জুলাই আন্দোলনের বছরপূর্তিতে এক দিকে যেমন আনন্দ অন্য দিকে কিছু কিছু শঙ্কাও ধ্বনিত হচ্ছে। ঐক্যবদ্ধ না থাকলে স্বৈরাচার ফিরে আসার শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। এ কথাই ধ্বনিত হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার মুখে। গত মঙ্গলবার রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে জুলাই স্মরণ অনুষ্ঠান জাতিসংঘের তথ্য অনুসন্ধান প্রতিবেদনে সুপারিশ বাস্তবায়ন শীর্ষক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মো. ইউনূস। তিনি বলেন, এটা ওপরে একটা প্রলেপ দেওয়ার পরিবর্তন না, গভীরতমভাবে পরিবর্তন।
সে গভীরতম পরিবর্তন যদি না করি, যে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আজকে আমরা কথা বলছি, আবার ঘুরে ফিরে সে চলে আসবে, যতই আমরা সামাল দেই, যতই সংস্কার করি। আমাদের আরও গভীরের সংস্কার দরকার। এই সংস্কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রধান উপদেষ্টা গভীরতর সংস্কারের যে কথা বলেছেন তা জুলাই বিপ্লবের মূল কথা বলে আমরা মনে করি। আমরা মনে করি তিনি যথার্থভাবেই মানুষের মনের কথাটি বলতে পেরেছেন। আমরা এও মনে করি জুলাই সনদ ঘোষণার ক্ষেত্রেও এই গভীর সংস্কার বা পরিবর্তনের ধারাটি অনুসরণ করা দরকার।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বছরের পর বছর আয়নাঘরে নির্মম অত্যাচার করেছে। সেখানে ইলেকট্রিক চেয়ার রেখেছে, সেগুলো তো আমাদের দেখারও সুযোগ হয়নি। সে কাহিনিগুলো মিলে আমাদের এখনকার বাংলাদেশ। আমাদের সার্বিক প্রচেষ্টা, এটা থেকে যদি আমরা শিক্ষা পাই, যে দেশ আমরা গড়তে চাই, মুখের ভাষার একতা না, যেটা বললাম, বলে গেলাম ওরকম না। গভীরভাবে শিখে আসবে, আমাদের তরুণরা শিখে আসবে এই দেশ একেবারে নতুন করে বানিয়ে আনতে হবে।
তিনি বলেন, আমার আবেদন হচ্ছে, আমাদের জাতির ভেতরে এমন কিছু রয়ে গেছে, যতই শাস্তি দেই সেটার বীজ বোধহয় আমাদের মধ্যে থেকে যাবে। এ বীজ থেকে আমরা কীভাবে মুক্তি পাই, এটাই আজকে জানার বিষয়, আমাদের চ্যালেঞ্জের বিষয়। এটা কয়েকটা কাগজের সংস্কার না। এটা মনের গভীরতম জায়গার সংস্কার। আজকে জুলাইয়ের যে শিক্ষা সেটা হবে কীভাবে নিজে থেকে নতুনভাবে যাতে আবিষ্কার করতে পারি নিজেকে, তাহলে জাতি হিসেবে আমরা পুনর্জন্ম লাভ করবো। জুলাই আমাদের পুনর্জন্মের মাস, এটা শুধু স্বৈরাচারী মুক্তির মাস না। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে, একটি নতুন ধারার রাজনৈতিক ব্যবস্থার চারপাশে একটি বিস্তৃত জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তুলতে আমরা কাজ করছি। লক্ষ্যটা পরিষ্কার, এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যেখানে সব বাংলাদেশি শান্তিতে, গর্বের সঙ্গে, স্বাধীনতা ও মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করতে পারবে।
প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সূচনালগ্ন থেকেই জাতিসংঘ আমাদের রূপান্তরের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে উঠেছে। আমি জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসকে তার অকুণ্ঠ সমর্থন ও সংহতি এবং এ বছরের মার্চে বাংলাদেশ সফরের জন্য ধন্যবাদ জানাই। আমি হাইকমিশনার ভোলকার টার্ক, ওএইচসিএইচআর ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং টিমের সদস্য, জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গুইন লুইস এবং অবশ্যই আমার বন্ধু সিনিয়র মানবাধিকার উপদেষ্টা হুমা খানকে তাদের অসাধারণ ও ঐতিহাসিক অবদানের জন্য গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই। তিনি বলেন, আমাদের কাজ এখনও শেষ হয়নি। আমাদের সংস্কার এজেন্ডার পাশাপাশি, আমরা গুরুতর লঙ্ঘনের জন্য দায়ীদের জন্য আইনি জবাবদিহি অনুসরণ করছি। কিন্তু বিচার মানে শুধু শাস্তি নয়। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাও, যাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আর কখনও তার নিজের জনগণকে দমন, নীরব বা ধ্বংস করার জন্য ব্যবহার করা যাবে না।
আমরা মনে করি প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে ও অন্তর্বর্তী সরকারের কাজের মধ্যে একটি সমন্বয় দরকার। তিনি যে সব ভাল ভাল কথা বলছেন, সরকারের বিভিন্ন অঙ্গের কাজের ধারার মধ্যেও তার একটা প্রকাশ বা অনুরণণ থাকতে হবে। আর এভাবেই একটি গভীরতম সংস্কার বাস্তবায়িত হতে পারে। সে লক্ষ্যে সব কাজ পরিচালনার জন্য আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি জানাই।