বিশ্বে নতুন করে মহামারীর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে বার্ড ফ্লু-ই হতে পারে প্রাণঘাতী নতুন মহামারী। তবে বিশ্বে এ ধরনের মহামারী নতুন কিছু নয় বরং প্রত্যেক শতাব্দীতেই একাধিক বৈশ্বিক মহামারী দেখা দিয়েছে। মূলত, বৈশ্বিক মহামারী বলতে বহুসংখ্যক মানুষকে আক্রমণকারী কোনো রোগের একাধিক মহাদেশ বা বিশ্বব্যাপী একটি বৃহৎ অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে পড়াকে নির্দেশ করে। আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা স্থির থাকা মহামারীকে বৈশ্বিক মহামারী হিসেবে ধরা হয় না। পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে বিস্তৃত পর্যায়ক্রমিক রোগ, যেমন মৌসুমী ইনফ্লুয়েঞ্জাকেও বাদ দেওয়া হয়; কেননা এগুলো বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার পরিবর্তে বিশ্বের বৃহৎ অঞ্চলে একসাথে ঘটে।

সমগ্র মানব ইতিহাসে গুটিবসন্ত এবং যক্ষ্মার মতো অনেকগুলি মহামারী দেখা দিয়েছে। সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক মহামারীগুলোর মধ্যে একটি ছিল ব্ল্যাক ডেথ (প্লেগ নামেও পরিচিত), যাতে ১৪ শতকে আনুমানিক ৭৫-২০০ মিলিয়ন মানুষ মারা গিয়েছিল। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য মহামারীর মধ্যে রয়েছে ১৯১৮ ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারী (স্প্যানিশ ফ্লু) এবং ২০০৯ ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারী (এইচ১এন১) এবং আরো রয়েছে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় মহামারী corona virus যা এ পর্যন্ত ৬৩ কোটি মানুষকে আক্রান্ত করেছে। এর মধ্যে আরো রয়েছে এইচআইভি/ এইডস।

বৈশ্বিক মহামারী এমন একটি মাধ্যমে বা উপায়ে ঘটে যা আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করে বিশ্বব্যাপী লোককে প্রভাবিত করে। কোন রোগ কেবল মহামারী নয়, কারণ এটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে বা বহু মানুষ এতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় না, মহামারী বলতে হলে এটিকে অবশ্যই সংক্রামক হতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, ক্যান্সার অনেক মৃত্যুর জন্য দায়ী। তবে মহামারী হিসাবে বিবেচিত হয় না কারণ এ রোগটি সংক্রামক নয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এর আগে একটি নতুন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস বহন প্রক্রিয়া বর্ণনা করার জন্য ছয়-পর্যায়ের শ্রেণিবিন্যাস প্রয়োগ করেছিল, যার দ্বারা একটি নতুন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস মানুষের মধ্যে প্রথম কয়েকটি সংক্রমণ থেকে মহামারীরূপে ছড়িয়ে পড়ে। এ ভাইরাসটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রাণীগুলিকে সংক্রমিত করে শুরু হয়, যেখানে কয়েকটি ক্ষেত্রে প্রাণীরা মানুষকে সংক্রমিত করে, তারপরে সে পর্যায়ে চলে আসে যেখানে ভাইরাসটি সরাসরি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে এবং যখন নতুন ভাইরাস থেকে সংক্রমণ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে তখন মহামারী দ্বারা শেষ হয়। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ডব্লিউএইচওর এক মুখপাত্র স্পষ্ট করে বলেছিলেন যে, ‘মহামারীর জন্য কোনও দাপ্তরিক বিভাগ নেই’।

বিশ্বে সর্বশেষ মহামারীর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিলো করোনা ভাইরাসের ব্যাপক বিস্তৃতির মাধ্যমে। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে করোনাভাইরাসের একটি প্রজাতির সংক্রমণ দেখা দেয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ভাইরাসটিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ‘২০১৯-এনসিওভি’ নামকরণ করে। ২০২০ সালের ১৪ই মে পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের ২১৩টিরও বেশি দেশ ও অধীনস্থ অঞ্চলে কোটি কোটি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হোন এবং এতে বিশ্বের ৩৫ লক্ষ ৬৬ হাজার ৫১২ জনের প্রাণহারী ঘটে। আর এতে রীতিমত বৈশ্বিক বিপর্যয় দেখা দেয়।

