অনেক বছর পর বাংলাদেশের মানুষ একটি প্রাণবন্ত; আনন্দঘন ও অংশগ্রহণমূলক ঈদ উদযাপন করার সুযোগ পেল এবার। সারাদেশে যেভাবে উৎসবমুখর পরিবেশে ঈদ উদযাপিত হয়েছে, এমনটা বহুদিন এ জাতি প্রত্যক্ষ করেনি। জেলায় জেলায় ঈদের জামায়াত হয়েছে। ঈদ মিছিল হয়েছে। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ঈদ র্যালি হয়েছে। সুলতানি আমলের ধারায় ঈদের সংস্কৃতি পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়াস ছিল। উৎসবের সূচনা হয়েছিল ঈদুল ফিতরের আগের রাত অর্থাৎ চাঁদ রাত থেকেই। সে রাতেই ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল। ভয়হীন, ভীতিহীনভাবে মানুষ তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে রাজপথে নেমে এসে ঈদকে স্বাগত জানিয়েছিল।
ঈদের আগে রোজাও তুলনামূলকভাবে স্বস্তিতে কাটিয়েছে মানুষ। আল্লাহর রহমতে এবারের রোজায় আবহাওয়া অনুকূলে ছিল। গরমের প্রকটতা ছিল না। শেষদিকে এসে গরম কিছুটা বাড়লেও বাকি মাস এক ধরনের সহজ পরিবেশ বিদ্যমান ছিল। জিনিসপত্রের দাম বিগত বছরগুলোর তুলনায় কম ছিল। রোজায় সবচেয়ে বেশি যে খাদ্যদ্রব্যগুলোর প্রয়োজন হয় বিশেষ করে পেঁয়াজ, মরিচ, চিড়া, ছোলা- এগুলোর দাম বিগত বছরগুলোর তুলনায় অনেকটাই কম ছিল। রোজার মাসে ৪০ টাকার কমে কেজিতে পেঁয়াজ খাওয়ার মতো স্মৃতি হয়তো অনেকের স্মরণেই নেই। ব্রয়লার মুরগি বা ডিমের দামও অস্বাভাবিকভাবে বাড়েনি।
এরপরও মানুষের কিছু ভোগান্তি হয়েছে তবে তা হয়েছে অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের কারণে। তারা বাজারে কৃত্রিমভাবে সংকট তৈরি করতে চেয়েছিল। বিশেষ করে সয়াবিন তেলের একটি সংকট ছিল। মাছ, গোশতের বাজারেও দাম খুব একটা কমেনি। সবচেয়ে বড়ো কথা, যে পণ্যগুলোর দাম কমেছে এর ফলশ্রুতিতে ইফতার বাজারে যে সুবাতাস পড়ার কথা ছিল, তাও লক্ষ্য করা যায় নি। অন্তর্বর্তী সরকার বাজার মনিটরিং-এর কাজ জোরদার করেছেন। আশা করছি, সামনের দিনগুলোতে মনিটরিং আরো বাড়বে আর তেমনটা হলে অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যও কমে আসবে।
সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, রাজনীতি মানুষের জীবনকে নানাভাবেই প্রভাবিত করে। তাই যদি রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যাপারে জনমনে আক্রোশ না থাকে এবং সরকারও যদি নিপীড়ক না হয়, তাহলে জনগণ যে কোনো উৎসবই যে খোলামনে উদযাপন করে, আওয়ামী লীগ মুক্ত নতুন বাংলাদেশ তাই যেন প্রমাণ করেছে। কেননা, আওয়ামী লীগের আমলে বহু মানুষ ঈদের ছুটিতেও নিজ এলাকায় যেতে পারেনি। গ্রামে ঈদ করার সুযোগ পায়নি। নিজের মৃত মা-বাবার কবর জিয়ারত করতে পারেনি। মামলা থাকায় এলাকায় যেতেই পারেননি। সেই চিত্র এবার নেই।
এবারের ঈদের আরেকটি উপভোগ্য বিষয় ছিল, সহজ ও নিরাপদ ঈদ যাত্রা। প্রচুর মানুষ তাদের গ্রামের বাড়িতে গিয়েছেন কিন্তু সড়ক পথে উল্লেখ করার মতো সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেনি। রেললাইনে গাড়ি চলেছে নির্বিঘেœ অনেক যাত্রী টেলিভিশনগুলোতে সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন এবারই প্রথম হয়েছে যে, তাদেরকে স্টেশনে এসে ট্রেনের অপেক্ষায় থাকতে হয়নি বরং ট্রেন আগে থেকেই স্টেশনে এসে বসেছিল। আবার সড়কপথেও ১৫ কিলোমিটার বা ১০ কিলোমিটার যানজটের মতো দুঃসহ অভিজ্ঞতাও মানুষকে সহ্য করতে হয়নি। আশা করি, অন্তর্বর্তী সরকার পরবর্তী ঈদুল আজহাতেও এই সফলতাগুলো ধরে রাখার চেষ্টা করবেন।
সবমিলিয়ে এবারের ঈদটি গণমানুষের জন্য ছিল ভয়হীন, দ্বিধাহীন, শংকাহীন। মানুষ তার সবটুকু উজাড় করে এবার ঈদ উদযাপন করেছে। রাষ্ট্র বা প্রশাসনের তরফ থেকে তাদেরকে কোনো ধরনের বাধার মুখে পড়তে হয়নি। বাংলাদেশে এই উন্মুক্ত পরিবেশটি অব্যাহত থাকুক, দেশের মানুষ সবসময়ই এমনটাই আনন্দ নিয়ে ঈদ উদযাপন করুক, দ্রব্যমূল্য মানুষের আরো নিয়ন্ত্রণে চলে আসুক, মানুষের দুর্ভোগ ও ভোগান্তি সহনীয় পর্যায়ে থাকুক- এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।