আমলে গুম, খুন, দুর্নীতি, স্বাজনপ্রীতি, ব্যাঙ্কলুট দেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত করছিল। এমন বাস্তবতায় দেশের ছাত্র-জনতা রুখে দাঁড়িয়েছে, রাজপথ দখলে রেখেছে। বিপরীতে শাসক দল গণহত্যায় নেমেছে, ব্যবহার করেছে দলীয় সন্ত্রাসী ও আইন-শৃংখলা বাহিনীকে। এ যুদ্ধে জয় হয়েছে দেশের বীর ছাত্র-জনতার। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে পরাজয় হয়েছে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের। হাসিনা পালিয়ে গেলেও ষড়যন্ত্র বন্ধ করেনি, আর তাতে ইন্ধন দিয়ে যাচ্ছে পরাজিত শক্তির দোসররা। বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হয়েছে। নির্বাচন ব্যর্থ করতে চায় হাসিনার দেশি-বিদেশি দোসররা। বিপ্লবী ওসমান হাদির জীবন নাশের চেষ্টা তার বড় প্রমাণ। তাই এবার বিজয় দিবসের বার্তা হলো, সুষ্ঠু-সফল নির্বাচন। দেশের রাজনীতিবিদদের এ পরীক্ষায় হতে হবে উত্তীর্ণ।