বাংলাদেশ আজ এক নতুন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আছে। জুলাই বিপ্লবের পর আমরা এক নতুন বাংলাদেশে অবস্থান করছি যেখানে দেশের উন্নয়ন, অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সামাজিক পরিবর্তন দৃশ্যমান। কিন্তু সেসঙ্গে এমন কিছু রাজনৈতিক চর্চা এখনও রয়ে গেছে, যা আমাদের জাতীয় জীবনের জন্য অন্তরায় হয়ে আছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো বিভাজনের রাজনীতি। এর আগে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগও তার রাজনৈতিক কথনে এ বিভাজনের বয়াণ টানা সাড়ে ১৫ বছর ব্যবহার করেছে। বিভাজনের এ বয়ান দেশে এমনই একটি বাস্তবতা তৈরি করেছিল যেখানে ভিন্নমত, গঠনমূলক সমালোচনা কিংবা বিকল্প রাজনৈতিক চেতনার অস্তিত্বও নিয়মিতভাবে অস্বীকার করা হতো।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বাধীনতা-পূর্ব ও পরবর্তী সময় থেকে বিভক্তির রাজনীতি শুরু হয়েছে। তবে বিষয়টি মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে চলে যায় যখন আওয়ামী লীগ ‘স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ’ নাম দিয়ে নতুন করে ট্যাগিংয়ের রাজনীতি করতে শুরু করে। এ ধরনের বিভাজন সৃষ্টিকারী বয়াণ রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য সময়বিশেষে কার্যকর হতে পারে, কিন্তু জাতীয় ঐক্য, গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় সংহতির জন্য এটি অত্যন্ত ক্ষতিকর। একটি রাষ্ট্রের সকল নাগরিকই তার সমান অংশীদার। ইতিহাসের দায় যেমন সকলের, তেমনি ভবিষ্যতের স্বপ্নও সবার। মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগের বিভাজনমুখী কৌশলের কারণেই বিগত দেড় দশকে গণতন্ত্র সংকুচিত হয়েছে, বিরোধী মত দমন করা হয়েছে, মিডিয়ার স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এবং মানুষের অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রযন্ত্র কখনও পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করেছে। এ বাস্তবতায় স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষের বয়াণ হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক দমননীতির একটি হাতিয়ার।
বর্তমান তরুণ সমাজ এ বিভাজনের রাজনীতিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল। আওয়ামী লীগের একপেশে বয়াণ শুনতে শুনতে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। নতুন এ প্রজন্ম অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক শাসন দেখতে চেয়েছিল। তারা রাজনৈতিক নেতার মুখের বুলি নয়, কাজের প্রমাণ চায়। তাদের কাছে দেশপ্রেম মানে শুধু গলাবাজি নয়, বরং দেশের জন্য সৎভাবে, দক্ষভাবে কাজ করা। আওয়ামী লীগ সে প্রত্যাশাগুলো পূরণ করতে পারেনি বলেই জুলাই বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। জুলাই বিপ্লব চলাকালে আওয়ামী লীগ বিরোধী সকল মঞ্চ, সকল প্লাটফর্ম একই ব্যানারের আওতায় চলে এসেছিল। ফ্যাসিবাদের পতন নিশ্চিতে সবাই একাট্টা হয়ে কাজ করেছিল।
কিন্তু বিপ্লবের ৯ মাস পরে আমরা আবার বিভাজনের রাজনীতির আভাস দেখতে পাচ্ছি। নানামহল থেকে এমনকী সরকারের শীর্ষ অবস্থানে থেকেও বিভাজনের সুর তোলা হচ্ছে। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বলে যারা জনগণকে আশান্বিত করেছিল, তারা আবার পাকিস্তানপন্থী আর বাংলাদেশপন্থী রাজনীতি বলে দেশকে বিভাজিত করার চেষ্টা করছে। এ যেন আওয়ামী আমলের স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ বয়াণেরই নতুন সংস্করণ। এ ধরনের কৌশল বা দৃষ্টিভঙ্গি জাতিকে আরো বেশি বিভক্ত ও দুর্বল করে তুলবে এবং অপশক্তিগুলোর প্রত্যাবর্তনের পথ খোলাসা করবে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত আসার পরপরই এ ধরনের বিভাজনের সুর ওঠায় অনেকেই এর নেপথ্যে ভিন্ন কোনো কারসাজি বা মোটিভ থাকতে পারে বলেও আশংকা করছেন।
বাংলাদেশ আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। এমতাবস্থায় দায়িত্বশীল প্রতিটি মহলের উচিত আওয়ামী লীগের মতো সে বিভাজন কেন্দ্রিক বয়াণ থেকে বেরিয়ে আসা। ইতিহাসের দায় তার যথার্থভাবে পালন করা, কিন্তু সেটিকে হাতিয়ার করে বিরোধী মতকে দমন করার চেষ্টা আর কাম্য নয়। রাজনীতি হবে মত ও পথের ভিন্নতা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলা। সেখানে কেউ ভিন্নমত দিলে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহী বানিয়ে দেওয়া বা অমুকপন্থী আখ্যা দেওয়া উচিত নয়। বিভাজনের রাজনীতির পরিণতি আমরা অতীতে দেখেছিÑসহিংসতা, নির্বাচন বর্জন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, আইনের অপব্যবহার, বিচারব্যবস্থার পক্ষপাত। এসব থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আমাদের দরকার রাজনীতিতে একটি মৌলিক পরিবর্তন। দল নয়Ñরাষ্ট্র, গোষ্ঠী নয়Ñজাতি, স্বার্থ নয়Ñসেবার রাজনীতি প্রয়োজন। উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে হলে, সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে হলে, এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে টেকসই করতে হলেÑবিভাজনের রাজনীতি পরিহার করা এখন সময়ের দাবি।