সম্পাদকীয়
ফিলিস্তিনিদের জাতিগত নিধন পরিকল্পনা সমর্থনযোগ্য নয়
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস জানিয়েছেন, গাজার জনসংখ্যাকে উচ্ছেদ করে অঞ্চলটি পুনর্গঠন করার ট্রাম্পের পরিকল্পনা “জাতিগত নিধনের শামিল”। নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদক ফারনাজ ফাসিহির বরাত দিয়ে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
Printed Edition
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, তিনি চান যে ফিস্তিনিরা প্রতিবেশী দেশগুলীতে স্থানান্তরিত হওয়ার পরে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণ করুক এবং অঞ্চলটি এমনভাবে উন্নয়ন করুক যাতে ওয়ার্ল্ডস পিপল বা “বিশ্বের মানুষ” সেখানে বসবাস করতে পারে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সাথে হোয়াইট হাউসে একটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করার পর ট্রাম্প তার এ পরিকল্পনার কথা জানান। সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প আরো বলেন, গাজাকে উন্নয়ন করে হাজার হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে, যা এক অসাধারণ জায়গায় পরিণত হবে। তবে তার পরিকল্পনা কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে সে বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো বিবরণ না দিয়ে ট্রাম্প আশা প্রকাশ করেন যে, গাজার বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা মানবিক হৃদয়ের অধিকারী দেশগুলোতে চলে যাবে। আর কিছু সংখ্যক ফিলিস্তিনি হয়তো গাজাতেও বসবাস করবে। ট্রাম্পের এ বক্তব্য প্রচারিত হওয়ার বিশ^জুড়ে প্রচন্ড প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস জানিয়েছেন, গাজার জনসংখ্যাকে উচ্ছেদ করে অঞ্চলটি পুনর্গঠন করার ট্রাম্পের পরিকল্পনা “জাতিগত নিধনের শামিল”। নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদক ফারনাজ ফাসিহির বরাত দিয়ে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এক্স-এ দেয়া এক পোস্টে জাতিসংঘ ব্যুরো প্রধান ফাসিহি আরও জানান, গুতেরেস সতর্ক করে বলেছেন যে, ট্রাম্পের পরিকল্পনা “একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সম্ভাবনাকে চিরতরে ধ্বংস করে দিতে পারে।” ইসরাইলের প্রতি বাইডেনের নগ্ন সমর্থনের অভিযোগ তুলে বাইডেন প্রশাসন থেকে পদত্যাগ করা তারিক হাবাশ এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ট্রাম্পের এ প্রস্তাব ফিলিস্তিনিদের গাজা থেকে বিতাড়িত করার লক্ষ্যে একটি জাতিগত নিধনের প্রকাশ্য অনুমোদন এবং আন্তর্জাতিক আইনের মারাত্মক লঙ্ঘন। অন্যদিকে, গাজার শাসকগোষ্ঠী হামাস ট্রাম্পের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তার পরিকল্পনা “এলাকাটিতে বিশৃঙ্খলা ও উত্তেজনা সৃষ্টির রেসিপি”। গাজা উপত্যকার আমাদের জনগণ এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে দেবে না বলেও জানায় হামাস।
এদিকে, গাজার সরকারী মিডিয়া অফিস সর্বশেষ হিসেবে জানিয়েছে, ইসরাইলের যুদ্ধের ফলে গাজায় ৬১,৭০০-এর বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। এর বাইরে হাজার হাজার মানুষ এখনো নিখোঁজ রয়েছে যাদেরকেও তারা মৃত হিসেবে ধরে নিয়েছেন। অথচ ভাগ্যের নির্মম পরিহাস হলো, গাজাকে যার আদেশে ধ্বংসস্তূপে আর মৃত্যুপরীতে পরিণত করা হলো, সে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো নেতানিয়াহুকে সাথে নিয়েই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার ফিলিস্তিনি জাতিনিধন পরিকল্পনা ঘোষণা করলেন।
গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করা ছিল ইসরাইলের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা। এমনটা করা হলে সমস্ত আন্তর্জাতিক নীতি ও আইনের লংঘন করা হবে। বিগত দেড় বছরের গাজা পরিস্থিতি ও ইসরাইলসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকায় এটি স্পষ্ট যে, ইসরাইল ও তার পশ্চিমা মিত্ররা আন্তর্জাতিক আইন ও নীতিগুলোকে গুরুত্ব দেয় না। অথচ এবারও ইসরাইলের পরিকল্পনা অনুযায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট তার আগামীদিনের মধ্যপ্রাচ্য পরিকল্পনা ঘোষণা করলেন। এ ঘোষণার আলোকে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক স্থানান্তর করা হলে আরব দেশগুলোর মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখে দেবে এবং পুরো অঞ্চলজুড়ে নতুন করে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে।
ঐতিহাসিক বাস্তবতা হলো, ইসরাইলীরা উড়ে এসে জুড়ে বসে ফিলিস্তিন দখল করেছে। যারা গাজায় স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের সবার পূর্বপুরুষদের আদিবাড়ি থেকে ইসরাইলীরা উচ্ছেদ করেছে। স্বাধীনতাকামী এ মানুষগুলোর জন্ম ও বড়ো হওয়া- সবই শরনার্থী শিবিরে। তারা এখন নিজেদের ভূখন্ডকে দখলদারিত্ব মুক্ত করার জন্য সংগ্রাম করছেন। অথচ তাদের মুক্তি সংগ্রামকে পশ্চিমা মিডিয়ায় সন্ত্রাস হিসেবে দেখানো হচ্ছে। আর দখলদার রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অজুহাতে নিপীড়িত মানুষগুলোর ওপর আরো বেশি জুলুম করা হচ্ছে। ট্রাম্পের সর্বশেষ ঘোষণা কার্যত ফিলিস্তিনিদের ওপর ভয়ংকর এক জুলুমের রূপরেখা। তাই এ পরিস্থিতির অবসান হওয়া দরকার। বিশ^মোড়লেরা বিবেকবান হয়ে উঠুক। একটি স্বাধীন, সার্বভৌম ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া মধ্যপ্রাচ্য সংকটের সুরাহা হবে না। বিশে^র শান্তিকামী দেশ, জনগণ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। বিশে^র আত্মসচেতন মানুষ সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা আশা করে।