গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে ভিন্ন এক আবহে ও ভিন্ন পরিবেশে গতকাল পালিত হয়েছে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস তথা মে দিবস। ভিন্ন আবহ এ কারণে যে, বিগত বছরগুলোতে আওয়ামী স্বৈরশাসনে ও সরকারের নিবর্তনমূলক ব্যবস্থার কারণে শ্রমিকরা ছিল নিগৃহীত। তাদের দাবি দাওয়া পেশ করার সুযোগও ছিল না। মে দিবস পালনকালে সমাবেশ বিক্ষোভ ও নির্বিঘ্নে করা যায়নি। এবছর বিপুল উৎসাহে দিনটি পালিত হয়েছে। শুধু রাজধানীতেই হয়েছে বড় বড় কয়েকটি শ্রমিক সমাবেশ। এসব সমাবেশে শ্রমিকস্বার্থকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার আহ্বান উচ্চকিত হয়েছে। সে সাথে শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি পরিশোধ ও নানা বিষয় উঠে এসেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কথাতেও পাই তারই প্রতিধ্বনি। তিনি শ্রমিকদের আগের অবস্থায় রেখে নতুন বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয় বলে মত প্রকাশ করে মে দিবসের চেতনার সাথে কণ্ঠ মিলিয়েছেন।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, শ্রমিকদের আগের অবস্থায় রেখে নতুন বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়। এজন্য তিনি শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবসমূহ বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। গত বৃহস্পতিবার মহান মে দিবস এবং জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি দিবস-২০২৫ উপলক্ষে রাজধানীর বাংলাদেশ চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের প্রথম কাজ হলো শ্রম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী আশু করণীয় নিয়ে যাত্রা শুরু করা। এরপর পর্যায়ক্রমে প্রতিটি সুপারিশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে।’ “শ্রমিক মালিক এক হয়ে গড়বো এ দেশ নতুন করে”-এ স্লোগানকে সামনে রেখে এবারের মে দিবস উদযাপিত হচ্ছে। অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা ৫ জন শ্রমিকের পরিবারের হাতে শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহায়তার চেক তুলে দেন।
আমরা মনে করি প্রধান উপদেষ্টার কথাতে যে বিষয়টি উঠে এসছে তা বাস্তবায়ন হওয়া জরুরী। শ্রম সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক, কৃষি, গৃহভিত্তিক, অভিবাসী, স্বনিয়োজিত শ্রমিকসহ সব শ্রমিকের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক শ্রম আইনের সুরক্ষা নিশ্চিত করা, দেশের সব শ্রমিকের জন্য একটি সর্বজনীন জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ, মজুরি তিন বছর পরপর পুনর্নিধারণ, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মজুরি না দিলে শ্রমিককে ক্ষতিপূরণ, মূল্যস্ফীতির ভিত্তিতে বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধি, আপৎকালীন তহবিল, নির্দিষ্ট মানদণ্ডের ভিত্তিতে ক্ষতিপূরণ প্রদান, ট্রেড ইউনিয়ন করার শর্ত শিথিল, স্থায়ী কাজের জন্য আউটসোর্সিং নিয়োগ বন্ধ, নারী শ্রমিকের মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস, স্থায়ী শ্রম কমিশন প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবসমূহ বাস্তবায়নের যে আশ্বাস তিনি দিয়েছেন তা বাস্তবায়িত হবে বলে আমরা বিশ্বাস করতে চাই। সেটা করা হলেই মে দিবস পালন সার্থক হবে। শ্রমিকের মুখে হাসি ফুটবে।
গতকাল বিভিন্ন সমাবেশ থেকে রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দও শ্রমিক স্বার্থ রক্ষার দাবি জানিয়েছেন। শ্রমিকদের অধিকারের কথা উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, যুগের পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু শ্রমিকের প্রয়োজন কমেনি। বারবার সরকার এসেছে কিন্তু শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা কেউই দিতে পারেনি। দেশে সবচেয়ে বঞ্চিত খেটে খাওয়া মানুষ। ১ মে বিকেলে নয়াপল্টনে মে দিবস উপলক্ষে আয়োজিত শ্রমিক সমাবেশে তিনি এ কথা বলেন।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, শ্রমিক মালিকের সম্পর্ক হবে ভ্রাতৃত্বের শক্রর নয়। এটাই ইসলামের নির্দেশনা। শ্রমিক তাঁর ন্যায্য অধিকার না পেলে শিল্প এগিয়ে যাবে না বরং শ্রমিকরা কাজ না করলে শিল্প পিছিয়ে পড়বে। শ্রমিকরা বাঁচলে শিল্প বাঁচবে আর শিল্প বাঁচলে শ্রমিকেরা বাঁচবে এ কথা মালিক ও শ্রমিক উভয় পক্ষকে অনুধাবন করতে হবে। রাজধানীর পল্টন মোড়ে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের উদ্যোগে আয়োজিত বিশাল শ্রমিক সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। ডা. শফিকুর রহমান বলেন, বর্তমানে মালিক শ্রমিকের মাঝে কৃত্রিম সংকট ও সমস্যা সৃষ্টি করে একদল মানুষ ফায়দা লুটছে। আমরা শ্রমিক-মালিকের মাঝে সকল প্রকার দ্বন্দ্বের অবসান চাই। অন্যান্য কয়েকটি সমাবেশ থেকেও নেতৃবৃন্দ অনুরূপ কথাই বলেছেন। আমরা মনে করি শিল্প মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রেখে বিষয়গুলো দেখভাল করা গেলে মে দিবসের চেতনা বাস্তবায়িত হবে।