অনেক নাটকীয়তার পর অবশেষে বৈঠকটি হলো। ইউনূস-মোদি বৈঠকের কথা বলছি। বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে ব্যাংককের হোটেল সাংগ্রিলায় দু’নেতার মধ্যে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। শুক্রবার বাংলাদেশ সময় দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে দু’দেশের সম্পর্কের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ইতিবাচক আলোচনা করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আলোচনায় শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন ছাড়াও তাকে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত রাখতে ব্যবস্থা নেওয়া, সীমান্ত হত্যা বন্ধ এবং গঙ্গা ও তিস্তা নদীর পানি বন্টন সমস্যার সমাধান করতে বলেছেন ড. ইউসূস। বৈঠক শেষে এ বিষয়ে ব্রিফ করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের সঙ্গে একটি গঠনমূলক ও ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। পাশাপাশি তিনি দিল্লির পুরনো বয়ান অর্থাৎ কথিত সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে তাদের উদ্বেগের কথা জানান। এদিকে ইউনূস-মোদি বৈঠক প্রসঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি ব্যাংককে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রাণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ঢাকার সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্কে চায় দিল্লি। একটি স্থিতিশীল, গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ দেখতে চায় ভারত।’ বাংলাদেশে বসবাসরত হিন্দুসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী মোদি ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অনুরোধ জানিয়েছেন বলে মন্তব্য করেন বিক্রম মিশ্রি। উল্লেখ্য, ড. ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদির মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠক ২০ মিনিটের জন্য নির্ধারিত থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা ৪০ মিনিট স্থায়ী হয়।
ইউনূস-মোদি বৈঠক নিয়ে বিশ্লেষণ চলছে পর্যবেক্ষক মহলে। বৈঠকের অতিব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শেখ হাসিনাকে ফেরত দেওয়ার দাবি। এ ইস্যুতে নিশ্চিতভাবে কূটনৈতিক চাপে পড়বে দিল্লি। বৈঠকে হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে কিনা, তা নিয়ে কূটনৈতিক মহলে আলোচনা এক রকম ছিল না। তবে সব আলোচনার অবসান ঘটিয়ে ব্যাংককের বৈঠকে নরেন্দ্র মোদিকে ড. ইউনূস সাফ জানিয়ে দিলেন, হাসিনাকে বাংলাদেশের ফেরত পাঠাতে হবে। হাসিনা গণহত্যায় অভিযুক্ত আসামি। ড. ইউনূসের পক্ষ থেকে নরেন্দ্র মোদির কাছে সরাসরি হাসিনাকে ফেরত চাওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের কূটনৈতিক সক্ষমতা হিসেবে দেখছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, হাসিনাকে ভারত পাঠাবে কিনা কিংবা ফেরত পাঠালে কখন পাঠাবে তা ভবিষ্যতের বিষয়। কিন্তু বৈঠকে হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর অনুরোধসহ ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় অন্যান্য ইস্যু ড. ইউনূস যেভাবে তুলে ধরেছেন, তা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এক ইতিবাচক অর্জন। বিগত ১৫ বছরে ভারতনির্ভর নতজানু পররাষ্ট্রনীতি থেকে বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ। বেইজিংয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে ফলপ্রসূ বৈঠকের পর এক সপ্তাহের মধ্যেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ড. ইউনূসের এ বৈঠক বাংলাদেশের কূটনৈতিক সক্ষমতারই প্রমাণ বহন করে। এ বৈঠকের মাধ্যমে ড. ইউনূসও তাঁর কূটনৈতিক দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে। বাংলাদেশ এখন একটি ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছে। ভারতের তোলা সংখ্যালঘু ইস্যু নিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের সামনে এ ‘ন্যারেটিভ’ তুলে ধরা ছাড়া আর কোনো ইস্যু নেই। ভারতের পক্ষ থেকে এই ইস্যুতে নানা তৎপরতা দেখা গেছে। কিন্তু সে প্রচেষ্টা তেমন কাজে আসেনি। পশ্চিমা দেশগুলো বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র সংখ্যালঘু নির্যাতন ইস্যুতে ভারতের সাথে মোটেই একমত নয়। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে, ব্যাংকক বৈঠকের মাধ্যমে দূরত্ব ঘুচানোর একটি সুযোগও তৈরি হয়েছে। এই সুযোগ কে কতটা কাজে লাগায় সেটাই এখন দেখার বিষয়।
তবে বাংলাদেশের মানুষ এখন বেশ খুশি। এটা শুধু চীন ও ব্যাংককে কূটনৈতিক সাফল্যের জন্যই নয়; নতজানু পররাষ্ট্রনীতি পরিহারের পাশাপাশি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে নাটকীয় অগ্রগতির কথাও এখানে উল্লেখ করতে হয়। কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া তালিকাভুক্ত ৮ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে প্রথম ধাপে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার যোগ্য বলে জানিয়েছে দেশটির জান্তা সরকার। চূড়ান্ত যাচাই-বাছাইয়ের পর্যায়ে আছে আরো ৭০ হাজার রোহিঙ্গা। এটা কি আমাদের জন্য খুশির খবর নয়?