আওয়ামী ফ্যাসিবাদী আমলে যে কয়েকটি বড়ো ধরনের হত্যাকাণ্ড ও ক্র্যাকডাউনের ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিল শাপলা চত্বরসহ আশপাশের এলাকায় হেফাজতে ইসলাম ও সমমনা ইসলামী দলগুলোর নেতাকর্মীদের ওপর পরিচালিত হত্যাকাণ্ড অন্যতম। এ ঘটনা নিয়ে শুরু থেকেই ধোঁয়াশা তৈরি করেছিল বিগত সরকার। এ ঘটনায় আদৌ কেউ মারা গেছে-এ তথ্য স্বীকারই করতে চায়নি তারা। মানবাধিকার সংগঠন অধিকার এ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করায় এ সংস্থা এবং এর কর্ণধার এবং বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা এডভোকেট আদিলুর রহমান খানকেও হয়রানি করেছিল আওয়ামী সরকার।
প্রকৃতপক্ষে ২০১৩ সালের ৫ মে রাতে ঢাকার মতিঝিল শাপলা চত্বরে যা ঘটেছিল, তা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক বেদনাবিধুর ও বিতর্কিত অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। হেফাজতে ইসলাম আয়োজিত এক মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে ওই রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান পরিচালিত হয়। অভিযানের ধরন, সময়কাল এবং ফলাফল নিয়ে এখনও জাতির মধ্যে বহু প্রশ্ন রয়ে গেছে-যার অধিকাংশের উত্তর আজও অজানা। দীর্ঘদিন পরও এ ঘটনায় নিহত, আহত ও নিখোঁজদের প্রকৃত সংখ্যা ও পরিচয় নিয়ে স্পষ্টতা নেই। হতাহতের সংখ্যা নিয়ে সরকার, মানবাধিকার সংগঠন ও হেফাজতের দেওয়া পরিসংখ্যানে বিরাট অমিল রয়েছে। এ অবস্থায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত ছাড়া এ মর্মান্তিক ও নৃশংস ঘটনার নেপথ্যের প্রকৃত সত্য উন্মোচন করা সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের সংবিধান সকল নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা ও মানবাধিকার রক্ষার নিশ্চয়তা দিয়েছে। কোনো প্রকার বিচারবহির্ভূত হত্যা বা বলপ্রয়োগ কখনোই আইনের চোখে বৈধ হতে পারে না। কিন্তু শাপলা চত্বরে যা ঘটেছিল, তা মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হিসেবে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পর্যবেক্ষক ও মানবাধিকার সংগঠন তুলে ধরেছে। এ হত্যাকাণ্ডের পর ১২ বছর অতিবাহিত হলো। এখনো পর্যন্ত ঘটনার তদন্তে কোনো নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠিত হয়নি, বরং এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে এক ধরনের নীরবতা ও গড়িমসি লক্ষ্য করা গেছে-যা এক ধরনের দায় এড়ানোর কৌশল বলে মনে হয়। বিশেষ করে আওয়ামী সরকার এবং তাদের দোসরেরা এ ঘটনাটিকে কল্পনাপ্রসূত হিসেবেও রং দেয়ার চেষ্টা করেছে।
সম্প্রতি হেফাজতে ইসলাম ৯৩ জন নিহতের একটি প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করেছে এবং তদন্ত ও বিচার দাবি করেছে। একইভাবে মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ তাদের নিজস্ব গবেষণায় অন্তত ৬১ জন নিহতের তথ্য উপস্থাপন করেছে। এতোসব পরিসংখ্যান, গণমাধ্যম প্রতিবেদন ও ভিডিও প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও সরকারিভাবে কোনো বিচারপ্রক্রিয়া দৃশ্যমান নয়। এ পরিস্থিতি গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের প্রতি রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। শাপলা চত্বরের ঘটনা শুধু রাজনৈতিক নয়, এটি মানবিক ও নৈতিক একটি ইস্যু। এখানে নিহতদের পরিচয়, রাজনৈতিক অবস্থান কিংবা মতাদর্শের চেয়ে বড় বিষয় হলোÑতাদের ‘মানবিক পরিচয়’। প্রতিটি প্রাণের মূল্য আছে এবং রাষ্ট্রের উচিত সে মূল্যকে স্বীকৃতি দেওয়া। অথচ আমাদের নীতি নির্ধারকদের কিংবা মিডিয়ায় টকশোতে কিছু বুদ্ধিজীবীর কথা শুনলে মনে হয়, ঘটনার ভিকটিম মাদ্রাসার ছাত্র হওয়ায় তাদের এ ঘটনার সত্য উদঘাটনে খুব একটা আগ্রহই নেই। কিন্তু শাপলা হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া জরুরি। কেননা এ হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে যদি প্রকৃত সত্য বেরিয়ে না আসে, তাহলে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধ করা অসম্ভব হয়ে উঠবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি সমাজে সহিংসতার সংস্কৃতিকে উৎসাহ দেয়।
এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়িত্ব দু’টি। প্রথমত, একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করে ঘটনার পূর্ণাঙ্গ অনুসন্ধান চালানো। দ্বিতীয়ত, বিচারবিভাগের মাধ্যমে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করা। সেসঙ্গে যারা নির্দোষ হয়েও হয়রানি বা গ্রেপ্তারের শিকার হয়েছেন, তাদের হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা। আওয়ামী লীগ সরকার নিজেই যেহেতু এ হত্যাকাণ্ড পরিচালনার দায়ে অভিযুক্ত; তাই তারা এর বিচার করবে না- এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু বর্তমানে জুলাই বিপ্লব পরবর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করছেন। ফ্যাসিবাদী আমলের সব অন্যায়ের প্রতিকার ও বিচার করার একটি দায় তাদের আছে। তাই আমরা আশা করবো, কালবিলম্ব না করে শাপলা হত্যাকাণ্ডের মতো একটি বর্বর ঘটনার তদন্ত ও বিচারের কাজ তারা জলদিই শুরু করবেন এবং জাতিকে বিচার না করার দায় থেকে মুক্ত করে দিয়ে যাবেন।