অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি সচিবালয়ে সাংবাদিকের সঙ্গে আলাপকালে বলেছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের পর দেশে চাঁদাবাজি বেড়েছে। আগে যেখানে এক টাকা চাঁদা নেয়া হতো এখন সেখানে দেড় টাকা থেকে ২ টাকা চাঁদা নেয়া হচ্ছে। নানা পক্ষ চাঁদাবাজিতে জড়িত রয়েছে। আগে যারা চাঁদাবাজি করতো তারও নেপথ্যে থেকে চাঁদাবাজি করছে। ব্যাপকভিত্তিক চাঁদাবাজির কারণে দ্রব্য মূল্য বাড়ছে। রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় না এলে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। বর্তমানে দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। গত আগস্টে তা কিছুটা কমে ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশে নেমে এসেছে। আগামী জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে নেমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। অর্থ উপদেষ্টা কিছু বাস্তব কথা বলেছেন। তার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতির মূল কারণ প্রতিভাত হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সাফল্য প্রদর্শন করলেও বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। যেমন, এক পর্যায়ে শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি ৭৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল।

এখন তা ১ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। শ্রীলঙ্কা এ বছর ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশা করছে। দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পলিসি রেট বৃদ্ধির পাশাপাশি অন্যান্য কিছু ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে উচ্চ মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। চীনের মূল্যস্ফীতির হার গত আগষ্ট মাসে ছিল শুন্য দশমিক ৪১ শতাংশ। গত জুলাই মাসে অন্যান্য দেশের মধ্যে হংকংয়ের ১ দশমিক ১ শতাংশ, ভারতের ২দশমিক ০৭ শতাংশ,জাপানের ২দশমিক ৭শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার ২ দশমিক ৩ শতাংশ, ভুটানের ৩দশমিক ৬৪ শতাংশ,মালদ্বীপের ৪শতাংশ, ভিয়েতনাম ৩ দশমিক ২৪ শতাংশ, নেপালের ১ দশমিক ৬৮ শতাংশ,দক্ষিণ কোরিয়ার ১ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ফিলিপাইনের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশে গত আগষ্ট মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮দশমিক ৫৫ শতাংশ। তার অর্থ হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সকল দেশই তাদের অর্থনীতিতে সৃষ্ট উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে সক্ষম হলেও আমরা এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছি। আমরা উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমাতে পারছি না।

বিগত সরকার আমলে বাংলাদেশ ব্যাংক বারবার পলিসি রেট বৃদ্ধি করলেও ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হার ৯শতাংশে ফিক্সড করে রাখে। ফলে পলিসি রেট বৃদ্ধির মাধ্যমে বাজারে মুদ্রার যোগান কমানোর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মজুরি বৃদ্ধি না পাবার কারণে সাধারণ মানুষ বড়ই বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছি। যারা সম্পদের মালিক বা ধারক তারা মূল্য বৃদ্ধি করে পুষিয়ে নিতে পারছে কিন্তু যারা ভোক্তা তারা কোনভাবেই তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে পারছেন না। অর্থ উপদেষ্টা প্রকারান্তরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা শিকার করেছেন। তিনি বলেছেন, চাঁদাবাজির কারণে পণ্য মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, এটা থামানো তার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নয়। তাহলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দায় কার? এধরনের কথা বলে মূল্যস্ফীতির দায় এড়ানো যাবে না। এই মুহূর্তে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সরকার যে কোন অর্জন ব্যর্থ করে দেবার জন্য উচ্চ মূল্যস্ফীতি একাই যথেষ্ট। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অধিকাংশ দেশ সফল হলেও আমরা কেন ব্যর্থ হচ্ছি তার কারণ অনুসন্ধান করে দেখা দরকার। বাজার ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে পরিচালিত না হওয়া এবং পণ্য পরিবহনকালে ব্যাপক চাঁদাবাজি উচ্চ মূল্যস্ফীতির অন্যতম প্রধান কারণ।

অর্থনীতির সাধারণ সূত্র প্রয়োগ করে আমাদের দেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, রাজনৈতিক সরকার ছাড়া চাঁদাবাজি বন্ধ করা যাবে না। অর্থাৎ রাজনৈতিক সরকারের উপস্থিতি ব্যতীত মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে আসবে না। তার এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করা সুযোগ রয়েছে। আমাদের দেশে যে চাঁদাবাজি-সন্ত্রাস-নৈরাজ্য সৃষ্টি হয় তার মূলে রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রচ্ছন্ন ইন্দন। কাজেই রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হবার পর চাঁদাবাজি না কমে বরং আরো বৃদ্ধি পাবার আশঙ্কা রয়েছে। আমাদের দেশের এক শ্রেণির ব্যবসায়ি নীতি নৈতিকতার বাইরে গিয়ে শুধু মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যেই ব্যবসায়-বাণিজ্য করে থাকেন। তাদের নিকট অর্থই সকল সুখের মূল। চাঁদাবাজদের কঠোর হস্তে দমন এবং ব্যবসায়িদের মাঝে নৈতিকতা বোধ জাগ্রত করা না গেলে পণ্য মূল্য স্বাভাবিক অবস্থায় আসবে না। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে সাধারণ মানুষের মনে স্বস্তির ভাব সৃষ্টি করা না গেলে সরকারের যে কোন অর্জন ব্যর্থ হতে বাধ্য।