ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার এক মাস পেরিয়ে গেলেও মানবিক সহায়তা কার্যক্রম এখনো কার্যত স্থবিরই হয়ে আছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, ইসরাইল ত্রাণ পৌঁছাতে নানা বাধা সৃষ্টি করছে- সীমিত প্রবেশপথ, প্রশাসনিক জটিলতা, অনুমতির বিলম্ব এবং নিরাপত্তার অজুহাতে মানবিক সংস্থাগুলোর কার্যক্রম ব্যাহত করছে। জাতিসংঘের মুখপাত্র ফারহান হক স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘যুদ্ধবিরতির পরও ইসরাইল আমাদের প্রতিটি চলাচলে অনুমতি নিচ্ছে, ত্রাণ পাঠানোর প্রচেষ্টা আটটির মধ্যে মাত্র দুটি অনুমোদন পেয়েছে, বাকিগুলোতে বাধা দেওয়া হয়েছে।’ মানবিক সহায়তার পথে এ রুদ্ধদ্বার নীতি আন্তর্জাতিক মানবতার ওপর সরাসরি আঘাত।
একটি রাষ্ট্র যখন যুদ্ধবিরতির পরও খাদ্য, ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম পাঠাতে বাধা দেয়, তখন সেটি কেবল আগ্রাসনের ধারাবাহিকতাই নয়, বরং মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনকে প্রকাশ্যে উপহাস করার শামিল। ইসরাইলীর এ আচরণ প্রমাণ করছে যে, তারা কেবল হামাসের বিরুদ্ধে নয়, পুরো গাজাবাসীর জীবনধারার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। গাজাকে কার্যত একটি বিশাল কারাগারে পরিণত করা হয়েছে, যেখানে মানুষের বেঁচে থাকার ন্যূনতম শর্তগুলোও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
এদিকে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য চরম মানবিক বিপর্যয়ের ছবি তুলে ধরেছে। টানা দু’বছরের ইসরাইলী আগ্রাসনে এখন পর্যন্ত ৬৯ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। আহত হয়েছেন প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজারেরও বেশি মানুষ। সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয় হলো, ছয় হাজারেরও বেশি মানুষ অঙ্গহানি বা অঙ্গচ্ছেদের শিকার হয়েছেন তাদের মধ্যে এক-চতুর্থাংশ শিশু এবং প্রায় ১৩ শতাংশ নারী। অর্থাৎ শত শত ছোট্ট শিশু জীবনের প্রথম প্রহরেই স্থায়ী প্রতিবন্ধকতার বোঝা নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই শুরু করেছে। মূলত এখন যুদ্ধবিরতি চললেও গাজার হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সরঞ্জামের চরম ঘাটতি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট, ওষুধের অভাব এবং ডাক্তার-নার্সের অপ্রতুলতা আহতদের দুর্ভোগকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ও জাতিসংঘের ত্রাণকর্মীরা বলছেন, আহতদের অনেকেই যথাসময়ে অস্ত্রোপচার না পেয়ে মারা যাচ্ছেন। অঙ্গহানি হওয়া শিশুদের জন্য পুনর্বাসন ও মানসিক সহায়তার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই। চিকিৎসা বা সহায়তা নয়, তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছে কেবল অনাহার, ভাঙা ঘরবাড়ি ও ভয়াবহ আতঙ্ক।
ইসরাইলের এ পরিকল্পিত মানবিক অবরোধ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধের শামিল। জেনেভা কনভেনশনের ৩৩ নম্বর ধারা অনুসারে কোনো বেসামরিক জনগোষ্ঠীর ওপর সম্মিলিত শাস্তি আরোপ বা তাদের জীবনধারণে বাধা দেওয়া স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ। অথচ ইসরাইল গত দু’বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে এসব আইন ভঙ্গ করছে। যুদ্ধবিরতির পরও ত্রাণের পথ বন্ধ রাখার অর্থ হলো, তারা শান্তি নয়, ধ্বংসকে টিকিয়ে রাখতে চায়। বিশ্বের বিবেকসম্পন্ন দেশগুলো এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর এখন স্পষ্ট অবস্থান নেওয়া জরুরি। কেবল উদ্বেগ প্রকাশ বা বিবৃতি দিয়ে দায়িত্ব শেষ করা যাবে না। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে অবশ্যই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে-ইসরাইলের ওপর কার্যকর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, অবরোধ প্রত্যাহারের জন্য সময়সীমা নির্ধারণ এবং মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর জন্য আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে করিডর চালু করতে হবে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (ICC) গাজায় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ইসরাইলের দায় নির্ধারণ করতে হবে।
মুসলিম বিশ্ব, বিশেষ করে আরব লীগ ও ওআইসি-এর ভূমিকা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কূটনৈতিক নীরবতা বা সীমিত নিন্দা নয়, বরং ঐক্যবদ্ধভাবে আন্তর্জাতিক ফোরামে চাপ সৃষ্টি করতে হবে। গাজায় অবরুদ্ধ লাখ লাখ মানুষের আহাজারি ও অসহায় শিশুদের আর্তনাদ উপেক্ষা করার নৈতিক অধিকার কারও নেই। গাজার শিশু, নারী ও নিরস্ত্র মানুষের এই রক্তাক্ত অধ্যায় বন্ধ করতে হলে এখনই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। অবরোধ তুলে নিতে হবে, ত্রাণ প্রবেশের সব বাধা দূর করতে হবে, আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। মানবতা আজ গাজায় রক্তাক্ত- এখনই সময়, বিশ্ব যেন চোখ না সরিয়ে নেয়, বরং মানবতানর হাত বাড়িয়ে দেয়।