দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে কাশ্মীর একটি পুরনো কিন্তু অত্যন্ত স্পর্শকাতর ইস্যু। এটি শুধু ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার একটি দ্বন্দ্ব নয়, বরং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, আন্তর্জাতিক কূটনীতি এবং পরমাণু যুদ্ধের ঝুঁকির অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। সাম্প্রতিক সময়ে কাশ্মীর উপত্যকায় রাজনৈতিক উত্তেজনা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এবং সীমান্তে গোলাগুলি বৃদ্ধির কারণে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে আবারো সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। মঙ্গলবার দিবাগত মধ্যরাতের পর পাকিস্তানের কোটলি, ভাওয়ালপুর, মুরিদকে, বাগ ও মুজাফফরাবাদে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ভারত। এ হামলায় ২ শিশুসহ ১২ পাকিস্তানি নিহত ও আরো ৩৫ জন বেসামরিক ব্যক্তি আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ইতিমধ্যে এর বদলা নিতে শুরু করেছে। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দাবি করা হয়েছে।
১৯৪৭ সালের উপমহাদেশ বিভাজনের পর থেকেই কাশ্মীর প্রশ্নে দু’দেশের মধ্যে তিনবার যুদ্ধ হয়েছে। ২০১৭ সালে ভারতের সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার এবং অঞ্চলটিকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করার সিদ্ধান্তে পাকিস্তান তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায়। এরপর থেকেই কূটনৈতিক সম্পর্ক খারাপ থেকে আরও খারাপের দিকে গিয়েছে। সীমান্তে গুলি বিনিময়, সেনা মোতায়েন বৃদ্ধি এবং কাশ্মীরি জনগণের ওপর কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা এ উত্তেজনাকে আরও তীব্র করে তুলেছে। সর্বশেষ পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলা এবং এতে ২৬ জন পর্যটক নিহত হওয়ার পর দুদেশের মধ্যে উত্তেজনা নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে।
সবচেয়ে ভয়ংকর দিকটি হলো-দু’দেশই পারমাণবিক অস্ত্রধারী। তাই একটি সীমিত সংঘর্ষও যে বড় ধরনের যুদ্ধ বা পরমাণু সংঘাতে রূপ নিতে পারে, তার ঝুঁকি অস্বীকার করা যায় না। পাকিস্তান ও ভারতের সেনাবাহিনীতে সাম্প্রতিক সরব প্রস্তুতি, মিডিয়ায় উসকানিমূলক বক্তব্য এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের তীব্র ভাষাÑসবকিছু মিলে যুদ্ধের আশঙ্কা উস্কে দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক মহলও কাশ্মীর পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। জাতিসংঘ একাধিকবার এ বিষয়ে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিলেও ভারত বরাবরই বিষয়টিকে দ্বিপাক্ষিক বলে উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ প্রত্যাখ্যান করেছে। অপরদিকে পাকিস্তান কাশ্মীরকে একটি আন্তর্জাতিক সংকট হিসেবে তুলে ধরতে চায়। এমন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই আলোচনার পথ বারবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর জন্য এটি একটি বড় উদ্বেগের বিষয়। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের অর্থ হলো-আঞ্চলিক অস্থিরতা, শরণার্থী সংকট, অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি। দক্ষিণ এশিয়ায় ইতোমধ্যেই দারিদ্র্য, বেকারত্ব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং জলবায়ু সংকট বিরাজমান। এরমধ্যে একটি যুদ্ধ গোটা অঞ্চলকে এক দশক পেছনে ঠেলে দিতে পারে। এমন প্রেক্ষাপটে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলোর উচিত দ্বিপাক্ষিক আলোচনার জন্য উভয়পক্ষকে উৎসাহিত করা। একই সঙ্গে কাশ্মীরি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার, স্বাধীন মতপ্রকাশ ও রাজনৈতিক পরিচয় নিশ্চিত করাও গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়; বরং কূটনৈতিক সংলাপ, আস্থা গঠনমূলক ব্যবস্থা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে একটি দীর্ঘস্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করাই সময়ের দাবি।
বিশেষ করে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর উচিত হতে পারে একযোগে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষে অবস্থান নেওয়া। সংঘাতমুক্ত, স্থিতিশীল উপমহাদেশ কেবল ভারত-পাকিস্তান নয়, গোটা অঞ্চলের অর্থনীতি, নিরাপত্তা এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য। আমাদের মনে রাখতে হবে, যুদ্ধ কোনো সমস্যার স্থায়ী সমাধান নয়-বরং এটি নতুন সংকটের জন্ম দেয়। কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের উত্তেজনার আগুনে যদি আরেকটি যুদ্ধের বিস্ফোরণ ঘটে, তবে তা হবে গোটা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য রীতিমত উদ্বেগের। বর্তমান অনিশ্চিত বাস্তবতায় আঞ্চলিক ও বিশ্ব নেতৃবৃন্দের দায়িত্বশীল আচরণ ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় সুনির্দিষ্ট ভূমিকা পালনের কোনো বিকল্প নেই।