২০২০ সালে যখন বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস প্রথম ভয়াবহ রূপে আবির্ভূত হয়েছিল, তখনো কেউ ভাবতে পারেনি যে এটি এক দশকের প্রায় অর্ধেক জুড়ে মানবজীবনের গতিপথ পাল্টে দেবে। মৃত্যুর মিছিল, স্বাস্থ্যব্যবস্থার ধস, অর্থনৈতিক স্থবিরতা, সামাজিক দূরত্ব, ওষুধ এবং টিকার জন্য হাহাকার-সবকিছু মিলিয়ে এক ভয়াল অধ্যায় আমরা পেছনে ফেলে এসেছি। তবে এখনই আত্মতুষ্টির সময় নয়।

গত ৯ জুন, ২০২৫ তারিখে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একটি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ জারি করেছে, যেখানে পার্শ্ববর্তী ভারতসহ কয়েকটি দেশে করোনাভাইরাসের নতুন ধরনের সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সে দেশে ভ্রমণ না করার আহ্বান জানানো হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশে করোনার একাধিক সাব-ভেরিয়েন্ট-বিশেষ করে অমিক্রনের এলএফ.৭, এক্সএফজি, জেএন-১ ও এনবি ১.৮.১ দ্রুত সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারীদের মাধ্যমে এসব ধরন বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে ভারতসহ আক্রান্ত দেশগুলো থেকে আগত যাত্রীদের ক্ষেত্রে দেশের সব স্থল, নৌ ও বিমানবন্দরের আইএইচআর ডেস্কে নজরদারি জোরদার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নতুন ঝুঁকি মোকাবিলায় হেলথ স্ক্রিনিং বাড়ানোসহ বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরে অতিরিক্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে বলে জানানো হয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে।

স্বাস্থ্যবিষয়ক এই সতর্কতা শুধু সময়োপযোগী নয়, বরং এটি আমাদের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক স্বাস্থ্য-নিরাপত্তার স্বার্থেই একান্ত প্রয়োজনীয়। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রকোপ যখন অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছিল বলে অনেকে ভেবেছিলেন, তখনই আবার নতুন ধরন বা ভ্যারিয়েন্টের আবির্ভাব আমাদের সতর্ক করে দিল-এ ভাইরাস এখনো সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রিত নয়। অতীতে যেমন আমরা ডেলটা বা ওমিক্রনের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছি, তেমনি নতুন প্রজাতির ভাইরাসও ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে, বিশেষ করে যদি আমরা সচেতন না হই এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় অবহেলা করি।

এ প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরামর্শ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। ভারতে সংক্রমণ বৃদ্ধির বিষয়টি উদ্বেগজনক, কারণ বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে এবং দু’দেশের মধ্যে যাতায়াত অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ফলে ভারতে করোনা সংক্রমণ বাড়লে বাংলাদেশের ঝুঁকিও অস্বীকার করার মতো নয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এ বিজ্ঞপ্তি প্রমাণ করে যে করোনাভাইরাসের বিপদ এখনো অতিক্রান্ত হয়নি, বরং এর রূপ পাল্টে নতুনভাবে আমাদের সামনে হাজির হওয়ার শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

জনসাধারণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখনো ভ্রমণ, ব্যবসা বা চিকিৎসাজনিত প্রয়োজনে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করে থাকে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে সেসব দেশে ভ্রমণ করার আগে প্রয়োজনীয় ঝুঁকিবিশ্লেষণ ও স্বাস্থ্য পরামর্শ নেওয়া উচিত। শুধু সরকারি নির্দেশনা মানলেই যথেষ্ট নয়, নাগরিকদের নিজেদের মধ্যেও সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। প্রয়োজন ছাড়া বিদেশ ভ্রমণ না করাই এখন সবচেয়ে নিরাপদ পথ। এছাড়া দেশের বিমানবন্দর, স্থলবন্দর ও সীমান্ত পয়েন্টগুলোতে নজরদারি জোরদার করার বিষয়টিও এখন জরুরি। বিদেশফেরত যাত্রীদের স্ক্রিনিং, স্বাস্থ্যপরীক্ষা এবং প্রয়োজনে কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, সীমান্ত দিয়ে ভাইরাসের অনুপ্রবেশ ঠেকানো না গেলে পরিস্থিতি দ্রুতই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

জনগণের মধ্যে অনেকেই ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে থাকেন যে, করোনাভাইরাস এখন আর তেমন ভয়াবহ নয়। কিন্তু নতুন ধরনগুলো সম্পর্কে এখনো বৈজ্ঞানিকভাবে পূর্ণাঙ্গ ধারণা পাওয়া যায়নি। কিছু ভ্যারিয়েন্ট হতে পারে অধিক সংক্রামক, আবার কিছু হতে পারে টিকানিরোধী বা ভ্যাকসিনের প্রভাব কমিয়ে দেওয়ার সক্ষমতা সম্পন্ন। তবে এগুলো যে প্রাণঘাতী এবং বড়ো ধরনের ঝুঁকি যে রয়ে গেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ বাস্তবতায় সরকার, প্রশাসনের সকল সেক্টর এবং সর্বজনসাধারণের সতর্ক হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।