আমাদের জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হচ্ছে রেমিট্যান্স। কিন্তু বিগত সরকারের আমলে আমাদের দেশের রেমিট্যান্স আহরণে তেমন ধারাবাহিকতা ছিলো না। উত্থান-পতন ছিলো একেবারে নিত্যদিনের। কারণ, তদানীন্তন সরকার বৈদেশিক শ্রমবাজার স্থিতিশীল রাখতে বা নতুন নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধান করতে খুব একটা সাফল্য দেখাতে পারেনি। এমনকি বিগত সরকারের ভ্রান্তনীতি ও একদেশ দর্শিতার কারণেই আমাদের বৈদেশিক শ্রমবাজারে বড় ধরনের ধস নেমেছিল। মূলত, অপশাসন-দুঃশাসনে দেশ প্রায় বন্ধুহীন হয়ে পড়ার কারণে নানা ক্ষেত্রেই সৃষ্টি হয়েছিলো জটিলতা ও অস্থিরতা। ফলে আমাদের জাতীয় অর্থনীতি হয়ে পড়েছিলো অনেকটাই বিপর্যস্ত। ছন্দপতন ঘটেছিলো রেমিট্যান্স প্রবাহে। মূলত, তদানীন্তন সরকার জাতীয় উন্নয়নের কথা চিন্তা করে এমন কিছু করেছে যার সাথে জাতীয় স্বার্থের কোন সম্পর্কই ছিলো না। আর এর বড় ধাক্কা লেগেছিলো জাতীয় অর্থনীতিতে।

মূলত, গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লবের মাধ্যমে আওয়ামী ফ্যাসীবাদীদের লজ্জাজনক পতনের পর জাতীয় অর্থনীতির স্থবিরতা অনেকটা কাটতে শুরু করেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন অনেকটাই সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। অর্থনীতিতে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে এেেসছে। রেমিট্যান্স প্রবাহেও ছন্দ ফিরেছে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একমাসে রেমিট্যান্স আসার পরিমাণ তিন বিলিয়ন (৩০০ কোটি) ডলার ছাড়িয়ে গেছে। গত মার্চ মাসে বৈধপথে ব্যাংকিং চ্যানেলে ৩২৯ কোটি ডলার রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় এসেছে বাংলাদেশে। দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি। একক কোনো মাসে এত পরিমাণ রেমিট্যান্স এর আগে কখনো আসেনি বাংলাদেশে। এর আগে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে প্রবাসীদের পাঠানো ২৬৪ কোটি ডলার ছিল একক কোনো মাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স। তারও আগে ২০২০ সালের জুলাই মাসে ২৬০ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল। রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। যা আমাদের জাতীয় অর্থনীতির জন্য সুখবর বলেই মনে করা হচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, অর্থ পাচার রোধে বর্তমান সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। ফলে হুন্ডি-সহ বিভিন্ন অবৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠানো কমে গেছে, বৈধপথে রেমিট্যান্স আহরণ বেড়েছে। এ ছাড়া আমাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে পরিবার পরিজনের বাড়তি খরচের কথা মাথায় রেখে বেশি বেশি অর্থ পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। ফলে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স পেয়েছে বাংলাদেশ। যা অর্থনীতিতে নতুন আশাবাদের সৃষ্টি করেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ মাসে দৈনিক গড়ে রেমিট্যান্স এসেছে ১০ কোটি ৬১ লাখ ডলার। গত বছরের মার্চে দৈনিক গড়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ৬ কোটি ৪৪ লাখ ডলার। সে হিসাবে গত মার্চ মাসে তার আগের বছরের মার্চের তুলনায় রেমিট্যান্সে ৬৪.৭০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ২০২৪ সালের মার্চে রেমিট্যান্স এসেছিল প্রায় ২০০ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে ৩১শে মার্চ পর্যন্ত প্রবাসীরা মোট ২ হাজার ১৭৮ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৭.৬০ শতাংশ বেশি। আগের অর্থবছরে একই সময়ে রেমিট্যান্স এসেছিল এক হাজার ৭০৮ কোটি মার্কিন ডলার।

উল্লেখ্য, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ ৭০ হাজার ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, আগস্টে এসেছে ২২২ কোটি ১৩ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার, সেপ্টেম্বরে ২৪০ কোটি ৪১ লাখ, অক্টোবরে ২৩৯ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার, নবেম্বর মাসে ২২০ কোটি ডলার, ডিসেম্বরে এসেছে ২৬৪ কোটি ডলার। এরপর জানুয়ারিতে ২১৯ কোটি, ফেব্রুয়ারি মাসে ২৫২ কোটি ৮০ লাখ ডলার এবং মার্চে ৩২৯ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। অর্থাৎ বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর টানা ৭ মাস দু’ বিলিয়ন এবং মার্চে তিন বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছে বাংলাদেশে। যা জাতীয় অর্থনীতির জন্য সত্যিই স্বস্তিদায়ক।

অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যকর ও সময়োচিত পদক্ষেপের কারণে জাতীয় অর্থনীতিতে নতুন করে আশাবাদের সৃষ্টি হয়েছে। গতি ফিরছে রেমিট্যান্স প্রবাহে। কিন্তু এতে আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোন সুযোগ নেই বরং এর ধারাবাহিকতা রক্ষায় এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তাই জাতীয় অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বর্তমান সরকারকে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি রেমিট্যান্স প্রবাহের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য বৈদেশিক শ্রমবাজারে স্থিতিশীলতা সহ নতুন নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধান করা দরকার। যাতে আগামী জাতীয় অর্থনীতি আরো সমৃদ্ধ ও মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। আর এ জন্য অর্থপাচার রোধে শূণ্য সহনশীলতা দেখাতে হবে। অন্যথায় আমাদের কোন অর্জনই স্থায়ি হবে না।