পৃথিবীর সবুজ বৃক্ষ, বন-বনানী আমাদের আনন্দ দেয়, স্বস্তি দেয়। বৃক্ষ ফল দেয়, ওষুধ দেয়, অক্সিজেন দেয়। শুষে নেয় কার্বন। বৃক্ষ-বন্ধুর এমন আচরণের তুলনা হয় না। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, সব দেশের বৃক্ষের ধর্ম একই রকম। দেশভেদে বৃক্ষের আচরণে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় না। তাইতো বৃক্ষে এতো শান্তি ও স্বস্তি। তবে বর্তমান সময়ে বৃক্ষে আস্থা রাখা গেলেও মানবে আস্থা রাখা যায় না। তাহলে বৃক্ষ কি মানবের চাইতে উত্তম? অথচ মানুষ গর্বের সাথে উচ্চারণ করে মানুষই সৃষ্টির সেরা জীব। তবে মুখে উচ্চারণ করলেই সেরা হওয়া যায় না, কাজেও প্রমাণ থাকা চাই। সব দেশের বৃক্ষের চরিত্র এক রকম, কিন্তু সব দেশের মানুষের চরিত্রে কি মিল আছে? সব দেশের প্রসঙ্গ না হয় বাদই দিলাম, কোনো একটি দেশের মানুষের চরিত্র কি বৃক্ষের মত কল্যাণ প্রভায় মণ্ডিত? একটি দেশের বৃক্ষের আচরণের শান্তি ও স্বস্তির নিশ্চয়তা থাকে, কিন্তু সে দেশের ক’জন মানুষের আচরণে শান্তি ও স্বস্তির পরশ পাওয়া যায়? এমন তারতম্য কেন? আসলে অবয়বের সব মানুষের চরিত্র মনুষ্য মর্যাদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এ কারণেই তো পৃথিবীতে এতো যুদ্ধ বিগ্রহ ও হানাহানি। সাহিত্যিকদের কলমে বৃক্ষ ও মানুষের বর্ণনা লিপিবদ্ধ হয়েছে। তুলনা, প্রতিতুলনাও রয়েছে। বিষবৃক্ষ নামে উপন্যাসও রচিত হয়েছে। উপন্যাসে কল্পনা থাকে, তুলনা থাকে, কখনো কখনো মানুষকেই ‘বিষবৃক্ষ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এগুলো লেখকের বিবেচনাবোধ এবং উপমা উৎপ্রেক্ষার বিষয়। তবে বৃক্ষ সব সময় কল্যাণপ্রদ, মানুষ কদাচিৎ। মানুষের এতটা অধপতন কেন? পতনের কারণ থাকে। মানুষ যখন আদর্শচ্যুত ও নীতিহীন হয়ে পড়ে, তখন তার পতন ঘটে। পতিত মানুষের হাতে যত অস্ত্র ও ডলার থাকুক না কেন, তাতে সে মানুষ হয়ে ওঠে না। বর্তমান সময়ে তো অস্ত্র ও ডলারের দম্ভে মানবরূপী দানবরা পৃথিবীকে মানুষের বসবাসের অনুপযোগী করে তুলছে।

গাজা কি এখন মানুষের বসবাসের উপযোগী আছে? সারাবিশ্বের মুসলমানরা যখন ঈদুল আজহার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন গাজাবাসী লড়ছিল প্রাণ বাঁচাতে। খাদ্য নেই, পানি নেই, ওষুধ নেই, মাথা গোঁজার তাঁবুও নেই। চারিদিকে আছে শুধু অস্ত্রের ঝনঝনানি ও গোলাবৃষ্টি। এখানে মৃত্যুর নিশ্চয়তা আছে কিন্তু বাঁচার হাতছানি নেই। বিশ্ববাসী চেয়ে চেয়ে দেখছে, আর নেতানিয়াহুর প্রশাসন ধ্বংস করে চলেছে গাজা নামক একটি জনপদ। যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত ও রক্তাক্ত গাজায় এবার ঈদ ছিল না। গাজার বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি ও তাঁবুতে তাঁবুতে নিরন্ন ও আহত নর-নারী শিশুর কান্না। সভ্যপৃথিবীর বিলাসভবনে ওদের কান্না পৌঁছে না। পাপ-পঙ্কিলতা ও অপরাধে অপরাধে সভ্যতার শাসকদের হৃদয় পাথর হয়ে গেছে। পাথুরে হৃদয় মজলুমের আহাজারি শ্রবণে সক্ষম নয়। ফলে বধির শাসকরা আমাদের প্রিয় এ পৃথিবীকে ক্রমেই মানুষের বসবাসের অনুপযুক্ত করে তুলছেন।

ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলী আগ্রাসন ৬০০ দিন অতিক্রম করেছে। এখনো সেখানে চলছে নিষ্ঠুর ধ্বংসযজ্ঞ। গাজায় ৩ জুনও নিহত হয়েছে ৪০ জন। এ জনপদে নিহতের সংখ্যা ছুঁয়েছে ৫৫ হাজারে। বিশ্লেষকরা প্রশ্ন রেখেছেন, ইসরাইলের রক্ততৃষ্ণা থামবে কবে? আল জাজিরার এক বিশ্লেষক লিখেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্ধকার দিনগুলোতে অ্যান ফ্রাঙ্ক এবং তার পরিবার ন্যাৎসি নির্যাতনের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে আমস্টারডামের একটি গোপন কক্ষে লুকিয়ে ছিলেন। মৃত্যুর পর প্রকাশিত তাঁর ডায়েরি বিশ্বকে সে সময়ে ইহুদি পরিবারগুলোর ভয় এবং মানসিক আঘাতের এক ভূতুরে দৃশ্যের আভাস দিয়েছে। আজ ফিলিস্তিনে একই গল্পের করুণ দৃশ্যাবলী উন্মোচিত হচ্ছে। এখন অ্যান ফ্রাঙ্কের মতো শিশুরা- যাদের সংখ্যা হাজার হাজার, ইসরাইল সরকারের সৃষ্ট অনাহার এবং অবিরাম বোমাবর্ষণের কারণে মৃত্যুর মুখোমুখি হচ্ছে। তাদের লুকানোর জন্য একটি কক্ষও নেই। ইসরাইলের নির্বিচার আক্রমণে তাঁদের চারপাশের ভবনগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

