হজ্জ মুসলমানদের এক অনন্য ইবাদাত। হজ্জ নিয়ে অনেক কথা, হজ্জের সফর নিয়ে অনেক কাহিনী আছে। রচিত হয়েছে বহু গ্রন্থও। হজ্জের সফর এখন অনেক সহজ হয়েছে। ফলে দেশে দেশে হাজীর সংখ্যাও বেড়েই চলেছে। তবে আগে হজ্জের সফর বেশ কঠিন ছিল। তাই অনেকেই পরিবার-পরিজন থেকে শেষ বিদায় নিয়ে যেতেন। বাংলাদেশের সমাজ পরিবেশে তখন হজ্জের বিষয়টা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, কেউ হজ্জ শেষ করে বাড়ি ফিরলে বাড়ির নামটাই পরিবর্তিত হয়ে যেত। আগের নামের পরিবর্তে মানুষ তখন ওই বাড়িটিকে ‘হাজিবাড়ি’ বলেই ডাকা শুরু করে দিতো। সামনেই তো হজ্জ। সে হজ্জকে কেন্দ্র করে এবার স্পেনে লক্ষ্য করা গেল ঐতিহ্যের পুনর্জন্ম। হজ্জ করতে ঘোড়ায় চড়ে স্পেন থেকে সৌদি আরব গেছেন তিন বন্ধু। এর মাধ্যমে স্পেন থেকে হজ্জ যাত্রার পুরোনো এক পথের পুনর্জন্ম দিয়েছেন তারা। প্রায় ৫০০ বছর আগে যে পথ দিয়ে স্পেনের ঐতিহাসিক আন্দালুসিয়ার মুসলমানরা হজ্জে যেতেন, সে পথ দিয়েই এবার হজ্জে গেলেন তিন বন্ধু। সে সময়টাকে হৃদয়ে ধারণ করে দীর্ঘপথ তারা পাড়ি দিয়েছেন। চলতি মাসের শুরুতে সৌদি আরবের উত্তর সীমান্ত প্রদেশ দিয়ে দেশটিতে প্রবেশ করেছেন তারা। এর আগে ঘোড়ায় চড়ে তারা স্পেন থেকে ফ্রান্স, ইতালি, স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া, সার্বিয়া, মন্টিনিগ্রো, কসোভো, উত্তর মেসেডোনিয়া, বুলগেরিয়া, গ্রিস, তুরস্ক, সিরিয়া ও জর্ডান হয়ে আট হাজার কিলোমিটার দূরত্বের পথ পাড়ি দেন।
৩৫ বছর আগে ইসলাম গ্রহণের পর স্পেনীয় তিন বন্ধু আবদুল কাদের হারকাসি, আব্দুল্লাহ হার্নান্দেজ ও তারিক রদ্রিগেজ এবার হজ্জ যাত্রার মাধ্যমে তাদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ করেন। যাত্রাপথে তাদের সঙ্গী হন স্পেনে বসবাসকারী বুশাইব জাদিল নামের একজন নির্মাণ ব্যবসায়ী। তিনি গাড়িতে করে দলটির জন্য লজিস্টিক্যাল সহায়তা দিয়েছেন। তারা ২০২৪ সালের অক্টোবরে স্পেনের দক্ষিণে আল-মনাসতের মসজিদ থেকে যাত্রা শুরু করেন। এমন হজ্জযাত্রার স্বপ্নটা শুরু হয়েছিল ৩৫ বছর আগে আব্দুল্লাহ হার্নান্দেজ-এর ইসলাম গ্রহণের পর থেকে। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ আমাকে হেদায়েত দান করেছেন, এজন্য আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ। তখনই আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আমার আন্দালুসিয়ান পূর্বপুরুষদের পথে হজ্জ পালন করবো।’ দীর্ঘ সফরে বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তারা। ঘোড়ার পিঠে চড়ে তাদের বিচরণ স্থানীয়দের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক শহর দেখা, স্থানীয় মসজিদে সালাত আদায়, উসমানীয় আমলের স্থাপত্য নিদর্শন পরিদর্শন এবং স্থানীয়দের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে তারা তাদের মন জয় করে নেন। স্থানীয়দের আতিথেয়তার জন্য তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
আব্দুল্লাহ হার্নান্দেজ বলেন, আমরা অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত; আমাদের হৃদয় ভালোবাসা ও আশায় পূর্ণ। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এ মুহূর্তের জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। এ যাত্রার মাধ্যমে আমরা স্পেন থেকে মক্কার হারামে যাওয়ার ঐতিহাসিক আন্দালুসিয়ান পথ পুনরুদ্ধার করতে চাই। এটি শুধু শারীরিক যাত্রা নয়, বরং আত্মারও যাত্রা। আর আবদুল কাদের হারকাসি জানান, তারা হারানো ঐতিহ্য পুনরুজ্জীবিত করতে পেরে খুশি। তাদের ঘোড়ায় চেপে হজ্জযাত্রা মুসলমান ও অমুসলিমদের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পেয়েছে। হার্নান্দেজ বলেন, ‘আমরা যেখানেই গিয়েছি, আমাদের স্বাগত জানানো হয়েছে। মুসলিম ও অমুসলিম উভয়ের বাড়িতেই আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, আমাদের সঙ্গে খাবার খেয়েছেন, গল্প করেছেন এবং ইসলামের ওপর অর্থবহ আলোচনায় অংশ নিয়েছেন।’ সীমিত তহবিল নিয়ে তারা যাত্রা শুরু করেছিলেন। তবে পথে বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা তাদের সহযোগিতা করেছেন এবং যাত্রা সম্পন্ন করতে আর্থিক সাহায্য করেছেন।
স্পেন থেকে ঘোড়ায় চড়ে হজ্জযাত্রা বর্তমান সময়ে আসলেই এক বিস্ময়ের ব্যাপার। দীর্ঘ সফরে তিন বন্ধু ইতিবাচক অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির এ সভ্যতায় গোড়ায় চড়ে, দীর্ঘ সময় ব্যয় করে, কষ্ট-ক্লেশের এই যে অভিযাত্রা তা অনেকের কাছে তেমন যৌক্তিক বলে বিবেচিত নাও হতে পারে। আসলে সেক্যুলারদের জীবন ও জগৎ ভাবনার সাথে মুমিনদের জীবন-জগৎ ভাবনায় পার্থক্য অনেক। তিন বন্ধুর কথায় তা প্রকাশও পেয়েছে। তারা বলেছেন, আমরা স্পেন থেকে মক্কার হারামে যাওয়ার ঐতিহাসিক আন্দালুসিয়ান পথ পুনরুদ্ধার করতে চাই। আরও বলেছেন, এটি শুধু শারীরিক নয়, বরং আত্মারও যাত্রা। আত্মার উন্মেষ ছাড়াতো প্রকৃত মানুষ হওয়া যায় না।