DailySangram-Logo-en-H90
ই-পেপার আজকের পত্রিকা

সম্পাদকীয়

আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা

বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী দুটি স্তরের সরকার ব্যবস্থা বিদ্যমান। একটি স্থানীয় সরকার অন্যটি কেন্দ্রীয় সরকার।

Default Image - DS

ড. আ.ই.ম. নেছার উদ্দিন

বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী দুটি স্তরের সরকার ব্যবস্থা বিদ্যমান। একটি স্থানীয় সরকার অন্যটি কেন্দ্রীয় সরকার। যা স্বাধীনতার পর থেকে প্রথমে ইউনিয়ন পরিষদ ব্যবস্থাকেই স্থানীয় সরকার বলে বিবেচিত হতো। পরবর্তীতে সরকারগুলোর আমলে পর্যায়ক্রমে উপজেলা ও জেলা পরিষদ স্থানীয় সরকারের রূপরেখায় অন্তর্ভুক্ত হয়। মোট কথায় বিভাগীয় প্রশাসন পর্যন্ত (বিভাগীয় কমিশনার) কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন এবং জেলা পর্যায় থেকে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত স্থানীয় সরকার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। অপরদিকে পৌরসভার ধারণা থেকে মহানগরগুলোর জন্য সিটি কর্পোরেশনগুলোকে স্থানীয় সরকারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বর্তমানে দেশে ৪৫৮১টি ইউনিয়ন, ৩৩০ টি পৌরসভা, ১২টি সিটি কর্পোরেশন, ৪৯৫টি উপজেলা এবং ৬১টি জেলা পরিষদ রয়েছে। এগুলোর প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য স্থানীয় সরকার নির্বাচন জরুরী। কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে গ্রাম পর্যন্ত নেটওয়ার্কিং স্থাপনের জন্য স্থানীয় সরকার ছাড়া অন্য কোন ব্যবস্থা বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত নেই। সে কারণে কেন্দ্রীয় সরকারের চেয়ে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অপরদিকে বিগত ৫ আগস্ট, ২০২৪ থেকে মূলত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জোড়াতালি দিয়ে চালালেও জন নিরাপত্তা ও হয়রানি হচ্ছে অহরহ। আমরা এখানে আলোচনা করলে ধারণা পাওয়া যাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন কেন আগে প্রয়োজন। নিম্নে সংক্ষেপে তা তুলে ধরা হলো :

১। সংসদ নির্বাচন বা জাতীয় নির্বাচন শেষে হওয়া যুক্তিযুক্ত। কারণ স্থানীয় সরকার গঠিত হলে দেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আবহ তৈরি হবে, যা এখন নেই। স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন, উপজেলা ও জেলা নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ জাতীয় নির্বাচনে নির্দলীয়ভাবে দেশপ্রেমের মানসিকতা নিয়ে ভালো সংসদ সদস্য নির্বাচনে অবদান রাখতে পারবেন।

২। বিগত স্বৈরাচারী হাসিনা স্থানীয় সরকারকে রাজনৈতিক প্রতীক ব্যবহার করে দলীয়করণ করার যে চরম অপরাজনীতি চালু করেছিল, অন্তর্বর্তী সরকার নির্দলীয়ভাবে নির্বাচন করলে কম ঝামেলায় জাতি স্থানীয় সরকারে দেশপ্রেমিক ও যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচিত করতে পারবে। দলীয় সরকারের অধীনে তা কখনো সম্ভব নয়।

৩। রাজনৈতিক ও দলীয় সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ রাজনৈতিক পরিচিতিতে নির্বাচন হবে। কোন কোন রাজনৈতিক দল চেয়ারম্যন, মেম্বার, মেয়র-কাউন্সিলর, কমিশনার ইত্যাদিতে প্রার্থী মনোনয়ন দিতে অবৈধ পন্থা বা মনোনয়ন বাণিজ্য করে থাকেন। এবারও তা হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সব খারাপ তা বলা যাবে না। তবে যারা নির্বাচন ও প্রতিনিধি ও নেতা হওয়ার বিষয়কে টাকা কামানোর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে তাদের রুখে দিয়ে যোগ্য নেতৃত্ব যাচাই করার জন্য জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন প্রয়োজন। ইতোমধ্যে সর্বস্তরের স্থানীয় নির্বাচনের টিকেট বা মনোনয়ন পাওয়ার জন্য কেন্দ্র, জেলা, উপজেলাসহ বিভিন্ন জায়গায় তদবীর ও বাণিজ্যের আলামত লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

