২১ জুলাই ২০২৫। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ইতিহাসে এক ভয়াল দিন। কুর্মিটোলায় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করা একটি এফটি সেভেন বিজিআই প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান অল্প সময়ের মধ্যেই যান্ত্রিক ত্রুটিতে ভুগে বিধ্বস্ত হয় উত্তরার দিয়াবাড়িস্থ মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছয়তলা ভবনের ওপর। এতে অন্তত ২০ জন নিরীহ মানুষের মৃত্যু হয়, যাদের বেশিরভাগই শিশু শিক্ষার্থী ও শিক্ষক। আহত হন আরও অন্তত ১৭১ জন। নিহতদের ভবিষ্যৎ রচিত হওয়ার কথা ছিল পাঠশালার কালো বোর্ডে, অথচ তা মুছে দিল আকাশ থেকে ধেয়ে আসা আগুনে লেলিহান এক মৃত্যু। এ ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা নয়, বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যর্থতাÑপ্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পরিকল্পনা, রক্ষণাবেক্ষণ, ঝুঁকি বিশ্লেষণ এবং দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রে। এই দুর্ঘটনা একদিকে যেমন সামরিক আধুনিকায়নের ঘাটতি তুলে ধরে, অন্যদিকে নাগরিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও এক ভয়ঙ্কর দুর্বলতা প্রকাশ করে।

বিধ্বস্ত হওয়া বিমানটি ছিল এফটি সেভেন বিজিআই, যা মূলত সোভিয়েত মিগ-২১ যুদ্ধবিমানের ভিত্তিতে চীনের তৈরি একটি পুরনো প্রশিক্ষণ বিমান। বাংলাদেশ ২০১৩ সালে বিমানটি সংগ্রহ করলেও চীন সে বছরই এর উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। তার মানে, এখন এ বিমানের যন্ত্রাংশ বা সফটওয়্যার আপডেট পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এর রাডার, সেন্সর, অ্যাভিওনিক্সÑসবই আধুনিক যুদ্ধপ্রযুক্তির তুলনায় পিছিয়ে। তবুও এই বিমানকে এখনো প্রশিক্ষণ মিশনে ব্যবহার করা হয়, সেটিও রাজধানীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায়। এ সিদ্ধান্ত যে ভয়ানক ঝুঁকিপূর্ণ, তার চরম মূল্যই এবার দিতে হলো দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই প্রথম নয়। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে আগেও বহুবার প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। তবে সর্বশেষ উত্তরার মর্মান্তিক দুর্ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, আধুনিকায়নের নামে আমরা হয়তো নতুন যুদ্ধজাহাজ বা সমরাস্ত্র সংগ্রহ করছি, কিন্তু প্রশিক্ষণ খাত এখনো সেই পুরনো কাঠামোতেই আবদ্ধ। অথচ, একটি দক্ষ বিমানবাহিনী গঠনের প্রথম শর্তই হলোÑপাইলটদের আধুনিক, নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত প্রশিক্ষণ পরিবেশ নিশ্চিত করা। পুরনো বিমানে প্রযুক্তিগত ত্রুটি, যন্ত্রাংশের জটিলতা, কিংবা রক্ষণাবেক্ষণের সীমাবদ্ধতা পাইলট ও সাধারণ মানুষের জীবনকে যে কতটা হুমকির মুখে ফেলতে পারে, তা আবারও প্রমাণিত হলো।

এখানে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের প্রতি জোরালো প্রশ্ন তোলা প্রয়োজনÑ টানা সাড়ে ১৫ বছর একটি সরকার ক্ষমতায় থাকার পরও কেন বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণার্থী পাইলটদের এখনও ১২ বছর পুরনো, উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি যুদ্ধবিমান ব্যবহার করতে হচ্ছে? কেন জনবহুল এলাকায় প্রশিক্ষণ উড্ডয়ন অনুমোদিত? কেন রুটিন যান্ত্রিক পরিদর্শনে ত্রুটি ধরা পড়েনি? সবচেয়ে বড় প্রশ্নÑ এ দুর্ঘটনা কি প্রশাসনিক উদাসীনতা ও দায়মুক্তির সংস্কৃতির আরেকটি নিদর্শন নয়?

আমরা মনে করি, সময় এসেছে বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা নীতিতে একটি রূপান্তর আনার। এটি শুধু সামরিক শক্তির আধুনিকায়ন নয়, বরং প্রশিক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়। আধুনিক প্রশিক্ষণ বিমানের সংযোজন, পুরনো বিমানের পর্যায়ক্রমিক অবসান, প্রশিক্ষণের জন্য সিমুলেটর ও ড্রোন টেকনোলজির ব্যবহার, জনবহুল এলাকায় উড্ডয়ন নিষিদ্ধকরণ এবং পাইলটদের জন্য উচ্চমানের নিরাপত্তা প্রটোকল নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। যেসব দেশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিক করেছে, তারা সবার আগে গুরুত্ব দিয়েছে প্রশিক্ষণ নিরাপত্তা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায়। আমাদেরও সেই পথেই হাঁটতে হবে। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা যেন ইতিহাসে একটি বেদনাদায়ক অধ্যায় হয়, আর কখনো যেন তার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। শহীদ শিশুদের স্মরণে কেবলই শোক নয়, বরং চাই বাস্তব পদক্ষেপ।