ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন সবসময়ই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এ নির্বাচনকে অনেকেই জাতীয় রাজনীতির ক্ষুদ্র প্রতিচ্ছবি বলে অভিহিত করেন। কারণ ডাকসু কেবল একটি ছাত্র সংসদ নয়Ñ এটি এমন একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে গড়ে ওঠা নেতৃত্ব অতীতে জাতীয় নেতৃত্বের ধারায় অবদান রেখেছে। ফলে এ নির্বাচনের ফল শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পছন্দ নয়, বরং দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির গতিধারারও প্রতিফলন।
এবারের ডাকসু নির্বাচনে সাদিক কায়েম ১৪ হাজার ৪২ ভোট পেয়েছেন, যেখানে তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান মাত্র ৫ হাজার ৭০৮ ভোট পান। একইভাবে জিএস পদেও ছাত্রশিবিরের এস এম ফরহাদ ১০ হাজারের বেশি ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। এজিএস পদে ছাত্রশিবিরের মহিউদ্দিন খান ১১ হাজারের বেশি ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। এছাড়াও অধিকাংশ সম্পাদক পদেই ছাত্রশিবিরের প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। এ ফল নিঃসন্দেহে একটি ভূমিধস বিজয়, যা ছাত্ররাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি করেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এ বিজয় কী বার্তা দিচ্ছে? প্রথমত, এটি প্রমাণ করছে যে দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত ও প্রান্তিককৃত শিক্ষার্থীদের অভিমত এবার নির্বাচনের মাধ্যমে যথাযথভাবে প্রকাশিত হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে ছাত্রসমাজ একটি শক্ত বিকল্প নেতৃত্ব খুঁজছিল। প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে তারা এমন নেতৃত্ব বেছে নিয়েছে, যাদের প্রতি তাদের আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে। দ্বিতীয়ত, এটি একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত যে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পরিবর্তনের চাহিদা ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠছে।
এখন সবচেয়ে বড় দায়িত্ব আমাদের সবার-এ রায়কে শ্রদ্ধার সঙ্গে মেনে নেওয়া। গণতন্ত্রের সৌন্দর্য এখানেই যে জনগণ কিংবা এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা, যে সিদ্ধান্ত দেন, তা বিনয়ের সঙ্গে মেনে নিতে হবে। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলে ফল যা-ই হোক না কেন, সেটি মেনে নেওয়াই রাজনৈতিক পরিপক্ব¡তার পরিচায়ক। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অতীতে আমরা দেখেছি, ডাকসুর নির্বাচন শেষে নানা বিতর্ক, সহিংসতা ও অস্বীকৃতির সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে; কিন্তু এবার সময় এসেছে সে অতীত থেকে বেরিয়ে আসার। যদিও অনেক দল এরই মধ্যে নির্বাচনের ফলাফল বর্জন করার ঘোষণা দিয়েছে। তবে জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী নতুন এই বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের যে স্পষ্ট রায় প্রকাশিত হয়েছে, তা মেনে নিয়ে একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।
অবশ্য নির্বাচিত প্রার্থীদের দায়িত্বও কম নয়। তাদের মনে রাখতে হবে, তারা শুধু একটি সংগঠন বা গোষ্ঠীর প্রতিনিধি নন, বরং গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব করছেন। তাই দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সবার অধিকার, শিক্ষার পরিবেশ, ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করাই হবে তাদের প্রধান দায়িত্ব। যদি তারা এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেন, তবে ডাকসু আবারও জাতীয় জীবনে গৌরবময় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
সবশেষে বলা যায়, ডাকসুর এ ভূমিধস বিজয় ছাত্রশিবিরের জন্য একটি বড় রাজনৈতিক অর্জন হলেও এর চেয়েও বড় অর্জন হলো ছাত্রসমাজের গণতান্ত্রিক রায়ের প্রতিফলন। এ রায় দেখিয়েছে যে শিক্ষার্থীরা পরিবর্তন চান, তারা নতুন নেতৃত্ব চান এবং তারা তাদের ভবিষ্যতের জন্য একটি স্পষ্ট দিকনির্দেশনা ঠিক করতে সক্ষম। জাতীয় রাজনীতির জন্য এ বার্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অতএব, এখন সময় এসেছে, দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে শিক্ষার্থীদের এ গণতান্ত্রিক রায়কে শ্রদ্ধার সঙ্গে মেনে নেওয়ার। কারণ গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার সবচেয়ে বড় উপায় হলো জনগণের রায়কে মর্যাদা দেওয়া। আর ডাকসুর এ নির্বাচন আমাদের সেই সুযোগ করে দিয়েছে।