৩ জুন গাজার ত্রাণকেন্দ্রে আবারো ইসরাইলী হামলায় ২৭ জন নিহত হওয়ার খবর দিয়েছে হামাস নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ হত্যার ঘটনায় ইসরাইল জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠায় স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। উত্তম আহ্বান। তদন্ত তো অনেক হয়েছে। আন্তর্জাতিক আদালতে যুদ্ধাপরাধী এ দেশটিকে কাঠগড়ায়ও দাঁড় করানো হয়েছে, কিন্তু এতে পরিস্থিতির কি কোনো পরিবর্তন হয়েছে? হয়নি, এর বাস্তব কারণ আছে। বক্তৃতা-বিবৃতি ও সুবচনে ইসরাইলের মতো যুদ্ধাপরাধী রাষ্ট্র ও নেতানিয়াহুর মতো নিকৃষ্ট দানবের আচরণে কোনো পরিবর্তন ঘটবে না। ওদের জন্য প্রয়োজন কঠোর শাস্তি। কিন্তু সে শাস্তি প্রদানের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভেটো পাওয়ারসহ বড় বড় বহুরাষ্ট্র। এমন প্রশ্রয় পেয়ে গাজা উপত্যকায় অবিরত বোমা হামলা চালিয়ে জনপদটিকে ধ্বংস্তূপে পরিণত করেছে ইসরাইল। এতকিছুর পরও গাজায় কেন বিজয়ী হতে পারেনি ইসরাইল, এটি এখন সময়ের বড় প্রশ্ন। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরাইল তো এখন ‘নাৎসিসদৃশ’ রাষ্ট্র। নেতানিয়াহুর জায়নবাদী সরকার যুদ্ধের যে তিন মূল লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল, সেগুলোর কোনোটিই এখনো অর্জিত হয়নি। তার কারণ, ফিলিস্তিনীদের অদম্য মনোবল এবং প্রতিরোধ আন্দোলন ‘হামাসের’ অবিরাম লড়াই।

অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনী ভূখণ্ড গাজার পরিস্থিতি এখন ‘দোজখের চেয়ে ভয়াবহ’ বলে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির প্রধান মিরইয়ানা স্পোলইয়ারিক। বুধবার বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করেন তিনি। হয়তো পরিস্থিতির ভয়াবহতা বোঝাতে তিনি দোজখের প্রসঙ্গটি টেনে এনেছেন। শুধু মিরইয়ানা নন, পরিস্থিতির ভয়াবহতা তুলে ধরতে আরও অেেনকেই এভাবে দোজখের প্রসঙ্গটি টেনে এনেছেন। তবে আমাদের বিবেচনায় দোজখের সে ভয়াবহ পরিস্থিতির সাথে পৃথিবীর কোনো পরিস্থিতিরই তুলনা হয় না। তবুও আমরা যে তুলনা করছি, সেটা আমাদের এক ধরনের সীমাবদ্ধতা। সাক্ষাৎকারে রেডক্রস প্রধান বলেন, গাজায় যুদ্ধ বন্ধে বিশ্ব মানবতা ক্রমাগতভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো ফিলিস্তিনীদের দুর্ভোগের সমাপ্তি ও ইসরাইলী জিম্মিদের মুক্তিতে যথেষ্ট পদক্ষেপ নিচ্ছে না। তিনি বলেন, গাজার ফিলিস্তিনীরা মৌলিক মানবিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইনকে সম্পূর্ণভাবে অবজ্ঞা করা হচ্ছে। মিরইয়ানা স্পোলইয়ারিক বলেন, গাজায় যা হচ্ছে তা আইনি ক্ষেত্র, নৈতিকতা ও মানবিক-সব ধরনের সীমালঙ্ঘন করেছে। তাহলে কি সীমালঙ্ঘনের এক সভ্যতায় আমরা বসবাস করছি? এ সভ্যতার মহারাজা যেন নেতানিয়াহু। নেতানিয়াহু সরকারের যুদ্ধাপরাধসহ যাবতীয় সীমা লঙ্ঘনমূলক কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দেওয়ার জন্যই কি বর্তমান সভ্যতার শাসকদের অধিষ্ঠান? এমন সভ্যতা দিয়ে আমরা কী করব? কিছুটা সত্যতা নিয়ে বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখবো, বর্তমান সভ্যতায় বিশ্বের মুসলিম জনগোষ্ঠী শোষিত, বঞ্চিত এবং অত্যাচরিত। সভ্যতার সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এ ধরিত্রীতে মুসলিম জনগোষ্ঠীর বেঁচে থাকাই অসম্ভব হয়ে উঠেছে। মানবিক জীবন-যাপন তো অনেক দূরের বিষয়। ফলে এ মেকি সভ্যতার বড় বড় মানুষের চাইতে বৃক্ষ এখন মজলুম মুসলমানদের কাছে অনেক মহৎ এবং প্রিয়ও বটে। আমরা জানি, এমন মন্তব্যে সভ্যতার শাসকরা মোটেও লজ্জিত হবেন না। কারণ লজ্জা তো মানবের ভূষণ। অবয়বের তথাকথিত মানুষদের তো এ জিনিস থাকতে নেই।