ফ্যাসিবাদী শাসনামলের সাড়ে ১৫ বছরে গত এক দশকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অন্ধকার অধ্যায় ছিল গুমের ভয়াবহ সংস্কৃতি। নীরবতার ভেতর হাজারো মানুষ অতিষ্ঠ হয়েছিলেন গুমের ছায়ায়। কারো বিচারের সুযোগ হয়নি, কারো কণ্ঠরোধ হয়েছিল বেদনায়। সে সময়ের গুমের ঘটনা ছিল শুধুমাত্র ব্যক্তিগত নিরাপত্তার লঙ্ঘন নয়, বরং সমাজের ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে রাজনৈতিক ও মানবাধিকার সংকট সৃষ্টি করেছিল। গত এক বছরে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার গুম প্রতিরোধে যা পদক্ষেপ নিয়েছে, এই মুহূর্তে বাংলাদেশ সফররত জাতিসংঘের গুম বিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ (ডব্লিউজিইআইডি) তা গুরুত্ব দিয়ে দেখেছে এবং প্রশংসা করেছে। দৈনিক সংগ্রামসহ বিভিন্ন পত্রিকায় এ বিষয়ে তাদের অভিমতগুলো গুরুত্বের সাথে প্রকাশিত হয়েছে।

এবারের সফরে তারা বাংলাদেশ সরকারের আইন উপদেষ্টা, পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব, গুমের ভিকটিমসহ সংশ্লিষ্ট নানা মহলের সাথে কথা বলেছেন, বৈঠক করেছেন। জাতিসংঘের এ প্রতিনিধি দলটির কার্যক্রম আমাদের মানবিক দায়বদ্ধতার একটি স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরে। এ ধরনের সরাসরি সংলাপের মাধ্যমে দেশের প্রতি আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে এবং গুমের সংস্কৃতি যেন আর কখনো ফিরে না আসে, সে প্রত্যয়কে শক্তিশালী করেছে। গুমের ঘটনা শুধু অতীতের ফ্যাসিবাদী শাসনের একটি কলংক নয়, এটি দেশের গণতন্ত্র ও আইনশৃঙ্খলার ওপর একটি গভীর আঘাত। যখন কোনো নাগরিকের জীবন-দুর্ঘটনার প্রতিকার পাওয়া যায় না, তখন সে দেশের বিচারব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। জনগণের মধ্যে ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি হয়, যা দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

উদাহরণ হিসেবে গুম কমিশনের কাছে হাজির হওয়া ১৯ বছর বয়সী এক যুবকের কথা বলা যায়। তার বর্ণনায় উঠে এসেছে কিভাবে গুম করে রাখা হতো এবং আদালতে হাজির করে যেভাবে মিথ্যা বক্তব্য দিতে বাধ্য করা হতো। আদালতের বিষয়ে বলা হয়, নির্দিষ্ট মেজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করে স্বীকারোক্তি আদায় করা হতো। ফলে ভুক্তভোগী সত্য কথা বলতে চাইলেও সে সুযোগ দেয়া হতো না। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে দেওয়া গুম কমিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে আসে। অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপ-যেমন গুমের ঘটনার তদন্ত কমিটি গঠন, বিচার কার্যক্রম ত্বরান্বিতকরণ ও ভিকটিমদের পুনর্বাসন-একটি ইতিবাচক সংকেত। তবে শুধু পদক্ষেপ নেওয়া যথেষ্ট নয়, এ অপসংস্কৃতিকে মূলোৎপাটন করতে প্রয়োজন সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পুনর্গঠন।

বাংলাদেশ জাতিসংঘের গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে সই করলেও এখনো রয়ে গেছে অনেক চ্যালেঞ্জ। এ সংকট উত্তরণের সহজ উপায় হচ্ছে গুমের শিকার হওয়া পরিবারগুলোর কথা শোনা। ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব রুহুল সিদ্দিকীর সঙ্গে আলোচনার পর জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান গ্রাজিনা বারানোস্কা এ মন্তব্য করেছেন। অন্যদিকে জাতিসংঘের গুম-সম্পর্কিত কার্যনির্বাহী দলের (ওয়ার্কিং গ্রুপ) সঙ্গে বৈঠকের পর আগামী এক মাসের মধ্যে গুম প্রতিরোধ বিষয়ক আইন প্রণয়ন করা হবে বলে জানিয়েছেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। এ আইনের অধীনে গুমবিষয়ক একটি শক্তিশালী স্থায়ী কমিশন গঠন করা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

গুমের ঘটনা মূলত একটি ক্ষমতার অপব্যবহারের ফলাফল। তাই এ ধরনের অন্যায় যেন আর না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে হবে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার রক্ষায় কঠোর নিয়মাবলী প্রণয়ন। সরকারের পাশাপাশি নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমকেও এর কঠোর নজরদারি রাখতে হবে। মানুষের জীবনের মূল্য ও মর্যাদা রক্ষার জন্য রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে একতা ও সততা অপরিহার্য। বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের কণ্ঠস্বর যতই শক্তিশালী হোক, এর সাফল্য নির্ভর করবে সে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও সামাজিক ঐক্যের ওপর। বাংলাদেশে এখন যে অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে, তাতে আশা জাগে যে গুমের কালো অধ্যায় শীঘ্রই বন্ধ হয়ে যাবে। তবে এ জন্য প্রয়োজন নিরপেক্ষ তদন্ত, ক্ষতিপূরণ প্রদান ও ভিকটিমদের পূর্ণ পুনর্বাসন।

গুমের ভয়াবহতার স্মৃতি যেন দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মনে না থাকে, সেজন্য শিক্ষাক্ষেত্রে ও সামাজিক প্রচারণায় মানবাধিকার ও আইনের গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে। কারণ, মানুষ যখন নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অবগত হবে, তখন কেউ এ ধরনের অন্যায় করতে সাহস পাবে না। গুমের সংস্কৃতি থেকে উত্তরণের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে, যেখানে সকল নাগরিকই সমান মর্যাদা ও নিরাপত্তায় জীবন যাপন করবে- এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।