আজ ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর। জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি যুগ সন্ধিক্ষণ। এটা যেন পূর্বাপরের এক মেলবন্ধন। দুটি বিপরীত দ্বান্দ্বিক রাজনৈতিক সমীকরণের এক ঐতিহাসিক মোহনা। স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা আরও কঠিন; শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে এ কঠিন রাজনৈতিক পরীক্ষারই এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত হলো ৭৫ সালের ৭ নভেম্বর।

৭ নভেম্বর যথাযোগ্য মর্যাদায় ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ পালনের আহ্বান জানিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ দিনটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং জাতির বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত মোকাবিলার সংকল্পে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর দেশের মুক্তিকামী জনতা এবং দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী একটি পরিবর্তনের প্রত্যাশায় রাস্তায় নেমে এসে ভারতীয় আধিপত্যবাদের অনুগত সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক নতুন গতিপথ নির্ধারণ করেছিল। একাত্তরের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে গণতন্ত্র, সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক মুক্তির গ্যারান্টি দেয়া হয়েছিল। আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রী ও দলীয় ক্যাডারদের দুর্নীতি-লুটপাটের কারণে দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। লাখ লাখ মানুষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করে।

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কিছু সেনা অফিসার পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন। তখন দেশপ্রেমিক সৈনিক ও জনতা ঐক্যবদ্ধভাবে ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার’ স্লোগান দিয়ে রাজপথে নেমে সে ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত প্রতিহত করে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে হেফাজত করেছিলেন।

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের দিকে যদি আমরা লক্ষ্য করি, তাহলে একটি দিক প্রতীয়মান হবে যে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা স্বাধীনতা লাভ করি বটে। কিন্তু ’৭৫ সালের ৭ নভেম্বর পর্যন্ত প্রকৃতপক্ষে এদেশের জনগণ স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারেনি। কারণ ’৭২-৭৫ পর্যন্ত মানুষ ছিল মৌলিক অধিকার তথা বাকস্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক অধিকার এমনকি রাজনৈতিক স্বাধীনতা হতে বঞ্চিত।

স্বাধীন দেশে আওয়ামী লীগ এমন দুঃশাসন কায়েম করেছিল যার ফলে দুর্ভিক্ষ, চুরি, ডাকাতি, হত্যাকাণ্ড, নারী নির্যাতন, শিক্ষাঙ্গনে অরাজকতা, কালোবাজারি, মুনাফাখোরি, মজুদদারী, চোরাকারবারি এবং সবশেষে বাকশাল কায়েম করে মানুষের মৌলিক অধিকারকে হরণ করে নেয়। সময়ের স্রোতে আওয়ামী লীগের চরম ব্যর্থতার সমাধির ওপর ৭ নভেম্বর দাঁড়িয়ে যায় জনগণের আকাক্সিক্ষত স্বপ্নের সোপান।

এ বছর ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে দিনটি আমাদের সামনে এসে হাজির হয়েছে। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসন অবসানের পর এখন মুক্ত পরিবেশে দিবসটি পালন করা যাচ্ছে। জাতীয় নির্বাচন সমাগত। বিভিন্ন দল গণতন্ত্রের চর্চা করতে পারছে। রয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা। পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর হলো বাংলাদেশের নিপীড়িত, বঞ্চিত ও শোষিত মানুষের শৃঙ্খলমুক্তির এক অধ্যায়; যা দেড় বছর আগে পর্যন্ত বাকশালের নাগপাশে বন্দি ছিল।

আমরা এমন এক সময়ে ৭ নভেম্বর পালন করতে যাচ্ছি যখন জাতি এক দিকে নির্বাচন ও অন্য দিকে পরাজিত স্বৈারাচারের কৃত ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি। তাই সকল ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার অঙ্গীকারে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমরা মনে করি জুলাই বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশে দেশপ্রেমিক ছাত্র-জনতা সঠিক মর্যাদায় দিবসটি পালন করবেন।