জাতিসংঘের সদ্য প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিশ্বের জনবহুল শহরগুলোর তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে ঢাকা। ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা প্রায় ৪ কোটি ১৯ লাখ জনসংখ্যা নিয়ে শীর্ষে অবস্থান করছে, আর ঢাকার জনসংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৩ কোটি ৬৬ লাখ। এ সংখ্যাগুলো কেবল পরিসংখ্যান নয়- গুলো আমাদের নগর ভবিষ্যৎ, জীবনের মান, রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা এবং টেকসই উন্নয়নকে কঠিন প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়।
বিশ্বের শীর্ষ জনবহুল শহরগুলোর ৯টিই এশিয়ায় পড়েছে। এটি যেমন জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের প্রতিফলন, তেমনই ভবিষ্যৎ ঝুঁকির ইঙ্গিত। টোকিও, সাংহাই, গুয়াংজু কিংবা সিউলের মতো উন্নত শহরগুলোর বিপরীতে ঢাকা এখনো অবকাঠামোগত দুর্বলতা, পরিবেশগত ক্ষয়, ট্রাফিক বিশৃঙ্খলা, ড্রেনেজ সংকট, বায়ুদূষণ এবং বস্তিবাসের ক্রমবর্ধমান চাপের সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছে। প্রশ্ন হলো-৩ কোটি ৬৬ লাখ মানুষের এ মহানগর কি বর্তমান কাঠামো নিয়েই টিকে থাকতে পারবে?
ঢাকা বিশ্বের দ্রুততম জনবৃদ্ধির শহরগুলোর একটি। প্রতিদিন গড়ে প্রায় দু’হাজার মানুষ কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার খোঁজে ঢাকায় আসছে। অথচ শহরটি বহুবর্ষীয় পরিকল্পনা, সমন্বিত অবকাঠামো এবং মহাপরিকল্পনার অভাবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিস্তৃত হচ্ছেÑযেখানে শহরের বৃদ্ধি নয়, বিশৃঙ্খল বিস্তারই মূল বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জাকার্তা বহুদিন ধরেই অতিরিক্ত জনসংখ্যা, ভূমিক্ষয় ও ডুবে যাওয়ার ঝুঁকির কারণে নতুন রাজধানী নির্মাণের পথে হাঁটছে। টোকিও জনসংখ্যা বৃদ্ধি সত্ত্বেও কার্যকর নগর পরিকল্পনা, দক্ষ গণপরিবহন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও আবাসন নীতির কারণে সুষ্ঠু নগরজীবন বজায় রাখতে পেরেছে। উদাহরণগুলো ঢাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাÑ বড় শহর হওয়া সমস্যা নয়, সমস্যা হলো অপরিকল্পিত, অদক্ষ ও অকার্যকর শহুরে ব্যবস্থাপনা।
ঢাকাকে টেকসই রাখতে এখনই যে পাঁচটি অগ্রাধিকারে গুরুত্ব দেওয়া উচিত তা স্পষ্ট। প্রথমত, বহুকেন্দ্রিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। চাকরি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও শিল্পের সব সুযোগ ঢাকায় কেন্দ্রীভূত হওয়ায় জনচাপ বাড়ছে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সুযোগ সৃষ্টি না হলে ঢাকার ওপর চাপ বাড়তেই থাকবে। দ্বিতীয়ত, গণপরিবহনের বৈপ্লবিক উন্নয়ন ছাড়া ঢাকার যানজট কখনোই কমবে না। মেট্রোরেল, বিআরটি, বাস রুট রেশনালাইজেশনÑএসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও সমান্তরাল পথÑপদচারণা, সাইকেল লেন, নদীনির্ভর পরিবহন-গড়ে না উঠলে সামগ্রিক নগরচলাচলে পরিবর্তন আসবে না।
তৃতীয়ত, ড্রেনেজ ও জলাবদ্ধতা সমস্যা সমাধানে বৈজ্ঞানিক খাল-নদী পুনরুদ্ধার জরুরি। প্রতি বর্ষায় জলাবদ্ধতার দৃশ্যই প্রমাণ করে- নগর পানি ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি ব্যর্থ। অপরিকল্পিত ভরাট ও দখল শহরকে বারবার বিপর্যস্ত করছে। চতুর্থত, পরিবেশ সংরক্ষণ ঢাকার জন্য জীবন-মরণের প্রশ্ন। বিশ্বে বায়ুদূষণের শীর্ষ শহর হিসেবে ঢাকার অবস্থান অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের ভয়াবহতা প্রকাশ করে। সবুজ এলাকা বৃদ্ধি, নির্মাণশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ এবং শিল্পবর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কঠোর পদক্ষেপ এখন অপরিহার্য। আর পঞ্চমত, বাসস্থান ও পরিচ্ছন্নতার অবকাঠামো উন্নয়ন ছাড়া নগরজীবন মানসম্মত হতে পারে না। ঢাকায় প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ বস্তিবাসী-যেখানে মৌলিক সেবা সীমিত, স্বাস্থ্যঝুঁকি বেশি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘনঘন ঘটে। একটি আধুনিক রাজধানী কখনোই তার বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে উপেক্ষা করে টেকসই হতে পারে না।
আজ ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক জনবহুল শহর- এটি যেমন আমাদের সক্ষমতার পরিচয়, তেমনই অদক্ষতার কঠিন স্মারক। জনসংখ্যা ঢাকার শক্তি হতে পারে, কিন্তু এর জন্য দরকার সুপরিকল্পিত নগর ব্যবস্থাপনা, দক্ষ অবকাঠামো, পরিবেশবান্ধব নীতি এবং বিকেন্দ্রীকৃত উন্নয়ন। সমস্যা জানা সত্ত্বেও যদি পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর হিসেবে ঢাকার অবস্থান গর্ব নয়- চাপ, দুর্ভোগ ও ঝুঁকির প্রতীক হয়ে দাঁড়াবে। সময় এখনই। ভবিষ্যৎ রাজধানীর রূপরেখা আজকের পরিকল্পনার দিকেই নির্ভর করছে। ঢাকাকে টেকসই ও বাসযোগ্য রাখতে কার্যকর, দূরদর্শী এবং সাহসী নগর নীতির বিকল্প নেই। এখনই সিদ্ধান্ত না নিলে সামনে অপেক্ষা করছে অচল মহানগরীর কঠিন বাস্তবতা।