মানুষ সমাজে বসবাস করে। প্রশ্ন জাগে, মানুষ সমাজবদ্ধ হলো কেন? খুন-খারাবি, চাঁদাবাজি, লুন্ঠন, সন্ত্রাস দেখার জন্য তো মানুষ সমাজবদ্ধ হয়নি। অন্তর্গত উপলব্ধিতে নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে মানুষ অবগত, এ অবগতিই মানুষকে সমাজবদ্ধ হতে উৎসাহিত করেছে। সমাজের মানুষ দরদী চেতনায় পরস্পরের সাহায্য-সহযোগিতায় উন্নত জীবন পাবে, সমাজ গঠনের পেছনে এমন একটি লক্ষ্য অবশ্যই ছিল। ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা এবং অন্যায়ের প্রতিরোধের দর্শনও ছিল। দর্শনের বাস্তবায়নে শিক্ষা-সংস্কৃতি, আইন-কানুন ও বিধি-বিধান প্রণয়নের কর্মকাণ্ডও আমরা লক্ষ্য করেছি। এতকিছুর পরও আজ সমাজের এমন অবস্থা কেন? এমন সমাজের জন্যই কি মানুষ সমাজবদ্ধ হয়েছিল? মানুষের স্বপ্নভঙ্গের কারণ কী? আমরা কি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছি? সমাজ বিনির্মাণের যে দর্শন, যে আইন-কানুন ও বিধিবিধান, তার প্রয়োগে কি আমরা ব্যর্থ হচ্ছি? বিগত ফ্যাসিবাদী আমলে তো আমরা মানুষের আকাক্সক্ষার দর্শনকে পালটে ফেলতে দেখেছি। সরকার, প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দলকে আমরা দেখেছি শিষ্টের দমন ও দুষ্টের পালনের নয়া বিধান চালু করতে। এর বিরুদ্ধেইতো ছাত্র-জনতার বিদ্রোহ এবং কাক্সিক্ষত জুলাই গণঅভ্যুত্থান।
গণঅভ্যুত্থান তো হলো, কিন্তু এখন কী হচ্ছে? সরকার, প্রশাসন এবং রাজনৈতিক দলগুলো গণঅভ্যুত্থানের চেতনা কতটা ধারণ করতে পারছে? সাধারণ মানুষের জন্যও আত্মসমালোচনার বিষয় আছে। গণঅভ্যুত্থানের এক বছরের মাথায় দেশের এ কেমন চিত্র? চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারের ঘটনা বাড়ছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘটছে সন্ত্রাস ও খুনাখুনির নৃশংসতা। ফলে ব্যবসায়ী ও জনমনে সৃষ্টি হয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। প্রশ্ন-কেন এমন হচ্ছে, কারা এর সাথে জড়িত? তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হচ্ছে মব। দখল ও চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে পুরানো ঢাকার মিটফোর্ডে ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে প্রকাশ্যে পাথরের আঘাতে নৃশংস হত্যার যে উদাহরণ সৃষ্টি করা হয়েছে তাতে আইয়ামে জাহেলিয়াতের কথা মনে পড়ে যায়। চারপাশে তো মানুষ ছিল। মানুষ মানুষের দায়িত্ব পালন করেনি। তখন আইন-শৃংখলা বাহিনী কোথায় ছিল? প্রশ্ন জাগে রাজনৈতিক দলের প্রতিও। এমন সন্ত্রাসীরা দলে জায়গা পায় কেমন করে? মন্দ কিছু লোক যদি দলে ঢুকেও যায়, তাদের সংশোধনের কোনো ব্যবস্থা দলে নেই কেন? নাকি এদের দিয়ে ভোটের রাজনীতিতে জেতার কোনো পরিকল্পনা আছে? আসলে রাজনৈতিক দর্শনে শুদ্ধি না আসলে, দলে নৈতিক মানদণ্ড না থাকলে, প্রচলিত রাজনীতি দেশ ও জনগণের কোনো কল্যাণে আসবে না। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরেও আমরা সে একই বার্তা পেলাম।
আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সরকার বিভিন্ন নির্দেশনা দিচ্ছে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে শক্ত হতে বলছে। পুলিশ ও র্যাবের পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনীও অপরাধ দমনে মাঠে তৎপর রয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনী প্রতিদিনই বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালাচ্ছে। অস্ত্র-শস্ত্রসহ সন্ত্রাসীরা গ্রেফতার হচ্ছে সেনাবাহিনীর হাতে। এরপরও পরিস্থিতির কাক্সিক্ষত উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এর কারণ রয়েছে। সন্ত্রাস প্রতিরোধে ও আইন-শৃঙ্খলার উন্নয়নে রাজনৈতিক দলগুলোরও দায়িত্ব রয়েছে। শুধু বিক্ষোভ ও কাথামালায় সেই দায়িত্ব পালিত হয় না। নিজেদের ভুল রাজনীতিরও সংশোধন প্রয়োজন। সরকারের তৎপরতা কি আরও বাস্তব ও কার্যকর হতে পারে না? জনগণতো দৃশ্যমান উদাহরণ চায়। নাগরিকদের গৃহেইতো ভালো ও মন্দ মানুষের বসবাস। যারা সন্ত্রাসী, যারা মন্দ, তাদের সংশোধনে পরিবারের অভিভাকেরা কি সঙ্গত দায়িত্ব পালন করছেন? তাদের উপার্জিত অর্থ সম্পর্কে কি কোনো প্রশ্ন করা হয়?