৪। আওয়ামী দুঃশাসনের পর আমরা নতুন বাংলাদেশ পেলাম। বিবেচনা করা দরকার যে, কেন নতুন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ পদ্ধতির মাধ্যমে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দ্বিমত পোষণ করব? কোন ক্রমেই তা সমীচীন নয়। কেননা ব্রিটিশ আমল থেকেই স্থানীয় সরকার নির্দলীয় ও দেশপ্রেমিক জন প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে। ফলে এধরনের নির্বাচনের এটি মোক্ষম সময়। তাই সকল দিক বিবেচনা করে শক্তিশালী স্থানীয় সরকার গঠনে নির্বাচনটি জাতীয় সরকারের আগে হওয়ার কোন বিকল্প নেই, যা বাংলাদেশের জন্য ইতিহাস হয়ে থাকবে।

৫। স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য লক্ষ্য করে যাচ্ছে। এর সমাধানের জন্য অনেক উপায় অবলম্বন করা যেতে পারে। যেমন সকল জেলা প্রশাসন, বাছাইকৃত মসজিদের ইমাম-খতীব ও স্কুল-কলেজে ও মাদ্রাসার অধ্যক্ষসহ সমাজের বিভিন্ন ক্যাটাগরীর সমাজ প্রতিনিধিদের মতামত নেয়া যেতে পারে। অধিকাংশ যেদিকে মতামত দেয় সেটি বাস্তবায়ন করা হবে দেশের জন্য মঙ্গলময়।

৬। স্থানীয় সরকার নির্বাচন যদি আগে না হয় দলীয় সরকার গঠিত হওয়ার পর ২০২৬ সালের শেষার্ধে হয়তো স্থানীয় সরকার করতে পারবে। ততক্ষণে স্থানীয় সরকারের সেবার যে ঘাটতি হবে তা দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি ডেকে আনবে। সেজন্য দেশপ্রেমের ব্রত ও প্রত্যয় সামনে রেখে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে করে পরবর্তীতে একটি সুশৃঙ্খল পরিবেশে জাতীয় নির্বাচন করা অধিকতর কল্যাণকর হবে। আর রাজনৈতিকভাবে জাতীয় নির্বাচন যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে হয়, তাহলে নির্দলীয় স্থানীয় নির্বাচন তো যেকোন যুক্তিতে তাদের অধীনেই হতে হয়।

৭। ৩৩০ আসনের জাতীয় সংসদ নির্বাচন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার জন্য কয়েক হাজার স্থানীয় জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা আগে করা হলে অভিজ্ঞতা, কর্মক্ষমতা ও যোগ্যতা সহকারে একটি সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন অধিকতর ফলপ্রসূ হবে বলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন।

দেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা বিগত আওয়ামী দুঃশাসনের দলীয়করণে ছারখার হয়ে গেছে। এরপর জনগণ স্থানীয় সরকার সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তথাকথিত চেয়ারম্যান, মেম্বার বা মেয়র, কমিশনার নামীয় চোর ও সন্ত্রাসীরা পালিয়ে গেছে। ভাল ও নিরপরাধ মানুষগুলোই এখন সমাজে বসবাস করছে। এ অবস্থায় রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে একটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা হলে জনগণ সুফল পাবে। তা জাতীয় নির্বাচনের আগে হওয়া বর্তমান প্রেক্ষাপটে হওয়া অত্যন্ত জরুরী। দেশের ৮০% মানুষ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। তাই দেশ ও জনগণের স্বার্থে এ বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন।

লেখক : বিশ্ববিদ্যালয়ের খন্ডকালীন শিক্ষক।