জাতির জীবনে কিছু মুহূর্ত থাকে যা ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ৫ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছেন, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার এক নতুন সূচনার ঘোষণা। দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ভোটাধিকার বঞ্চিত নাগরিক সমাজ অবশেষে সামনে দেখতে পাচ্ছে একটি সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আশ্বাস।
প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা দিয়েছেন, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনের প্রতি আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানানো হবে। তার এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক বার্তা উঠে এসেছে-বাংলাদেশ এবার সত্যিকার অর্থে জনগণের ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পালাবদলের পথে এগোচ্ছে।
ভাষণে যেমন উঠে এসেছে নির্বাচন আয়োজনের রূপরেখা, তেমনি উঠে এসেছে এর অন্তর্নিহিত মানবিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক দিকগুলো। ভোটকে তিনি কেবল একটি নাগরিক অধিকার নয়, বরং জাতির সার্বিক আত্মপরিচয়ের এক গভীর উৎসব হিসেবে দেখেছেন। বিশেষত নারী ও প্রবাসী ভোটারদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার অঙ্গীকার এক নতুন রাজনীতির সূচনা নির্দেশ করে, যেখানে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের মৌল ভিত্তিগুলো আবার দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে একটি উৎসবমুখর গণতান্ত্রিক চর্চা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি বলেছেন, “নির্বাচনের দিনটি আমরা ঈদের মতো করে তুলতে চাই”-এ বক্তব্য কেবল প্রতীকী নয়, বরং ভোটাধিকারকে কেন্দ্র করে একটি জাতীয় ঐক্য ও আত্মিক সংহতির বার্তা। ভোটকে কেন্দ্র করে পরিবার, সমাজ ও প্রজন্মকে একত্র করার যে চিত্র তিনি এঁকেছেন, তাতে স্পষ্ট যে এবারের নির্বাচন কেবল সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নয়, বরং একটি জাতীয় নবজাগরণের উপলক্ষ। যেসব মানুষ জীবনে কখনো ভোট দিতে পারেননি, তাদের সে “বকেয়া আনন্দ” এবার ফিরে আসবে-এমন প্রত্যয় যুগপৎভাবে আবেগময় ও ঐতিহাসিক।
এ নির্বাচন যেন শুধু একটি ভোট গ্রহণের প্রক্রিয়াই না হয়, বরং একটি জাতীয় উপলব্ধির পরিণত পরিস্ফুটন হোক, সেটিই হওয়া উচিত আমাদের সম্মিলিত লক্ষ্য। নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা যে বলেছেন, “ভোট দেয়ার আগ মুহূর্তে যেন শহীদদের চেহারা চোখে ভেসে ওঠে”Ñতাতে আছে ত্যাগের ইতিহাস স্মরণের পাশাপাশি ভবিষ্যতের দায়িত্ব গ্রহণের তাগিদ।
আমরা মনে করি, এ ভাষণ ছিল একান্ত প্রয়োজনীয়, সময়োচিত এবং সাহসী। এতে যেমন ভবিষ্যতের রূপরেখা রয়েছে, তেমনি অতীতের ব্যর্থতার স্বীকারোক্তিও রয়েছে পরোক্ষভাবে। এবার রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব হবে-এ ঐতিহাসিক সুযোগকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করে একটি অংশগ্রহণমূলক, প্রতিযোগিতামূলক এবং সহনশীল নির্বাচন নিশ্চিত করা। নতুন বাংলাদেশ গড়ার এ যাত্রায় সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম এবং সর্বোপরি সচেতন নাগরিক সমাজÑসবাইকে নিয়ে গড়ে তুলতে হবে সেই পরিবেশ, যেখানে ভোটার নিরাপদে, স্বাধীনভাবে ও উৎসাহ নিয়ে ভোট দিতে পারবেন। আমরা আশা করি, এই নির্বাচনী অভিযাত্রা জাতিকে একটি দীর্ঘ প্রতীক্ষিত পরিবর্তনের পথে এগিয়ে নেবেÑযেখানে মানুষ আবার বিশ্বাস করতে শিখবে যে, ভোটেই বদলায় দেশ।