বছর ঘুরে আবারও পবিত্র হজ্জের মওসুম আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে। ইতোমধ্যেই হজ্জ ফ্লাইটগুলোর যাত্রাও শুরু হয়েছে। সৌদি আরবের জেদ্দার উদ্দেশে ৩৯৮ জন যাত্রী নিয়ে চলতি বছরের প্রথম হজ্জ ফ্লাইট ঢাকা ত্যাগ করেছে ২৮ এপ্রিল দিনগত রাত ২.২০টায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমানটি জেদ্দার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। এর আগে, সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর আশকোনা হজ্জক্যাম্পে ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন হজ্জ ফ্লাইট উদ্বোধন করেছেন।

অত্যন্ত হৃদয়বিদারক হলেও সত্য, প্রতি বছরই হজ্জের সময়ে আমরা ভোগান্তির কিছু খবর দেখতে পাই। হাজী ক্যাম্পে হাজীদের চিৎকার ও মনভাঙা আহাজারিও আমাদেরকে অবলোকন করতে হয়। প্রতারক ও অদক্ষ কিছু ট্রাভেল এজেন্সির কারণে টাকাপয়সা দিয়েও প্রতিবছর বেশ কিছু দুর্ভাগা ব্যক্তিবর্গও থাকেন, যারা শেষ পর্যন্ত আর হজ্জে গমন করতেই পারেন না। চলতি বছরও কিছু হজ্জ এজেন্সির গাফিলতির কারণে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার হজ্জযাত্রীর হজ্জ পালনে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল। তবে ধর্মবিষয়ক উপদেষ্টার কঠোর হুঁশিয়ারির পর সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলো দ্রুত সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে এবং প্রায় সব হজ্জযাত্রীর ভিসাপ্রক্রিয়া শেষের দিকে পৌঁছে গেছে।

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ্জ অনুবিভাগ সূত্র নিশ্চিত করেছে, এ পর্যন্ত যারা নিবন্ধন করেছেন তাদের অধিকাংশেরই মক্কা-মদিনায় আবাসন, যাতায়াত এবং উড়োজাহাজের টিকিট নিশ্চিত করা হয়েছে। শুধুমাত্র ৯টি এজেন্সির কয়েকজন হজ্জযাত্রীর ভিসা প্রক্রিয়া এখনো সম্পন্ন হয়নি। আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, নিবন্ধিত ১০ হাজার ৪৮৭ জন হজ্জযাত্রীর মধ্যে মাত্র ৪৪ জনের ভিসা বাকি ছিল, যা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সম্পন্ন হবে। হজ্জ এজেন্সিস অব বাংলাদেশ (হাব)-এর কর্মকর্তারা স্বীকারও করেছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের তুলনায় বাংলাদেশ এবার হজ্জ ব্যবস্থাপনায় অনেক পরিপক্বতা দেখিয়েছে। বাড়িভাড়া, পরিবহন ব্যবস্থা এবং ভিসা প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে। দ্রুত সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হবে।

এবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অনেক মাস আগে থেকেই তৎপরতা দেখিয়েছেন- যা সত্যিই প্রশংসনীয়। যদিও কেন এমনটা সচরাচরই হয় না; তা সত্যিই বিস্ময়কর। কেননা হজ্জের মওসূম তো নির্দিষ্ট। এ সময়ে কী ধরনের জটিলতা বা সংকট তৈরি হতে পারে, পুরনো অভিজ্ঞতার কারণে তাও অনুমেয়। এরপরও বছরের পর বছর একই ধরনের ভুল হতে থাকবে- এমনটা মেনে নেওয়া যায় না। মূলত আমাদের সরকারগুলোর জবাবদিহিতা না করার মানসিকতা ও হজ্জের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়েও হজ্জ ব্যবসায়ীদের মুনাফা করার লোভের জেরেই এ সমস্যাগুলো বহাল তবিয়তে থেকে যাচ্ছে।

হজ¦ আর্থিক, শারীরিক ও মানসিকভাবে সামর্থ্যবান নারী-পুরুষের জন্য একটি ফরজ ইবাদত। এছাড়াও হজ্জের সঙ্গে বহু মানুষের আবেগ, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা মিশে আছে। বহু মানুষের মনের ইচ্ছা, কাফনের কাপড় পরার আগে তিনি যেন ইহরামের কাপড় পরতে পারেন। অনেকেই আছেন, যারা সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে একবার হজ্জ আদায় করতে চান। তাই অসুস্থ, বৃদ্ধ, পঙ্গু মানুষজন জমিজমা, ভিটেমাটি বিক্রি করে হলেও হাজার হাজার মাইল দূর থেকে আল্লাহর ঘর বাইতুল্লাহ দর্শনে ছুটে যান। এ কারণে মানুষের আবেগ ও সারা জীবনের সঞ্চয়ের এ আমলটিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে গোটা হজ্জ ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়াকে ঢেলে সাজাতে হবে।

জুলাই বিপ্লবের ওপর দাঁড়িয়ে বর্তমান সরকার নানাখাতে জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণ করার চেষ্টা করছে। নানা সেক্টরে সংস্কার সাধনের চেষ্টা করছে। আমরা আশা করবো, হজ্জ ব্যবস্থাপনা খাতেও তারা কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। বিশেষ করে হজ্জের খরচ, টিকেটের দাম, নিবন্ধন প্রক্রিয়া, সৌদি সরকারের সাথে মিলে যৌথ প্যাকেজ প্রণয়ন, যাতায়াত, বাড়িভাড়া, হারামের নিকটবর্তী হোটেল নির্বাচন, উন্নত বিমান এবং সর্বোপরি হজ্জ এজেন্সীগুলোর ওপর নজরদারি বৃদ্ধিসহ প্রাসঙ্গিক নানা বিষয়ে তারা সক্রিয় হবেন এমনটাই আমরা প্রত্যাশা করি। আগামী দিনগুলোতেও মানুষ এবারের চেয়ে আরো বেশি স্বাচ্ছন্দ্যে হজ্জে গমন করবে; হজ্জযাত্রা হবে স্বস্তির, নিরাপত্তার। এটিই আমরা কামনা করি।