বিশ্ব যখন করোনা ভাইরাসের বিপর্যয় সামলে উঠতে পারেনি, তখন নতুন বৈশ্বিক মহামারী রীতিমত চোখ রাঙাতে শুরু করেছে। যা বিশ্বের আত্মসচেতন মানুষকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা গেছে, ফের মহামারী সৃষ্টি করতে পারে এমন ভাইরাসের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে বার্ড ফ্লু। এ বিষয়ে সতর্ক করেছেন বিজ্ঞানীরা। স্তন্যপায়ী প্রাণীর কোষে যদি এ ভাইরাস সংক্রমিত হয় তাহলে তা বিশ্ববাসীর স্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি করতে পারে বলে মনে করছেন তারা। এ খবর দিয়েছে বৃটেন-ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম স্কাই নিউজ। এতে বলা হয়, বিশ্বের কোথাও প্রথম একটি ভেড়ার মধ্যে এ ভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে উত্তর লন্ডনের ইয়র্কশায়ারে।

এ খবর বিশ্ববাসীর জন্য মহাবিপদ ঘণ্টা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া মার্কিন দুগ্ধজাত গবাদি পশুতেও এইচ৫এন১ ভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া গেছে। গত ডিসেম্বরে সংবাদমাধ্যমটির এক প্রতিবেদনে ঘোড়াতে এ ভাইরাসের সংক্রমণের ইতিহাস থাকতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। এ ভাইরাসটি মূলত স্পিল-ওভার সংক্রমণ, যার সঙ্গে পাখির জাম্পিং প্রজাতিগুলোর মিল রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি বিশেষ এ ভাইরাসটি স্তন্যপায়ী কোষের সঙ্গে খাপ খেয়ে যায় তাহলে বিশ্ববাসীর জন্য তা হবে বেশ উদ্বেগের বিষয়। এছাড়া যেসব মানুষের গৃহপালিত প্রাণীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে তারা এ ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সংবাদমাধ্যমটি বলছে, বৃটেনের বিশাল এলাকা জুড়ে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রতিরোধ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় সেখানে এইচ৫এন১ ভাইরাসের আরেকটি ঢেউ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দেশটিতে লাখ লাখ হাঁস-মুরগি মেরে ফেলতে হয়েছে। এ ভাইরাসে বন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীও আক্রান্ত হতে পারে। সম্প্রতি উত্তর নরফোকের মৃত সিলের কোষের মধ্যে এ ভাইরাসটি সনাক্ত করা হয়েছে। এছাড়া শেয়াল, ভোঁদড়, ডলফিন এবং পোর্পোইসের শরীরেও এ ভাইরাস শনাক্ত করেছেন বিজ্ঞানীরা।

দ্য অ্যানিমেল প্ল্যান্ট হেলথ এজেন্সি এ বিষয়টি গভীর পর্যবেক্ষণে রেখেছে। মার্কিন দুগ্ধজাত গবাদি পশুতে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর থেকে বৃটেনের খামারগুলোতে সংক্রমিত হাঁস-মুরগির সঙ্গে গবাদি পশুরও পরীক্ষা শুরু হয়েছে। এভাবে পরীক্ষা করতে যেয়ে ইয়র্কশায়ারের ওই ভেড়ার রক্তে এইচ৫ অ্যান্টিবডি শনাক্ত করা হয়েছে। ভেড়ার দুধেও ওই ভাইরাসটির জিন পাওয়া গেছে। তবে ভাগ্য ভালো যে খামারের অন্যান্য ভেড়ার শরীরে এ ভাইরাস সংক্রমিত হয়নি। যদিও পরে প্রাণীটিকে মেরে ফেলা হয়েছে।

গবেষকরা আশঙ্কা করছেন যে, আগামী দিনে বার্ড ফ্লু-ই নতুন করে বৈশ্বিক মহামারীর রূপ নিতে পারে। যা বিশ্বের ব্যাপক সংখ্যক লোকের প্রাণহানী এবং বড় ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিলে এ ভাইরাস রোধ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে গবাদি পশুর মধ্যে এ ভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর মার্কিন কর্তৃপক্ষ খুব ধীরে পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানা গেছে। বৃটেনের বেশ কয়েকটি সুপার শপের দুধে এ ভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে। ইয়র্কশায়ারে সংক্রমিত হওয়ার পর নতুন করে পরীক্ষা শুরু হয়েছে। পাখির শরীরে জিনগত কোনো পরিবর্তন হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখছেন বিজ্ঞানীরা। বাংলাদেশ সহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতেও এ বিষয়ে অধিক সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। যা নতুন মহামারীর ভয়াবহতা প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে।