অর্থমন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সম্প্রতি একটি পরিপত্র জারি করেছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, যদি কোন মন্ত্রণালয় এবং বিভাগ ‘এনুয়াল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামে’র (এডিপি) বা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় বরাদ্দকৃত অর্থের অন্তত ৬০ শতাংশ অর্থবছরের প্রথম তিন কোয়ার্টারের মধ্যে ব্যয় করতে পারবে না তাদের জন্য চতুর্থ কোয়ার্টারের বরাদ্দ আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যাবে। পরিপত্রে উল্লেখ করা হয়, বর্তমানে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো এমনভাবে বাজেট বাস্তবায়ন করছে যে তাতে আর্থিক শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি থাকছে অত্যন্ত মন্থর। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্রান্তিকেও সে মন্থরতা বহাল থাকছে। চতুর্থ প্রান্তিকে অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে পরিমাণ এবং গতি বৃদ্ধি পায়। এতে সরকারি ব্যয়ের গুণগত মান নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এডিপি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার তার উন্নয়ন কার্যক্রম সম্পন্ন করে থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এডিপি বাস্তবায়নের হার ক্রমশ মন্থর হয়ে যাচ্ছে। এটা উদ্বেগজনক। চলতি অর্থবছরের (২০২৫-২০২৬) প্রথম মাসে অর্থাৎ জুলাই মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল দশমিক ৬৯ শতাংশ, যা বিগত ৮ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। জুলাই মাসে এডিপির আওতায় বরাদ্দকৃত অর্থ খরচ হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা,যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা কম।

এডিপির আওতায় বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে এ মন্থরতা নানা সমস্যার সৃষ্টি করছে। বিষয়টি উদ্বেগজনকও বটে। তাই সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল ইস্যুটিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম সম্পাদিত হয়। তাই এতে গুণগত মান এবং অর্থ ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা খুবই জরুরি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের হার দিন দিনই মন্থর হয়ে পড়ছে।

অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, অর্থবছরের প্রথম তিন কোয়ার্টারে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে মন্থরতা পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু শেষের কোয়ার্টার অর্থাৎ এপ্রিল-জুন সময়ে অর্থ ব্যয়ের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। এতে অর্থ ব্যয়ের পরিমাণ কিছুটা বাড়লেও গৃহীত প্রকল্পের গুণগত মান নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। বছর শেষে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের হার ৮০ শতাংশের নিচে থাকে। অনেক দিন আগে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের মন্থর গতি নিয়ে একটি গবেষণা কর্ম হয়েছিল।

এতে উল্লেখ করা হয়, বেশ কিছু কারণে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে। এর মধ্যে সময়মতো বরাদ্দকৃত অর্থ ছাড়করণ না হওয়া, প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণে জটিলতা, প্রকল্প অনুমোদনে বিলম্ব হওয়া ইত্যাদি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এসব সমস্যা কী কোনভাবেই সমাধানযোগ্য নয়? স্থানীয় পর্যায়ে যারা একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন তারা বেশ আগে থেকেই জানেন প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন হবার পর কিভাবে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রাথমিক কাজগুলোতো আগেই সম্পন্ন করে রাখা যায়। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয় জনগণের ট্যাক্সের অর্থে। কাজেই বরাদ্দকৃত অর্থ স্বচ্ছতার সঙ্গে ব্যয় করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণ তাদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য রাজনৈতিক বিবেচনা প্রকল্প গ্রহণ এবং অনুমোদন করিয়ে থাকেন। গত সরকার আমলে অতি উন্নয়ন অতি দুর্নীতির মহোৎসব প্রত্যক্ষ করা গেছে।

গৃহীত প্রকল্প সঠিকভাবে নির্দিষ্ট সময়ে বাস্তবায়িত হলো কি না হলো তা বিবেচনা করা হয়নি। এমনও দেখা গেছে, ব্রিজ তৈরি হয়েছে কিন্তু সে ব্রিজে উঠার মতো এপ্রোস রোড নেই। ফলে ব্রিজ সাধারণ মানুষের জন্য কোন উপকারে আসেনি। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে অর্থায়ন নিশ্চিত করার জন্য রাজস্ব আহরণের পরিমাণ বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে বরাদ্দকৃত অর্থ যাতে সঠিক সময়ে স্বচ্ছতার সঙ্গে ব্যয়িত হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দেশে আরো একটি বাজে প্রবণতা প্রত্যক্ষ করা যায়। সাধারণত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন বলতে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়কে বুঝানো হয়। কিন্তু এটা মোটেও ঠিক নয়। বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ের পাশাপাশি প্রকল্প বাস্তবায়ন কতটা হলো তা বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। অনেক ক্ষেত্রে এমনও দেখা গেছে, প্রকল্প অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে কিন্তু ঠিকাদার পুরো বিল তুলে নিয়ে গেছেন। কাজেই শুধু অর্থ ব্যয় করতে পারা বা না পারার উপর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ভর করে না।