১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে সংঘটিত যুদ্ধকে অনেকেই ‘যুদ্ধ’ না বলে ‘চক্রান্ত’ হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন। ইতিহাসের সে কলঙ্কিত দিনেই বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সূচনা ঘটে। কিন্তু এ পতন শুধু একটি শাসকের নয়, বরং এটি ছিল একটি জাতির আত্মবিশ্বাস, নেতৃত্ব, রাজনৈতিক ঐক্য এবং আত্মপরিচয়ের পরাজয়। সেদিন অস্ত্রের চেয়ে বেশি শক্তিশালী ছিল ষড়যন্ত্রের ছুরি। নবাবের সেনাবাহিনীর ভেতরে থাকা বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর ও তার অনুগত সেনানায়কদের ষড়যন্ত্রেই নবাব সিরাজউদ্দৌলা হেরে যান। ফলে প্রথাগত যুদ্ধ না করেও ব্রিটিশরা সহজেই জয়লাভ করে এবং ব্যবসায়ী থেকে সাম্রাজ্যবাদের শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। সে একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনো পলাশীর সে ষড়যন্ত্র, বিভাজন ও আত্মঘাতী রাজনীতির ছায়া বর্তমান।
জুলাই বিপ্লব পরবর্তী নতুন বাংলাদেশের বাস্তবতায় পলাশী যুদ্ধের চেতনা ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। কারণ আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থার কাঠামোতে, নেতৃত্বের চরিত্রে এবং জনসচেতনতার অভাবের মধ্যেই এখনো পলাশীকে ধারণ করার অপরিহার্যতা রয়েছে। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, পলাশীর যুদ্ধে বিজয়ী ব্রিটিশরা একাই যুদ্ধ জেতেনি, তারা স্থানীয় নেতাদের দুর্বলতা, লোভ, আত্মস্বার্থ ও বিশ্বাসঘাতকতাকে ব্যবহার করেছিল। আজও যখন বিদেশি প্রভাব বা কূটনৈতিক চাপে আমাদের অভ্যন্তরীণ নীতি নির্ধারণ হয়, যখন উন্নয়ন প্রকল্প বা নিরাপত্তা ইস্যুতে বৈদেশিক শক্তির স্বার্থ অগ্রাধিকার পায় তখন বুঝতে কষ্ট হয় না, পলাশীর প্রেতাত্মারা এখনো আমাদের রাজনীতির অভ্যন্তরে বিচরণ করছে। তাছাড়া রাজনৈতিক বিভক্তি, দলীয় স্বার্থের জন্য জাতীয় স্বার্থের বিসর্জন এবং ক্ষমতার মোহে একে অপরকে নির্মূল করার প্রবণতা আজও আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে প্রবল। শহীদ সিরাজউদ্দৌলার পতনের সময় অভ্যন্তরীণ বিভেদই ছিল মূল চালিকাশক্তি। এ ঐতিহাসিক পাঠ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, জাতীয় ঐক্য ব্যতীত কোনো জাতি টিকতে পারে না।
পলাশী যুদ্ধের পরিণতি আমাদের শেখায় যে, নেতৃত্বের নৈতিকতা ও দূরদর্শিতা যখন হারিয়ে যায়, তখন পুরো জাতির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন সাহসী, কিন্তু অভিজ্ঞতার অভাব এবং চারপাশের ষড়যন্ত্রকারীদের চিনতে না পারায় তিনি পরাজিত হন। আজও যদি রাজনৈতিক নেতৃত্ব আত্মসমালোচনাহীন, চাটুকার পরিবেষ্টিত ও নীতিহীন হয়ে পড়ে, তাহলে জাতিও ভুল পথে পরিচালিত হবে। আর সর্বোপরি জনগণের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না। পলাশীর যুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষ ছিল নিঃস্ব, নিপীড়িত ও রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগহীন। আজও যদি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জনগণের ভূমিকা কেবল ভোটদানেই সীমাবদ্ধ থাকে, যদি রাষ্ট্র ও রাজনীতির প্রশ্নে জনতার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
পলাশীর নির্মম পরিণতি আমাদের জাতীয় জীবনে আর ফিরে না আসুক- এটিই আমাদের প্রত্যাশা। কিন্তু সেজন্য সর্বাগ্রে জাতীয় ঐক্য অপরিহার্য। মতাদর্শগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ, সহযোগিতা এবং সমঝোতা অপরিহার্য। বাংলাদেশকে নতুনভাবে গড়ে তোলার যে সুযোগ আমাদের সামনে এসেছে তা যেন অনৈক্যের কারণে হাতছাড়া না হয়। আর যদি এবারও আমরা সুযোগ হারাই তাহলে পরবর্তী প্রজন্মের সামনে আমাদের দাঁড়ানোর আর নৈতিক অধিকার থাকবে না।
এ লক্ষ্যে রাজনীতিসহ সর্বমহলে নৈতিক নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে। রাজনীতিতে নেতৃত্ব হতে হবে আদর্শিক, দূরদর্শী এবং জনবান্ধব। নেতৃত্বের দায়বদ্ধতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হলে দলীয় প্রথার সংস্কার দরকার। বিদেশি প্রভাব থেকে মুক্তি, জাতীয় নিরাপত্তা, অর্থনীতি এবং কূটনীতিতে স্বনির্ভরতা অর্জন করতে হবে। বিদেশি শক্তির দৃষ্টিকোণ নয়, আমাদের নিজস্ব জাতীয় স্বার্থ হতে হবে নীতিনির্ধারণের মূল ভিত্তি এবং সে সাথে জনগণের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ বৃদ্ধিÑরাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ ও সচেতনতা বাড়াতে হবে। সামাজিক আন্দোলন, গণমাধ্যম এবং শিক্ষার মাধ্যমে জনগণকে রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণে উৎসাহিত করতে হবে।
আজকের বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, দলীয় বিভক্তি, বিদেশি স্বার্থে অনুগত্য, গণতন্ত্রের সংকটÑসবকিছুই নতুন করে পলাশীর শিক্ষা স্মরণ করিয়ে দেয়। এখনই সময়, পরাশক্তির ফাঁদ থেকে বেরিয়ে এসে ঐক্য, নৈতিকতা ও আত্মশক্তির ভিত্তিতে একটি ন্যায়ভিত্তিক, গণতান্ত্রিক ও স্বনির্ভর রাষ্ট্র গড়ে তোলার।